এত জলদি বিয়ের সব প্রিপারেশন নেওয়া যায় নাকি। আরও কিছুদিন সময় নিলে ভালো হতো না।
- তাতো হতোই আরো কিছুদিন সময় নেই আর তুমি নিজের আরো বেহাল দশা কর।
- সাগর আমি খুব সাধারণ ভাবে বিয়ে করতে চাই। আমার কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা প্রয়োজন নেই।
- ওকে তুমি যেমন বলবে তেমনি হবে।
- ওকে।
আমি সাগরের কাঁধে মাথা রাখলাম। সূর্যটা পুরোপুরি ডুবে গেছে। চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। আমার নিজেকে আজ পূর্ণ মনে হচ্ছে।
কিছুসময় পর উঠে রওনা করলাম। সাগর আমাকে বাসায় দিয়ে গেল। আমি ফ্রেশ হয়ে আন্টির কাছে গেলাম। সব শুনে আন্টি ভীষণ খুশি হলো।
পরদিন সকালে অফিসে গেলাম। বস আমার কাজে ভীষণ খুশি। বস আমাকে প্রমোশন দিয়ে দিলেন। আমি বসকে বিয়ের কথা বললাম। বস আমাকে আরো ১৫ দিনের ছুটি দিয়ে এরপর কাজে ফিরতে বললেন। সিদ্ধান্ত নিলাম আগামী তিনদিন অফিস করব। সাগরকেও বললাম দায়িত্ব কিছুদিনের জন্য অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিতে। সিদ্ধান্ত নিলাম সব কাজ মিটিয়ে আগামী ৩ দিন পর থেকে বিয়ের সব জোগাড় শুরু করব।
৩ দিন পর।
সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। আজ বিয়ের শপিংয়ে যাওয়ার কথা। সাগর আজ সোনিয়া আন্টিকে নিয়ে আসবে। এত বছর পর আন্টির সাথে দেখা হবে আনন্দও হচ্ছে আবার ভয়ও হচ্ছে। ১১ টার দিকে সাগর চলে আসল। আমি নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলাম। আন্টি আর আমি পিছনে বসলাম সাগর ড্রাইভ করছিল।
- এনি তুইতো খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিস একবার তো আন্টির সাথে দেখা করতে গেলিনা।
- সরি আন্টি আসলে ওদিকে অনেক বছর যাইনা তুমিতো সব জান।
- ধুর বাদ দে তো তোর বাবার কথা। আচ্ছা সিদ্ধান্ত ভেবে নিয়েছিস তো পারবিতো এই পাগল সামলাতে।
- তুমি আছ না।
- তাই বুঝি।
- হুমম। আন্টি তুমি মন থেকে আমাকে মেনে নিয়েছ তো?
- তোর মতো মিষ্টি একটা মেয়ে আমার বৌ মা হবে আর আমি মানবনা তাই কী হয়।
- লাভ ইউ আন্টি।
- লাভ ইউ টু সুইটি। এখন থেকে মা ডাকবি বুঝলি।
- ওকে।
- মা তুমিনা একদম আগের মতই আছ সো সুইট।
- আরে কী যে বলিস না আমি কী বুড়ি হয়ে গেছি নাকি।
- হুমম একদম ঠিক বলেছ।
- দেখ এনি তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আসলে সামাজিকতা বলে একটা বিষয় আছে বুঝিস তো তাই তোদের বিয়ের জন্য আমি একটা পার্টি দিচ্ছি আমি সবাইকে বলে দিয়েছি তোর যাদের কে বলার বলে দিস।
- ওকে।
সাগর একটা শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করলো। মা, আমি আর সাগর ভিতরে ঢুকলাম। মা প্রথমেই একটা শাড়ির দোকানে ঢুকলো। দোকানদার নানা রঙের নানা ডিজাইনের শাড়ি বের করে সামনে রাখল। মা আর সাগর বিয়ে বৌভাত এসবের জন্য অনেকগুলো শাড়ি কিনল। এরপর একে একে জুয়েলারি কসমেটিকস জুতো সহ আরো নানারকম প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হলো। সাগরের জন্য সেরোয়ানি, ব্লেজার, জুতো সহ আরো নানারকম জিনিস কেনা হলো। কেনাকাটা শেষ করে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাওয়া দাওয়া করলাম। অনেক গল্প করলাম। সাগর বেচারা মায়ের জন্য আজকে আর আমার সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না একা একা বসে আছে চুপচাপ।
সব কাজ শেষে সাগর আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। কালকে আন্টি আবার আসবে আমাকে নিয়ে পার্লারে যাবে মেহেদী পড়াতে। আমি রুমে এসে জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখলাম। ফ্রেশ হয়ে পিয়া আপুর আর আদিল ভাইকে ইনভাইট করলাম। তাছাড়াও অফিসের বস আর কলিগদের ইনভাইট করলাম। শোভা আর সাহারা আপু আমার রুমে আসলো। আমরা অনেক সময় গল্প করে পার করলাম।
পরদিন বিকেলে আন্টি আসলেন। এরপর আমাকে নিয়ে একটা পার্লারে গেলেন। পার্লারের মহিলা আমার দুই হাত পায়ে খুব সুন্দর করে মেহেদী পড়িয়ে দিলেন। আমি অনেক জোরাজোরি করায় আন্টিও মেহেদী পড়লো। মেহেদী পড়ার পর আন্টি আর আমি মিলে বের হয়ে ফুচকা খেলাম। আমার মনটা একদম ভালো হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন শ্বাশুড়ি না আর একটা বন্ধু পেয়েছি। তবে আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে। আমার জীবনের এত সুন্দর একটা মুহূর্তে আমার মা বাবাই আমার পাশে নেই। রাতে আন্টি এসে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। কাল দুপুরে খুব ঘরোয়া ভাবে বিয়ে পড়ানো হবে। বাড়িওয়ালি আন্টি তার বাসায় সব আয়োজন করে রেখেছেন। বাসায় আসার পর সাগর কল দিল। ওর সাথে কিছুসময় কথা বললাম। আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছিল। ছোট ভাইটাকে একটা কল দিলাম। ও কলটা রিসিভ করলো।
- হ্যালো কে?
- শুভ আমি এনি।
- আপু কেমন আছিস? কতদিন পর কল দিলি।
- ভালো আছি তুই ভালো আছিস?
- হুমম। বাসার সবাই ভালো আছে?
- হুমম। জানিস সেদিন তোর নিউজ রিপোর্ট দেখছিলাম। তোর জন্য অনেক টেনশন হচ্ছিল।
- আচ্ছা শোন তোকে একটা কথা বলতে চাই?
- হুমম বলনা।
- কাল আমার বিয়ে তুই কী আসবি?
- সত্যি। কে সে ভাগ্যবান বলনা।
- উল্টোদিকের বাসার সোনিয়া আন্টিদের চিনিস?
- হুমম উনারাতো বিদেশে ছিল গতবছর এসেছে।
- সোনিয়া আন্টির ছেলে সাগরের সাথে কাল আমার বিয়ে আমারতো কেউ নেই তুই আসলে আমার খুব ভালোলাগবে।
- এভাবে বলিসনা। কাল আমি অবশ্যই আসব।
- এখন রাখছি তাহলে। কাল দুপুর ২ টার আগে চলে আসবি কিন্তু।
- ওকে আপু গুড নাইট।
- গুড নাইট।
আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। কিছুসময় একা একা কাঁদলাম। এরপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
সকাল বেলা সাহারা আপু ডেকে তুললেন। আন্টি বাসার ছাদে সব আয়োজন করেছে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর আন্টি আমাকে বললেন গোসল সেরে নিতে। কিছুসময় পর একজন মহিলা আসল। আমি বিয়ের বেনারসি আর গয়না বের করে তৈরি হতে বসলাম। মহিলা সময় নিয়ে খুব সুন্দর করে আমাকে সাজিয়ে দিল। সাহারা আপু পাশ থেকে হাসছে আর বলছে, আজকেতো সাগরের চোখ এনির উপর থেকে সরবেই না। আপুর কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলাম।
বাড়িওয়ালি আন্টি আমাকে নিয়ে উপরে উঠলেন। উনার পরিবারের সবাই আছে। কিছুসময় পর শুভ মা আর সাগর এসে পৌঁছে গেল। আন্টি বাসার গেট থেকে জামাই বরণ করে নিয়ে আসল। আমার পাশে সাগরকে বসানো হলো। সাগরকে সেরোয়ানিতে অসাধারণ লাগছে। আমি আড় চোখে ওকে একবার দেখে নিলাম।
কাজী এসে আমাদের বিয়ে পড়ালেন। বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ার পর খাবার পরিবেশন করা হলো। নাচ গান হলো খুব ভালো একটা সময় পার করলাম। মা আন্টিকে কাল বৌভাতে অবশ্যই উপস্থিত হতে বললেন। শুভ ভীষণ খুশি হয়েছে ও বার বার বলছিল আপু তোকে পরীর মতো লাগছে। তোর আর ভাইয়ার জুটিটা দারুণ মানিয়েছে। ওর কথায় আমি মুচকি মুচকি হাসছিলাম।
সন্ধ্যায় আন্টি বাকী আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমাদের বিদায় দিলেন। আমি সব জিনিস আগেই গুছিয়ে রেখেছিলাম শুভ সেগুলো গাড়ির পেছনে তুলে নিল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। সাগর ড্রাইভ করছিল। ওর পাশে শুভ বসলো। মা আর আমি পিছনে বসলাম। আমার বুকের ভিতর বারবার কেঁপে উঠছিল। এতদিন দূরে থেকেছি বলে নিজেকে শক্ত রাখতে পেরেছি আর আজ বাবা মায়ের এতো কাছে গিয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারব কিনা সেটাই ভাবছি।
গাড়িটা সাগরদের বাসার সামনে এসে থামলো। ঠিক পিছনেই আমাদের বাসা। শুভ নেমে বাসায় চলে গেল। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে। সাগর আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো।
ওদের বাসাটা ৮ তলা। নিচের ৬ তলা ভাড়া দেওয়া। উপরের দু তলা ডুপ্লেক্স সিস্টেম করা। মা আগে উঠে গেলেন। আমি আর সাগর পিছনে উঠলাম। মা আমাকে বধূ হিসেবে বরণ করে ঘরে তুললেন। আমরা কিছুসময় ডাইনিংয়ে বসলাম। দারোয়ান আমার সব জিনিস সাগরের ঘরে পোঁছে দিল।
১০ টার দিকে ডিনার শেষে মা আমাকে সাগরের ঘরে পোঁছে দিলেন। সাগরের ঘরটা পুরো বকুল ফুল আর রজনীগন্ধায় সাজানো। এত সুন্দর গন্ধে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। সাগর এখনো আসেনি, আমি লাগেজ গুলো আলমারির পাশে এনে রাখলাম।
কিছুসময় পর সাগর রুমে আসলো।
- কী ব্যাপার কী করছিলে?
- এসির সামনে দাড়িয়ে রংরং পাখির মতো হা করে হাওয়া খাচ্ছিলাম।
- রিয়েলি।
- হুমম। তা জনাব এত সময় কোথায় ছিলেন?
- বাইরে গিয়ে ছিলাম একটু।
- ওহ আচ্ছা। অনেক রাত হয়ে গেছে পারমিশন দিন এসব ভারী শাড়ি গহনা খুলি এবার।
- হুমম সিওর এগুলো খুলে ফ্রেশ হয়ে নাও।
- আর তুমি।
- আমিও চেঞ্জ করে নিচ্ছি।
আমি এসব শাড়ি গহনা খুলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। একটা টি শার্ট আর প্লাজো পরে বের হলাম। সাগরও চেঞ্জ করে লুঙ্গি আর টি শার্ট পরে আছে। আমি ওকে কোনদিন এই পোশাকে দেখিনি আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। হাসি আটকে রেখে আমি বিছানায় ওর পাশে বসে ওর কাঁধে মাথা রাখলাম। সে ফোনে কিছু একটা করছিল আমাকে দেখে ফোনটা বিছানার পাশে রেখে দিল।
- ঘরটা খুব সুন্দর সাজানো হয়েছে।
- তোমার পছন্দ হয়েছে।
- হুমম অনেক। জান সাগর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলে তুমি। আরো আগে কেন আমার জীবনে আসলেনা তাহলেতো আমাকে এত কষ্ট করতে হতো না।
- এখন এসে গেছি আর কখনো তোমাকে কষ্ট পেতে দিবনা।
- কথা দাও সারাজীবন এভাবেই আমাকে আগলে রাখবে।
- কথা দিলাম সারাজীবন এভাবেই তোমাকে আগলে রাখব। আরও অনেক বেশি ভালোবাসবো।
- আই লাভ ইউ।
- আই লাভ ইউ টু।
সকালে ঘুম ভাঙলো বুয়ার ডাকে। আমি সাগরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম। বুয়ার ডাকে উঠে দরজা খুললাম।
- ভাবি খালাম্মা ডাকতেছে ভাইজানরে নিয়া জলদি নাস্তা করতে আসেন নয়তো অনুষ্ঠানে যাইতে দেরী হয়ে যাইব।
- ওকে তুমি যাও আমরা আসছি।
সাগরকে এসে ডেকে তুললাম। গোসল সেরে দুজনেই নাস্তা করতে নিচে নামলাম। মা নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। মায়ের সাথে বসে নাস্তা শেষ করলাম।
১ টার দিকে আবার সাজতে বসলাম। মেরুন কালারের একটা লেহেঙ্গা পড়ে সাথে বাহারী রকমের গহনা পরে তৈরি হয়ে নিলাম। সাগরও তৈরী হয়ে নিল। আমরা রওনা করলাম। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে সাগর গাড়ি পার্ক করল। আমরা অনেক ছবি তুললাম।
ভিতরে গিয়ে দুজনই চেয়ারে বসলাম। অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। আন্টি সাহারা আপু শোভা আপু ওরা সবাই আসলো। পিয়া আপু আদিল ভাই ও আমার নিমন্ত্রিত সবাই আসলো। আমার ভীষণ ভালো লাগছিল শুধু কষ্ট একটাই যে সবার মাঝে আমার পরিবারি নেই। তবে শুভ এসেছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে নাচগান হলো। সারাদিন খুব আনন্দে কাটলো। সবাই অনেক গিফট দিয়েছে। গাড়ির পিছনের সিটে করে সব নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম।
আমার জীবনে ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনটাই পেয়ে গেলাম। স্বপ্নের মতো লাগছিল সব কিছু। ছুটি শেষ হওয়ার পর আমরা দুজনেই কাজে যোগ দিলাম।
এবছর বেস্ট জার্নালিস্টের এওয়ার্ড উঠলো আমার ঝুলিতে। ভীষণ আনন্দ লাগছিল আমার। সাগরও ভীষণ খুশি আমার এই অর্জনে। সত্যিই সে আমার জন্য লাকী।
বিয়ের ৬ মাস পর বুঝতে পারলাম আমার ভিতরে কেউ বেড়ে উঠছে। সেদিন মা আর সাগর এতো খুশি হয়েছিল যা বলে বুঝানো যাবে না। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। প্রথম বেবি তাই আমার শারীরিক মানসিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ভীষণ কষ্ট হতো। তার উপর কাজের ভার নেওয়া আমার জন্য কষ্ট কর ছিল তাই চাকরি ছাড়তে হলো। সাগর হসপিটালের পর পুরোটা সময় আমাকে দিত। মা সারাদিন বাচ্চাদের মতো খাবার নিয়ে পিছনে পিছনে ঘুরতো।
আমার মা বাবা এই খুশির সংবাদ শুনেও একবার আমাকে দেখতে আসেনি। শুভ প্রায়ই আসত আমাকে দেখে যেত। আমার ভেতর নতুন একটা প্রাণ একটু একটু করে বাড়তে লাগলো। আমি তাকে অনুভব করতাম। ৫ মাস পর জানতে পারলাম একজন নয় দুজন বেবি আছে তখন সাগর আর মায়ের খুশি আরো বেড়ে গেল।
বলেনা সুখ বেশিদিন কপালে সয়না আমার হলো সেই অবস্থা। ৮ মাস চলাকালীন বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম। ভীষণ ব্যাথা পেলাম। সাগর বাসায় ছিলনা মা দৌড়ে আমার কাছে আসলেন। মা তখনি সাগরকে কল দিলেন। সাগর এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পৌঁছে গেল। ব্যাথায় আমার জান বের হওয়ার অবস্থা। বাসার বাইরে এ্যাম্বুলেন্স দেখে শুভ দৌড়ে এসেছিল।
আমাকে হসপিটালে নেওয়া হলো। অবস্থা খারাপ দেখে ডাক্তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার একটা ছেলে আর মেয়ে দুনিয়ায় আসলো তবে বেবিদের কিছুদিন এনআইসিইউ তে রাখতে হবে। সময়ের আগে জন্ম নেওয়ায় ওরা বেশ দুর্বল তাই ডাক্তাররা এই পরামর্শ দিলেন। অপারেশনের পর আমি বেবিদের দেখতে চাইলাম। ওদের কথা শুনে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। অনেক কাঁদলাম আল্লাহ'র কাছে দোয়া চাইলাম যেন আমার বেবীদের সুস্থ করে দেয়। সাগর আমাকে শান্তনা দিল। ডাক্তার আমাকে কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দিলেন।
চোখ মেলে বুঝতে পারলাম কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম আর কেউ না এটা আমার মা। বাবা সোফায় বসে আছে। ইমন আর মা তার পাশে বসে আছে। আমার মনের এত বছরে জমিয়ে রাখা কষ্টগুলো কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। মা আমার চোখ মুছে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
- কাঁদিস না মা আর কাঁদিস না সব রাগের পালা শেষ কেউ মানুক আর না মানুক তুই আমার মেয়ে। তোকে আমি ১০ মাস পেটে ধরেছি। হয়তো তোকে বুঝতে পারিনি আমাদের ভুল হয়ে গেছে আমাদের মাফ করে দে।
- এনি মা আই এম সরি আমাদের মাফ করে দাও।( বাবা)
- এত বছর একবার আমার খোঁজ নিয়েছ জানতে চেয়েছ বেঁচে আছি না মরে গেছি।
- তুই ও তো কখনো যোগাযোগ করিসনি কীভাবে জানব বল। যা হয়েছে সব ভুলে যা মা এখন তুইও মা হয়েছিস আমাদের কষ্টটা তো বুঝিস।
- দেখ এনি মা, মা বাবা মাফ চাইছে তারা ভুল বুঝতে পেরেছে মাফ করে তাদের বুকে জড়িয়ে নে।( শ্বশুড়ি)
- ওকে যাও আমি তোমাদের মাফ করে দিয়েছি।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুসময় পর ডাক্তার এসে জানালেন আমার বেবীরা এখন অনেকটা সুস্থ ওদের এখন আমার কাছে নিয়ে আসতে পারে। মা আর শ্বাশুড়ি মা গেলেন বেবীদের নিয়ে আসতে। সাগর রাউন্ডে গিয়েছিল কিছুসময় পর সেও চলে আসল। মা দুইটা বেবীকে এনে আমার দুই পাশে রাখলেন।
আমার মেয়েটা একদম আমার চেহারা পেয়েছে। মেয়েটার চোখদুটো তার বাবার মতোই নীল। ছেলেটা চেহারা পেয়েছে তার বাবার মতো আর চোখ দুটোও হয়েছে বাবার মতো। সাগর ওদের দেখে ভীষণ খুশি হলো। মা মেয়েকে তার কোলে তুলে দিল। মেয়েকে কোলে নিয়ে সাগর মেয়ের নাম দিল নীলা। আব্বার কোলে আমার ছেলেকে তুলে দিল। আব্বা ছেলের নাম রাখলেন নিরব।
কিছুদিন পর আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। এখন আমার জীবনের সব দুরত্ব কেটে গেছে। আমার মা শ্বাশুড়ি আর ছোট ভাইয়ের সারাদিন কাটে নীলা আর নিরবকে নিয়ে। সন্ধ্যার পর বাবা আর সাগর ওদের নিয়ে খেলে। আমার ভীষণ ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আমার হিংসে হয় তখন আমি সবাইকে বলি, আমাকে সবাই ভুলেই গেছ আমি আর থেকে কী করব চলেই যাই। তখন সবাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আর বলে, তুইতো আমাদের সব। আমার তখন ভীষণ ভালোলাগে।
সাগরের মতো স্বামী সোনিয়া আন্টির মতো শ্বাশুড়ি, নীলা আর নীরবের মতো মিষ্টি দুটো সন্তান, আর বাবা মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি। জীবনে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।
,,,সমাপ্ত,,,
© bnbooks.blogspot.com