শেষ বেলার গল্প - বাংলা ভূতের গল্প (Sesh belar golpo - Benglai Horror Story)

শেষ বেলার গল্প
-শাপলা জাকিয়া



রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় হঠাৎ। কেনো ঘুম ভাঙ্গল ঠিক বুঝতে পারি না। বালিশের পাশটাতে হাতড়াই মোবাইলের জন্য, সময় দেখব। কিন্তু মোবাইলটা পাই না। হয়তো ভুল করে শোবার সময় সেটা বালিশের পাশে রাখা হয়নি ।
গত রাতে স্কুলের খাতা দেখতে বসেছিলাম রাতের খাবারের পর। দেড়টার দিকে খাতা দেখা শেষ করে তবে শুই। এখন তাহলে কতো রাত ? আলো জ্বালিয়ে দেয়াল ঘড়িটা দেখবো বলে বেড সাইড ল্যাম্পটা জ্বালাতে গিয়ে মনে পড়ে, দুইদিন থেকে ল্যাম্পটা নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে ।
ঘর অন্ধকার করে ঘুমানোর অভ্যাস আমার। বাইরের কোন আলো এই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করতে পারছে না কারণ দরজাটা ভিতর থেকে লক না করলেও ভেজানো আছে, তাছাড়া এই মুহূর্তে ঘরের ভারী পর্দাগুলি একটুও না নড়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। সেই অন্ধকারে হঠাৎ মনে হয় আমার ঘরে কেউ একজন হাঁটছে । পায়ের পাতা ঘষটে ঘষটে হাঁটা , খসখস শব্দ। আমি শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বললাম ,
- কে ?
কোন উত্তর আসলো না । শুধু খসখস শব্দটা থেমে গেলো । আমি এবার নিশ্চিত হলাম , সত্যিই ঘরে আমি ছাড়া অন্য কেউ আছে। আমি আবার বললাম,
-কে?
হঠাৎ সেই মানুষটা লাফ দিয়ে খাটে উঠে বসলো। আমিও লাফ দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলাম , কিন্তু মানুষটা আমায় ধাক্কা দিয়ে চিৎ করে বিছানায় ফেলে মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরলো । আমার এম্নিতেই শ্বাস কষ্টের সমস্যা আছে তার ওপর বালিশের এই চাপ আমি নিতে পারলাম না । একটু বাতাসের জন্য ছটফট করতে করতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেলাম !
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন পূব দিকের বারান্দার পর্দা ভেদ করে রোদ ঢুকে পড়েছে ঘরে। প্রথমেই রাতের ভয়াবহ স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো। উফ ! কি ভয়ানক স্বপ্ন রে বাবা! স্বপ্নটা এতো বাস্তব ছিলো যে এখনো সত্যি বলে মনে হচ্ছে। পর্দা গলে ভিতরে ঢুকে পড়া রোদের দিকে তাকিয়ে দুঃস্বপ্নটা ভুলতে চেষ্টা করলাম আমি।
কাজের মেয়ে রুবি এরমধ্যেই উঠে পড়ে কিচেনে কাজে লেগে গেছে বোধহয়, তৈজসপত্রের টুং-টাং শব্দ ভেসে আসছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ইশ সাড়ে ছয়টা! আজ বেলা হয়ে গেলো। সাধারণতঃ ছয়টায় উঠি। মর্নিং ওয়াক সেরে সাতটায় বাড়ি ফিরে আটটায় রওয়ানা হই স্কুলে। বাঁধা রুটিন, একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা পড়াই আমি।
পোশাক বদলানোর সময় নেই, যে সালোয়ার কামিজ পরে আছি ওটাই ঠিক আছে ভেবে নিয়ে তড়িঘড়ি মর্নিং ওয়াকের জন্য রওয়ানা হলাম , বেরোনোর আগে বাড়ির বাকি দুইটা বেডরুমের দরজার দিকে চোখ পড়লো, দুইটা দরজাই বন্ধ। একটাতে থাকে কলেজ পড়ুয়া ছেলে কিংশুক, অপরটাতে ব্যবসায়ী স্বামী মারুফ। মারুফ একা ঘরে ঘুমাতে ভালোবাসে। পাশে কেউ নড়াচড়া করলে তার না কি ঘুম হয় না । একা ঘুমাতে প্রথম প্রথম আমার খুব অসুবিধা হতো। দারুণ ভূতের ভয় ছিল । কিন্তু এখন ঘর অন্ধকার করে আমিও মারুফের মতো একা ঘুমাতে ভালোবাসি। বয়স বাড়ার সাথে ভুতের ভয় কোথায় চলে গেছে । মানুষের আসলে সব সয়ে যায় , ভাবতে ভাবতে বাইরে যাবার দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ি ।
রুবি দরজা খুলে হাসি হাসি মুখে খবরের কাগজ দিয়ে যায় যে ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাগজ দরজার ফাঁক গলিয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা, তাই হয়তো দিয়েছে কারণ বেলের আওয়াজ তো শুনলাম না। তারমানে রুবি নিজেই আগ বাড়িয়ে দরজা খুলেছে মনে হচ্ছে। কাগজ দিয়ে যাওয়া ছেলেটার প্রেমে পড়লো নাকি! পড়তে পারে, পনেরো-ষোল বয়সটাই ওরকম। রুবিকে দরজা বন্ধ করতে বলে ওদের পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে এলাম। যা বলার বাড়ি ফিরে বলবো। দোতলা থেকে আর লিফট ধরি না আমি, সিঁড়ি ব্যবহার করি। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম কাগজওলা ছেলেটা লিফটের দিকে এগোচ্ছে, রুবি এখনও দরজা বন্ধ না করে সেদিকে তাকিয়ে আছে। রাগ হলো, আমি যে দরজা বন্ধ করতে বলেছি তা যেন কানেই যায়নি ওর। আমি সাধারণত বকাঝকা করি কম,কিন্তু আজ বাড়ি ফিরে রুবিকে কড়া করে নিষেধ করে দিতে হবে। এসব প্রেম-পিরিতের ফাঁক গলে কতো রকম ক্রাইম হয় আজকাল, রুবিটা সরল, শেষে ফেঁসে যাবে।
আজ বিশ মিনিটের বেশী হাঁটা যাবে না। হাতে সময় কম। ভাবতে ভাবতে বেড়িয়ে পড়লাম। আজ শরীরটা বেশ হালকা লাগছিল, ওজন বোধহয় বেশ কমেছে, মনে হচ্ছে উড়ছি।
হাঁটা সেরে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন ভেবেছিলাম মিনিট বিশেকের মধ্যেই ফিরতে পেরেছি। হয়তো সাড়ে সাতটা বাজে এখন। বেরোনোর সময় তাড়াহুড়োয় ঘড়ি, মোবাইল নেয়নি।
গেট দিয়ে ঢুকতেই যেখানে সিকিউরিটি গার্ড বসে থাকে তার মাথার ওপর ওয়ালে বিশাল একটা ঘড়ি টাঙ্গানো । সেদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে ! ঘড়িটা নিশ্চয় নষ্ট হবে!
তারপর, ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো,একটা খাটিয়া। খাটিয়ায় লাশ শোয়ানো । তার পাশে বেশ কিছু পুরুষ - মুহিলার জটলা । এই বহুতল ভবনের লোকজন বলেই মনে হলো সবাইকে । কে মারা গেলো ? কাছাকাছি গিয়েও লাশের মুখ দেখতে পারলাম না। কাপড়ে মুখ ঢাকা । ফিফথ ফ্লোরের মুকুল সাহেব কাকে যেন মোবাইলে বলছেন ,
- প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। এখনি লাশটিকে গোরস্থানে নেয়া হবে । বাদ জোহর জানাজা ,তারপর দাফন ।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, সাড়ে বারোটা! কিভাবে সম্ভব! আমি এতোক্ষন হাঁটলাম কিন্তু টের পেলাম না ! কেমন হিসাব মিলছিল না।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিরণ নামের মেয়েটিকে বললাম,
- কয়টা বাজে বলো তো? কে মারা গেছেন ?
কিন্তু কিরণ তাকালো না , উত্তরও দিলো না । থমথমে মুখে বাম দিকে রাখা একটি মেরুন কালারের গাড়ীর দিকে তাকিয়ে থাকলো । তবে কি কিরণের মা মারা গেলেন ? ভদ্রমহিলা ব্ল্যাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন শুনেছিলাম। আহা ! মেয়েটা মা হারালো ! পাশে দাঁড়িয়ে , সান্ত্বনা দিয়ে কিছু কথা কিরণ কে বললাম। যদিও জানি এই কষ্টের কোন সান্ত্বনা হয় না ।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কেউ একজন জলদ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো ,
- উনিই কি মারুফ সাহেব ?
চমকে পিছনে ফিরে বক্তাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। রীতিমতো খুনে ডাকাতের মতো চেহারা। মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল । চোখ জবা ফুলের মতো টকটকে লাল । সবচেয়ে আশ্চর্য লোকটির পোশাক , আলখেল্লা ধরনের, অদ্ভুত তার ছাঁট। এই রকম পোশাক পরে চলাচল করে না লোকে । পাগল না কি ! সিকিউরিটি গার্ড ঢুকতে দিলো কেনো? কি আশ্চর্য !
লোকটি আবার বললো ,
- উনিই কি মারুফ সাহেব ?
লোকটির দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালাম , আমার স্বামী মারুফের দিকেই ইঙ্গিত করছে লোকটি। আমি “হ্যাঁ” বলে মারুফের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই লোকটি বলে উঠলো ,
- আপনি যাবেন না !
তারপর পাশে দাঁড়ানো খুব রোগা আর লম্বা একটি লোককে বললো ,
- তুমি যাও ।
লম্বা আর রোগা লোকটি সোজা মারুফের কাছে গিয়ে তার গালে সশব্দে একটি চড় কষালো। মারুফ চড়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো । আশেপাশের সবাই মারুফের দিকে ছুটে গেলো । আমি দেখলাম তাদের মধ্যে আমার ছেলে কিংশুকও আছে। কিন্তু যে থাপ্পড় দিলো তাকে ওদের কেউ যেন দেখতেই পেলো না । বরং কে যেনো বললো,
- মারুফ সাহেব মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন, ডাক্তার ডাকুন কেউ।
আমি ছুটে যাচ্ছিলাম । অদ্ভুত পোশাকের লোকটি পথ আটকে আবার বললো,
- আপনি যাবেন না ।
প্রচণ্ড রেগে যাই আমি এবার ,
- আশ্চর্য তো ! কেনো আমি যাবো না ? আর আপনারা কে ? কেনো আমার স্বামী কে মারলেন ? আপনাদের আমি পুলিশে দেবো !
লোকটি তেমনই জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে , নির্লিপ্ত জলদ গম্ভীর কন্ঠে বললো ,
- এই লোকটি নিজের পরকীয়া প্রেমের কারণে তার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে আর এখন সেটা সুকৌশলে ধামাচাপা দিয়ে ভালো মানুষ সেজেছে । থাপ্পড়টি তার পাওনা। আমরা এসেছি লাশটা নিয়ে যেতে । লাশ নিয়েই আমরা চলে যাবো ।
- কি যা তা বলছেন ! মারুফের স্ত্রী আমি । এই দেখুন জলজ্যান্ত আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি । লাশ নিতে এসেছেন , নিয়ে যান না , ঐ তো খাটিয়ায় শুয়িয়ে রেখেছে । আপনারা কোথা থেকে আসছেন ? এমন অদ্ভুত পোশাক কেনো আপনাদের ?
- আহ ! এতো প্রশ্ন করবেন না । লাশ দিয়ে দিন, চলে যাই।
আমার মনে হলো লোকটি বদ্ধ উন্মাদ। এই উন্মাদকে পাশ কাটিয়ে আমি আবার মারুফের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলাম । লোকটি বিরক্ত হয়ে বললো ,
- ওদিকে যাবেন না, আপনি আমার সাথে চলুন । বললাম না, লাশ নিতে এসেছি !
আমি নিরুপায় হয়ে ছেলেকে ডাকি,
- কিংশুক ! কিংশুক ! এদিকে আয় তো বাবা , দেখ এই পাগল লোকটি আমাকে আটকে রেখেছে ।
কিংশুক কিন্তু আমার দিকে এগিয়ে এলো না বরং ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মৃতদেহের কাছে। খাটিয়ার পাশে বসে পড়ে হু হু করে কেঁদে ফেললো । কিরণের সাথে কিংশুকের ভালো বন্ধুত্ব, বন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে কিংশুক কাঁদতেই পারে। কিংশুকের কান্না আমাকে যথেষ্ট বিচলিত করলো, আমি অদ্ভুত লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এবার কিংশুকের পাশে ছুটে গেলাম। ব্যাকুল হয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম ওকে কিন্তু তার আগেই কেউ একজন লাশের মুখ দেখতে চাওয়ায় , লাশের মুখের ওপর থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড় সরালো কিংশুক, দেখতে পেলাম ,খাটিয়ায় নাকে তুলা গুঁজে অবিকল আমার মতো দেখতে কেউ শুয়ে আছে !
অদ্ভুত লোকটি ততোক্ষণে আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে, এবার আগের চেয়ে শান্ত গলায় বলছে,
-চলুন, বললাম তো আপনাকে নিতে এসেছি।
গতরাতের স্বপ্নটা তবে স্বপ্ন ছিল না!
সমাপ্তি

© bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.