অনার্সে পড়া অবস্থায় বাবা হুট করে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। পাত্র হিসেবে বাবার বন্ধুর ছেলেকে উনার ভীষণ পছন্দ কিন্তু আমি বাবাকে বললাম আমি পড়াশোনা করতে চাই। বাবার একটাই কথা বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যাবে। আমি বাবাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলামনা। এরপর মা, বড় আম্মা নানু সবাইকে বললাম কিন্তু সবারই একি কথা। আমার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল। সৌরভ ভাইকে কোনদিনও আমার ভালোলাগতো না তার চাল চলন কথাবার্তা কোনটাই আমার পছন্দ ছিলনা। তবুও বাবা মা এমন তোড়জোড় শুরু করল যেন এর থেকে ভালো ছেলে আমার জন্য আর পাওয়া যাবেনা।
বাড়িতে বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। আমার আপন বলতে ছিল আমার ছোট ভাই। বিয়ের আগের দিন রাতে আমি ছাদে একা একা বসে খুব কাঁদছিলাম। আমার ছোট ভাই আমার পাশে এসে বসল। আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নিজের চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম।
- আপু তুমি কী এই বিয়েতে খুশি।
- তোর কী তাই মনে হয়।
- আপু তোমার সারাজীবনের সিদ্ধান্ত বাবা মা এভাবে নিতে পারেনা। আমার কথা শোন তুমি পালিয়ে যাও।
- কী পাগলের মতো বলছিস বলতো পালিয়ে কই যাব এই শহরে আমাকে কে আশ্রয় দিবে খাব কী থাকব কোথায়?
- আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তাছাড়াও তোমার বিয়ের সব গহনা আর টাকা মায়ের আলমারিতে রাখা আছে। আমি সব এনে দিচ্ছি তুমি পালিয়ে যাও।
- নারে তা হয়না। আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে তুই শুধু শুধু এগুলো নিয়ে ভাবিসনা।
- ভাগ্যের দোষ দিওনা। এখন যদি সাহস করে না যাও তাহলে সারাজীবন তোমার আফসোস করতে হবে।
- বাড়ি ভর্তি মানুষ আমি যাব কীভাবে?
- আমি সেই ব্যবস্থা করছি। তুমি ঘরে গিয়ে সব গুছিয়ে নাও আমি ১ টায় তোমার রুমে আসব।
ছোট ভাইটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। দুনিয়ায় এই একটা মানুষ আমার সবচেয়ে আপন। আমার দুঃখ গুলো ও ছাড়া আর কেউ বোঝেনা।
আমি ঘরে এসে নিজের প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিলাম। আমার জমানো কিছু টাকা ছিল। শুভ মায়ের আলমারি থেকে প্রায় ১ লক্ষ টাকা আর বিয়ের সব গহনা এনে আমার হাতে তুলে দিল। ও আমাকে ওর এক বন্ধুর বাসার ঠিকানা দিল। ওর বন্ধুর পরিবার গ্রামে গেছে ও আমাকে রাতটা ওখানে কাটিয়ে সকালে কোন একটা বাসা দেখে উঠে যেতে বললো। আমার ব্যাগটা ও সবার চোখের আড়ালে বাসার নিচে নিয়ে চলে গেল। একটা সিএনজি ডেকে ও আমাকে কল দিল। আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নিচে নেমে গেলাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। যাওয়ার আগে ও আমাকে বলে দিল নিজের পায়ে দাড়িয়ে নিজেকে প্রমাণ করে যেন ফিরে আসি। কখনো যেন কারো জন্য নিজেকে কষ্ট না দেই।
ওর কথাশুনে আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে লাগলো। ছোট ভাইটা একদিনে কত বড় হয়ে গেছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু খেলাম। ও আমাকে সিএনজি তে উঠিয়ে বলল কেউ টের পাওয়ায় আগেই চলে যেতে।
জীবনে এই প্রথম আমি নিজের জন্য কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেদিন রাতটা ওর বন্ধুর বাসায় ওর বন্ধুর বড় বোনের সাথে ছিলাম। পরদিন একটা লেডিস হোস্টেলে উঠে যাই।
বাবা মা সকালে উঠে বুঝতে পারি আমি পালিয়েছি। সেদিন রাগে বাবা সবাইকে বলে দেন আমি মরে গেছি। এনি নামে তাদের কোন সন্তান নেই। সেদিনের পর আর কোনদিন বাবা মা আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। আমি বেচে আছি না মরে গেছি তাও জানতে চায়নি। ছোট ভাইটা মাঝে মাঝে কল দিত ওকেও নিষিধ করে দিয়েছি। ওকেও বাবা মায়ের মতো মেনে নিতে বলেছি যে আমি মরে গেছি। নিজের ফোন নাম্বার ফেসবুক আইডি সব পাল্টে ফেলেছি। একটা ফেক আইডি দিয়ে মাঝে মাঝে ছোট ভাইয়ের আইডিটা ঘুরে দেখি। ওরা আমাকে ভুলে গেলেও কেন যেন আমি এখনো ওদের ভুলতে পারিনি।
এই ঢাকা শহরে একা একটা মেয়ের পথ চলা যে কতটা কঠিন তা আমি প্রতি পদেপদে টের পেয়েছি। এত কঠিন বাস্তবতা দেখেছি যে এখনও মনে হলে গায়ে কাটা দেয়। জীবিকার তাগিদে টিউশনি করেছি, ছোটখাটো চাকরি করেছি। জীবনে অনেক স্ট্রাগল করেছি। অবশেষে অনার্স শেষ করার পর একটা নিউজ চ্যানেলে চাকরি পেয়ে যাই। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
পিয়া আপুর আজ গায়ে হলুদ। আপুকে হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনায় দারুণ লাগছে। আপুর বাড়ির সবাই আপুর গায়ে হলুদ ছোঁয়াল। আমিও আপুর গায়ে হলুদ দিলাম। আদিল ভাইয়ের বাড়ি থেকে লোক এসে আপুর গায়ে হলুদ দিয়ে গেল। হলুদ শেষে সবাই মেহেদী দিতে বসলাম। সব কিছুর ভীড়ে নিজেকে খুশি রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। মেহেদী পড়ার পর সবাই ছাদে উঠে অনেক মজা করলাম। সময়গুলো বেশ ভালোই কাটছিল।
পরদিন সকাল থেকেই আপুর বিয়ের সব আয়োজন শুরু হলো। আপুকে লাল বেনারসি তে সাজানো হল। আপুকে খুব সুন্দর লাগছিল। দুপুরে বরযাত্রী আসল। খাওয়া দাওয়া শেষে আপু আর আদিল ভাইয়ের বিয়ে পড়ানো হল। আমি পিয়া আপুর সাথেই ছিলাম। বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা সবাই খেতে গেলাম। আমরা খাওয়া শেষ করলাম। হাত ধুয়ে আসার পরেই আমার চোখ পড়লো ডক্টর সাগরের দিকে। উনি এগিয়ে আমার কাছে আসলেন। আমি একটা টিস্যু নিয়ে হাত মুছলাম। এই লোকটাকে আমার ভীষণ চেনাচেনা লাগে কিন্তু সবসময় মনে হয় এভয়েড করে যাই।
সাগর সাহেব আমার পাশে এসে দাড়ালেন।
- কেমন আছেন?
- ভালো, আপনি?
- ভালো। আপনি কখন এসেছেন?
- গতকাল।
- ওহ আচ্ছা। আপনাকে শাড়ি পড়লে ভীষণ সুন্দর লাগে।
- ধন্যবাদ।
হঠাৎ শোভা আপু ডাক দিল। আমি সাগর সাহেবকে বায় বলে চলে আসলাম। শোভা আপু আর সাহারা আপু উনাদের এক কলিগ এসেছে তার সাথে যাবেন। আমি উনাদের বললাম আমি একাই যেতে পারব। উনারা চলে গেলেন। পিয়া আপুরও বিদায় বেলা উপস্থিত। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে পিয়া আপুকে বিদায় দেওয়া হলো। আপু আর আদিল ভাই গাড়িতে উঠে বসলেন। আন্টি আমাকে সাগর সাহেবের সাথে যেতে বলল। উপায় না দেখে আমি সাগর সাহেবের গাড়িতে উঠে বসলাম। এক এক করে সব গাড়ি চলতে শুরু করলো।
রোডে সিগনাল থাকায় আমরা শর্টকাট ধরে এগোতে লাগলাম। আমি গাড়ির গ্লাস নিচে নামিয়ে দিলাম। আকাশ মেঘলা বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বাইরের শীতল হাওয়ায় আমার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবুও আমার ভীষণ ভালোলাগছে। রেডিওতে গান বাজছে এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সাগর সাহেব আর আমি দুজনেই চুপচাপ। সাগর সাহেব মাঝেমাঝে আড় চোখে আমাকে দেখছেন। বিষয়টা আমি বুঝতে পারলেও না বোঝার মতো করেই এড়িয়ে যাচ্ছি।
- এনি if u don’t mind সামনে একটা নদী আছে আমরা কী সেখানে গিয়ে কিছুসময় বসতে পারি?
- আমার নদী ভালোলাগে সো যাওয়া যায় আমার কোন সমস্যা নেই।
সাগর সাহেব আমার উত্তর শুনে খুশি হয়েছেন। কিছুটা সামনে গিয়ে উনি গাড়িটা বামদিকে নামিয়ে দিলেন। কাঁচা রাস্তা হওয়ায় প্রচুর ধুলোবালি উড়তে লাগল। আমি গ্লাস তুলে দিলাম। সাগর সাহেব নদীর পাড়ে এসে গাড়ি থামাল। আমি গাড়ি থেকে নামলাম।
জায়গাটা বেশ সুন্দর চারপাশে অনেক কাপল বসে আছে। নদীর পার ঘেঁষে দু একটা ফুচকার দোকান গড়ে উঠেছে। বাদাম ওয়ালা বাদাম ফেরি করে বেড়াচ্ছে। অনেকে আবার ফুল বিক্রি করছে। এসব দেখতে ভালোই লাগছিল।
আমি কিছুটা হেটে নদীর বাঁধের উপর গিয়ে দাড়ালাম। সাগর সাহেব আমার পাশে এসে দাঁড়াল। বাতাসে আমার চুল আবার এলোমেলো হওয়া শুরু করলো। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে চারপাশে। পরিবেশটা এক দারুণ ভালোলাগার সৃষ্টি করছে।
-আচ্ছা এনি আপনি মিথ্যা বললেন কেন?
- আমি আপনাকে কোন মিথ্যা বলেছি বলেত আমার মনে পড়ছেনা।
- আপনার পরিবার থাকতেও আপনি নিজেকে এতিম বললেন কেন?
সাগর সাহেবের কথায় আমি বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। কারণ তার সাথে আমার পরিচয় মাত্র কিছুদিনের এর মধ্যে আমি তাকে কখনোই আমার পরিবারের কথা বলেছি বলে তো আমার মনে পড়েনা। তাছাড়া যেখানে আদিল ভাই আমার ব্যাপারে কিছুই জানেনা সেখানে সাগর সাহেবের তো জানার প্রশ্নই উঠেনা।
- আপনাকে কে বলল যে আমার পরিবার আছে?
- আমি জানি, তুমি আজাদ আর বিনীতা আন্টির মেয়ে এনি।
আপনি কীভাবে জানলেন?
চলবে,,
© bnbooks.blogspot.com