Bachospoti - Rabindranath Thakur choto golpo

বাচস্পতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


দাদামশায়, তুমি তোমার চার দিকে যেসব পাগলের দল জমিয়েছিলে, গুণ হিসেব ক'রে তাদের বুঝি সব নম্বর দিয়ে রেখেছিলে?
 
হ্যাঁ, তা করতে হয়েছে বই-কি। কম তো জমে নি।
 
তোমার পয়লা নম্বর ছিলেন বাচস্পতি মশায়, তাঁকে আমার ভারি মজা লাগে।
 
আমার শুধু মজা লাগে না, আশ্চর্য লাগে। কারণ বলি-- কবিতা লিখে থাকি। কথা বাঁকানো-চোরানো আমাদের ব্যাবসা। যে শব্দের কোনো সাদা মানে আছে তাকে আমরা ধ্বনি লাগিয়ে তার চেহারা বদল করি। সে এক রকমের জাদুবিদ্যা বললেই হয়। কাজটা সহজ নয়। আমাদের বাচস্পতি আমাকে আশ্চর্য করে দিয়েছিলেন যখন দেখলুম তিনি একেবারে গোড়াগুড়ি ভাষা বানিয়েছেন। কান দিয়ে ধ্বনির রাস্তায় তার মানের রাস্তা খুঁজতে হয়। আমাদের কাজটাও অনেকটা তাই, কিন্তু এতদূর পর্যন্ত নয়। আমরা তবু ব্যাকরণ অভিধান মেনে চলি। বাচস্পতির ভাষা চলত সে-সমস্তই ডিঙিয়ে। শুনলে মনে হত যেন কী একটি মানে আছে!-- মানে ছিল বই-কি। কিন্তু, সেটা কানের সঙ্গে ধ্বনি  মিলিয়ে আন্দাজ করতে হত। আমার 'অদ্ভুত-রত্নাকর' সভার প্রধান পণ্ডিত ছিলেন বাচস্পতি মশায়। প্রথম বয়সে পড়াশুনা করেছিলেন বিস্তর, তাতে মনের তলা পর্যন্ত গিয়েছিল ঘুলিয়ে। হঠাৎ এক সময়ে তাঁর মনে হল, ভাষার শব্দগুলো চলে অভিধানের আঁচল ধ'রে। এই গোলামি ঘটেছে ভাষার কলিযুগে। সত্যযুগে শব্দগুলো আপনি উঠে পড়ত মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই মানে আনত টেনে। তিনি বলতেন, শব্দের আপন কাজই হচ্ছে বোঝানো, তাকে আবার বোঝাবে কে। একদিন একটা নমুনা শুনিয়ে তাক্‌ লাগিয়ে দিলেন। বললেন, আমার নায়িকা যখন নায়ককে বলেছিল হাত নেড়ে 'দিন রাত তোমার ঐ হিদ্‌হিদ্‌ হিদিক্কারে আমার পাঁজঞ্জুরিতে তিড়িতঙ্ক লাগে', তখন তার মানে বোঝাতে পণ্ডিতকে ডাকতে হয় নি। যেমন পিঠে কিল মেরে সেটাকে কিল প্রমাণ করতে মহামহোপাধ্যায়ের দরকার হয় না।
 
সভাপতি একদিন বিষয়টা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ওহে বাচস্পতি, সেই ছেলেটার কী দশা হল।
 
বাচস্পতি বললেন, সে ছেলেটার বুঝকিন্‌ গোড়া থেকেই ছিল বুঝভুম্বুল গোছের। তার নাম দিয়েছিলাম বিচ কুম্‌কুর।
 
মথুরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ও নামটা কেন।
 
বাচস্পতি বললেন, সে যে একেবারেই বিচ্‌কুম্‌কুর। পাঠশালার পেডেণ্ডোকে দেখলেই তার আন্‌তারা যেত ফুস্‌কলিয়ে। বুকের ভিতরে করতে থাকত কুড়ুক্কুর কুড়ুক্কুর। এমন ছেলেকে বেশি পড়ালে সে একেবারেই ফুস্‌কে যাবে, এ কথাটা বলেছিল পাড়ার সবচেয়ে যে ছিল পেড়াম্বর হুড়ুম্‌কি। একটু রসুন-- বুঝিয়ে বলি। পেডেণ্ডো কথাটা বালিদ্বীপের কাছে পেয়েছি। তাদের মুখের পণ্ডিত শব্দটা আপনিই হয়ে উঠেছে পেডেণ্ডো। ভেবে দেখুন, কত বড়ো ওজন ওর বিদ্যের বোঝা ঠেলে নিয়ে যেতে দশবিশ জন ডিগ্রিধারী জোয়ানের দরকার হয়। আর পণ্ডিত-- ছোঃ, তুড়ি দিয়ে তুড়তুড়ং ক'রে উড়িয়ে দেওয়া যায়।
 
অটলদা বললেন, বাচস্পতি, তোমার আজকেকার বর্ণনাটা যে একেবারেই চলতি গ্রাম্যভাষায়। এ তোমাকে মানায় না। সেই সেদিন যে সাধুভাষা বেরিয়েছিল তোমার মুখ দিয়ে, যার সধ্বংসৃনিত হার্দিক্যে বুদবুধিদের মন তিংতিড়ি তিংতিড়ি ক'রে ওঠে, সেই ভাষার একটু নমুনা আজ এদের শুনিয়ে দাও। যে ভাষায় ভারতের ইতিহাসটি গেঁথেছ, যার গুরুভার হিসেব ক'রে বলেছিলে ডুণ্ডুস্মানিত ভাষা, তার পরিচয়টা চাই। শুনে এদের সকলের আন্‌তারা ফাঁচকলিয়ে যাক।
 
বাচস্পতি মশায় শুরু করলেন, সম্মম্‌মরাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিৎত্রম্যন্ত পর্যূগাসন উত্থ্রংসিত --
 
একজন সভাসদ বললেন, বাচস্পতি মশায়, উত্থ্রংসিত কথাটা শোনাচ্ছে ভালো, ওর মানেটা বুঝিয়ে দিন।
 
পণ্ডিতজি বললেন, ওর মানে উত্থ্রংসিত।
 
তার মানে?
 
তার মানে উত্থ্রংসিত।
 
অর্থাৎ?
 
অর্থাৎ তার মানে হতেই পারে না। মেরেকেটে একটা মানে দিতেও পারি।
 
কী রকম।
 
ভিরভ্রিংগট্ট।
 
আর বলতে হবে না, স্পষ্ট বুঝেছি, ব'লে যান।
 
বাচস্পতি আবার শুরু করে দিলেন, সম্মম্‌মরাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিৎত্রম্যন্ত পর্যূগাসন উত্থ্রংসিত নিরংকরালের সহিত--
 
মথুরবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, কেমন মশায়, বুঝেছেন তো নিরংকরাল--
 
একেবারে জলের মতো। ওর চেয়ে বেশি বুঝতে চাই নে-- মুশকিল হবে।
 
বাচস্পতি আবার ধরলেন, নিরংকরালের সহিত অজাতশত্রু অপরিপর্যস্মিত গর্গরায়ণকে পরমন্তি শয়নে সমুসদগারিত করিয়াছিল।
 
এই পর্যন্ত ব'লে বাচস্পতি মশায় একবার সভাস্থ সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। বললেন, দেখুন একবার, সহজ কাকে বলে। অভিধানের প্রয়োজনই হয় না।
 
সভার লোকেরা বললে, প্রয়োজন হলেই বা পাব কোথায়।
 
বাচস্পতি মশায় একটু চোখ টিপে বললেন, ভাবখানা বুঝেছেন তো?
 
মথুরবাবু বললেন, বুঝেছি বই-কি। সমুদ্রগুপ্ত অজাতশত্রুকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিয়েছিলেন। আহা, বাচস্পতি মশায়, লোকটাকে একেবারে সমুসদ্‌গারিত করে দিলে গো-- একেবারে পরমন্তি শয়নে।
 
বাচস্পতি বললেন, ছোটোলাট একবার এসেছিলেন আমাদের পাড়ার স্কুলে বুটের ধুলো দিয়ে যেতে। তখন আমি তাঁকে এই বুগবুলবুলি ভাষার একটা ইংরেজি তর্জমা শুনিয়েছিলুম।
 
সভাস্থ সকলেই বললেন, ইংরেজিটা শোনা যাক।
 
বাচস্পতি পড়ে গেলেন, দি হাব্বারফ্লুয়াস ইন্‌ফ্যাচুফুয়েশন অব আকবর ডর্বেণ্ডিক্যালি ল্যাসেরটাইজট্‌ দি গর্ব্যাণ্ডিজম্‌ অফ হুমায়ুন।-- শুনে ছোটোলাট একেবারে টরেটম্‌ বনে গিয়েছিলেন; মুখ হয়েছিল চাপা হাসিতে ফুস্‌কায়িত। হেড পেডেণ্ডোর টিকির চার ধারে ভেরেণ্ডম্‌ লেগে গেল, সেক্রেটারি চৌকি থেকে তড়তং করে উৎখিয়ে উঠলেন। ছেলেগুলোর উজবুন্মুখো ফুড়ফুড়োমি দেখে মনে হল, তারা যেন সব ফিরিচুঞ্চুসের একেবারে চিক্‌চাকস্‌ আমদানি। গতিক দেখে আমি চংচটকা দিলুম।
 
সভাপতি বললেন, বাচস্পতি, এইখানেই ক্ষান্ত দাও হে, আর বেশিক্ষণ চললে পরাগগলিত হয়ে যাব। এখনি মাথাটার মধ্যে তাজ্ঝিম্‌ মাজ্ঝিম্‌ করছে।
 
বাচস্পতি আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে সভাপতির ভাষা এতদিনে ওঁদের মুখবুদ্‌বুদী শব্দে রঝম্‌ গঝম্‌ করে উঠত।
 
   *
 
*    *
 
যার যত নাম আছে সব গড়া-পেটা,
যে নাম সহজে আসে দেওয়া যাক সেটা--
এই ব'লে কাউকে সে ডাকে বুজ্‌কুল,
আদ্‌রুম ডাকত সে যে ছিল অতুল।
মোতিরাম দাস নিল নাম মুচকুস,
কাশিরাম মিত্তির হল পুচফুস।
পাঁশগাড়ি নাম নিল পাঁচকড়ি ঘোষ,
আজ হতে বাজ্‌রাই হল আশুতোষ।
ভুষকুড়ি রায় হল শ্রীমজুমদার,
কুর্দম হয়ে গেল যে ছিল কেদার।
যেদিন যূথীরে নাম দিল ভুজকুশি,
সেদিন স্বামীর সাথে হল ঘুষোঘুষি।
পিচকিনি নাম দিল যবে ললিতারে
দাদা এসে রাস্‌কেল ব'লে গেল তারে।
মিঠে মিঠে নাম যত মানে দিয়ে ঘেরা,
সে বলত, ভাবীকালে রবে না তো এরা--
পিত্ত নাশিবে নাম যদি হয় তিতো,
ভুজকালি নাম দেখো আমি নিয়েছি তো।
পাড়ার লোকেরা বলে ঘিরে তার বাড়ি,
ভাবীকালে পৌঁছিয়ে দিব তবে গাড়ি।
বেচারা গতিক দেখে দিল মুখ ঢাকা,
পিছে পিছে তাড়া করে মেসো আর কাকা।
দিয়েছিল যে মেয়ের নাম উজকুড়ি,
সঙ্গে উকিল নিয়ে এল তার খুড়ি।
শুনলে সে কেস্‌ হবে ডিফামেশনের,
ছেড়ে দিলে কাজ নাম-পরিবেশনের।

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.