Manager Babu - Rabindranath Thakur choto golpo

ম্যানেজার বাবু

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


আজ তোমাকে যে গল্পটা বলব মনে করেছি সেটা তোমার ভালো লাগবে না।
 
তুমি বললেও ভালো লাগবে না কেন।
 
যে লোকটার কথা বলব সে চিতোর থেকে আসে নি কোনো রানা-মহারানার দল ছেড়ে--
 
চিতোর থেকে না এলে বুঝি গল্প হয় না?
 
হয় বই- কি-- সেইটাই তো প্রমাণ করা চাই। এই মানুষটা ছিল সামান্য একজন জমিদারের সামান্য পাইক। এমন-কি, তার নামটাই ভুলে গেছি। ধরে নেওয়া যাক সুজনলাল মিশির। একটু নামের গোলমাল হলে ইতিহাসের কোনো পণ্ডিত তা নিয়ে কোনো তর্ক করবে না।
 
সেদিন ছিল যাকে বলে জমিদারি সেরেস্তার 'পুণ্যাহ' খাজনা-আদায়ের প্রথম দিন। কাজটা নিতান্তই বিষয়-কাজ। কিন্তু, জমিদারি মহলে সেটা হয়ে উঠেছে একটা পার্বণ। সবাই খুশি-- যে খাজনা দেয় সেও, আর যে খাজনা বাক্সতে ভর্‌তি করে সেও। এর মধ্যে হিসেব মিলিয়ে দেখবার গন্ধ ছিল না। যে যা দিতে পারে তাই দেয়, প্রাপ্য নিয়ে কোনো তক্‌রার করা হয় না। খুব ধুমধাম, পাড়াগেঁয়ে সানাই অত্যন্ত বেসুরে আকাশ মাতিয়ে তোলে। নতুন কাপড় প'রে প্রজারা কাছারিতে সেলাম দিতে আসে। সেই পুন্যাহের দিনে ঢাক ঢোল সানাইয়ের শব্দে জেগে উঠে ম্যানেজারবাবু ঠিক করলেন, তিনি স্নান করবেন দুধে। চারি দিকে সমারোহ দেখে হঠাৎ তাঁর মনে হল, তিনি তো সামান্য লোক নন। সামান্য জলে তাঁর অভিষেক কী করে হবে। ঘড়া-ঘড়া দুধ এল গোয়ালা প্রজাদের কাছ থেকে। হল তাঁর স্নান। নাম বেরিয়ে গেল চারি দিকে; সেদিন তিনি সন্ধ্যবেলায় খুশিমনে বাসার রোয়াকে ব'সে গুড়গুড়ি টানছেন, এমন সময় মিশির সর্দার, ব্রাহ্মণের ছেলে লাঠিখেলা নিয়ে খুব নাম করেছে, বললে, হুজুর আপনার নিমক তো খেয়েছি অনেককাল, কিন্তু অনেকদিন বসে আছি, আমাকে তো কাজে লাগালেন না। যদি কিছু করবার থাকে তো হুকুম করুন।
 
ম্যানেজার গুড়গুড়ি টানতে লাগলেন। মনে পড়ে গেল একটা কাজের কথা। জসিম মণ্ডল চর মহলের প্রজা, তার খেত ছিল পাশের জমিদারের সীমানা-ঘেঁষা। ফসল জন্মালেই প্রতিবেশী জমিদার লোকজন নিয়ে প্রজাকে আট্‌কাত। দায়ে পড়ে জসিমের দুই জমিদারেরই খাতায় আর দু জায়গাতেই খাজনা দিয়ে ফসল সামলাতে হত। যে ম্যানেজার দুধে স্নান করেন এটা তাঁর ভালো লাগে নি। এ বছরের জলিধানের ফসল কাটবার সময় আসছে-- এটা চরের বিশেষ ফসল। চরের জমির জল নেমে গেলেই কৃষাণ পলিমাটিতে বীজ ছিটিয়ে দেয়, শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ফসল গোলায় তোলে। এ বছরটা ছিল ভালো; ধানের শিষে সমস্ত মাঠ হি হি করছে। এবারকার ফসল বেদখল হলে ভারি লোকসান।
 
ম্যানেজার বললেন, সর্দার, একটা কাজ আছে। জসিমের জমিতে তোমাকে ধান আগলাতে হবে। একা তোমারই উপরে ভার। দেখব কেমন মরদ তুমি।
 
ম্যানেজার তখনও দুধের স্নানের গুমোর হজম করে উঠতে পারেন নি। মিশিরকে হুকুম দিয়ে গুড়গুড়ি টানতে লাগলেন।
 
ধান কাটার সময় এল। দিন নেই, রাত নেই, মিশির জসিমের খেতে পাহারা দেয়।
 
একদিন ভরা খেতে অন্য পক্ষের লোক হল্লা ক'রে এল, মিশির বুক ফুলিয়ে বললে, বাবা-সকল, আমি থাকতে এ ধান তোমাদের ঘরে উঠবে না। সেলাম ঠুকে চলে যাও।
 
মিশির যত বড়ো সর্দার হোক, সেদিন সে একলা। যখন তাকে ঘেরাও করলে সে গুটিসুটি মেরে ব'সে সবাইকে আট্‌কাতে লাগল।
 
অপর পক্ষের লোক বললে, দাদা, পারবে না। কেন প্রাণ দেবে।
 
মিশির বললে, নিমক খেয়েছি, প্রাণ যায় যাক; নিমকের মান রাখতেই হবে।
 
চলল দাঙ্গা-- শুধু লাঠির মার হলে হয়তো মিশির ঠেকাতেও পারত। অপর পক্ষ শড়কি চালালো। একটা এসে বিঁধল মিশিরের পায়ে।
 
অপর পক্ষ আবার তাকে সতর্ক করে বললে, আর কেন। এবার ক্ষান্ত দে, ভাই।
 
মিশির বললে, মিশির সর্দার প্রাণের ভয় করে না, ভয় করে বেইমানির।
 
শেষকালে একটা শড়কি এসে বিঁধল তার পেটে। এটা হল মরণের মার। পুলিশের হাতে পড়বার ভয়ে অপর পক্ষ পালাবার পথ দেখলে। মিশির শড়কি টেনে উপড়ে, পেটে চাদর জড়িয়ে ছুটল তাদের পিছন-পিছন। বেশি দূরে যেতে পারলে না। পড়ে গেল মাটিতে।
 
পুলিশ এল। মিশির জমিদারকে বাঁচাবার জন্য, তাঁর নামও করলে না। বললে, আমি জসিমের চাকরি নিয়ে তার ধান আগলাচ্ছিলুম।
 
ম্যানেজার সব খবর পেলেন। গুড়গুড়ি লাগলেন টানতে।
 
তাঁর দুধের স্নানের খ্যাতি-- এ তো যে-সে লোকের কর্ম নয়। কিন্তু, নিমক খেয়েছে যখন তখন প্রাণ দেওয়া-- এটা এতই কী আশ্চর্য। এমন তো ঘটেই থাকে। কিন্তু, দুধে স্নান!
 
   *
 
*    *
 
তুমি ভাবো এই যে বোঁটা
কিছুই বুঝি নয়কো ওটা,
      ফুলের গুমোর সবার চেয়ে বড়ো--
বিমুখ হয়ে আজ যদি ও
আলগা করে বাঁধন স্বীয়
      তখনি ফুল হয় যে পড়ো-পড়ো।
বোঁটাই ওকে হাওয়ায় নাচায়,
অপমানের থেকে বাঁচায়,
      ধরে রাখে সূর্যালোকের ভোজে;
বুক ফুলিয়ে দেয় না দেখা,
গোপনে রয় একা একা,
      নিচু হয়ে সবার উপর ও যে।
বনের ও তো আদুরে নয়,
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়,
      গায়েতে ওর নাইকো অলংকার;
রস জোগায় সে চুপে চুপে,
থাকে নিজে নীরস রূপে,
      আপন জোরে বহে আপন ভার।
কাঁটা যখন উঁচিয়ে থাকে
অহিংস্র কেউ কয় না তাকে--
      যতই কিন্তু করুক-না বদনাম,
পশুর কামড় থেকে যারে
বাঁচিয়ে রাখে বারে বারে
      সেই তো জানে কাঁটার কত দাম।

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.