আমার জীবনে কোন আনন্দের স্মৃতি আছে বলে আমার মনে হয়না। আমার বাবা মা কে ভীষণ ভালোবাসত। আমার জন্মের পর মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে তাই বাবা আমার ৫ দিন বয়সেই আমাকে বড় খালার কোলে তুলে দেয়।৷ বড় খালার অবস্থাও তখন ভালোছিলনা। ডিভোর্সের পর উনার মেয়ের দায়িত্ব উনার স্বামী পায় যার কারণে মেয়ের শোকে উনি তখন পাগল প্রায়। বাবা আমাকে উনার কোলে তুলে দেওয়ার পর ধীরে ধীরে উনি স্বাভাবিক হওয়া শুরু করে। আম্মুর অসুস্থতার জন্য বাবাও আমাকে আর আনতে চায়নি তবে তারা মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে যেত। আমার শৈশব কেটেছে বড় আম্মার কাছে। আমি জানতাম উনিই আমার মা। আমার আসল মা কে আমি খালা বলেই জানতাম। আমার বয়স যখন ৮ বছর তখন হুট করেই নানা বড় আম্মার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। আমাকে তখন আমার আসল মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বড় আম্মা কিছুতেই বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু নানার জোরাজোরিতে অবশেষে বাধ্য হয়েই তাকে বিয়ে করতে হয়।
বিয়ের দিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম বড় আম্মাও অনেক কেঁদেছিল। আম্মা চলে যাবার পর আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ি আমার মা তখন আমাকে তার কাছে ঢাকা নিয়ে আসে। জীবনের এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। আমার বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা যার কারণে আমার ছোটবেলা থেকেই কোন অভাব ছিলনা। কিন্তু আমি আমার নিজের মায়ের মধ্যে বড় আম্মাকে খুজে পেতামনা। বড় আম্মা আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিত, গোসল করিয়ে দিত, নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে ঘুম পাড়াত। আমার মা আমাকে অনেক দামীদামী খাবার দিত কিন্তু কখনো মুখে তুলে খাইয়ে দিত না, আমাকে অনেক খেলনা কিনে দিত কিন্তু আমার সেগুলো ভালোলাগতো না। আমাকে বিশাল একটা ঘর দিয়েছিল তাতে অনেক দামী আসবাবপত্র ও দামী খেলনা ছিল কিন্তু আমাকে কেউ বুকে জড়িয়ে ঘুমাত না। আমার ভীষণ খারাপ লাগত। আমি ছোটছিলাম এসবের হিসেব মেলাতে পারতামনা। আমার ভীষণ একা একা লাগত খুব কান্না পেত। একা একা খুব কাঁদতাম, কিন্তু কেউ আমাকে শান্তনা দিতনা সেরকম ভালোওবাসতো না।
বড় আম্মা সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে কথা বলত ফোনে। আমার শৈশব এসব হিসেব মেলাতে মেলাতেই পার হয়ে যায়। আমি কারো সাথেই আমার সেই কেটে যাওয়া সুর আর মেলাতে পারিনি। ছোটবেলায় একজনকে মা হিসেবে গ্রহণ করার পর যদি তার কিছু বছর পর তাকে বলা হয় এটা তোমার মা নয় অন্য একজন তোমার মা তাদের সাথে তোমার সম্পর্ক ইনি তোমার কেউ না। তখন একটা শিশুর মানসিক অবস্থা কেমন হয় তা আমি জানি।
ফোনে হঠাৎ করেই কল বেজে উঠলো। আমি কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসলাম। পিয়া আপুর আম্মা কল দিয়েছে। আপুকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। আমি সোজা সেখানে চলে গেলাম। আপুকে দেখে আন্টির সাথে টুকটাক কথা সারলাম। আন্টিকে অনেকবার বাসায় আসার কথা বললাম কিন্তু তিনি রাজি হলেন না।
ঢাকা শহরটা অনেকটাই ফাঁকা। ঈদের আগে সবাই মোটামুটি গ্রামে চলে গেছে। অনেকেই পশু কিনে ফিরছে। হসপিটাল থেকে বের হয়ে একটা সুপারশপে ঢুকে টুকটাক বাজার সেরে নিলাম। আসলে একা মানুষের ঈদ হয়না তবুও ঈদের পর দুই তিনদিন ভালোকিছু পাওয়া যায়না তাই আগে থেকেই কেনাকাটা শেষ করলাম। শপ থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাসায় আসলাম।
পুরো বাসায় আমি একা। যদিও একা থাকাটা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে তবুও আজ একটু বেশিই একা একা লাগছে। ফ্রিজে থাকা খাবার গরম করে খেয়ে নিলাম। ঘুম আসছেনা তাই এককাপ কফি বানিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলাম। আকাশের চাঁদটা বারবার মেঘের আড়ালে মুখ লুকাচ্ছে। ওদের লুকোচুরি দেখতে দারুণ লাগছে।
ফোনটা বের করে অন করতেই চোখে পড়লো ছোটভাইয়ের পোস্ট। কোরবানির জন্য বাবা বিশাল একটা গরু কিনেছে। আচ্ছা ওদের কী আমার কথা মনে পড়েনা? একবার তো তারা আমাকে ডাকতে পারে? যতযাই হয়ে যাক আমিতো তাদেরই সন্তান।
নাহ্ আমি কাঁদব না তারা আমাকে এতিম বানাতে পারলে আমিও এতিমের মতো বাঁচতে পারব।
সারারাত আমার নির্ঘুম কাটল। সকালের দিকে চোখটা লেগে আসলো। আন্টির কল পেয়ে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি ১ টা বাজে। বাড়িওয়ালি আন্টি উনার বাসায় যাওয়ার জন্য কল দিচ্ছেন। আমি উঠে গোসল সেরে তৈরি হয়ে উনার বাসায় গেলাম। আন্টি নানারকম নাস্তা দিল খাওয়ার জন্য। আমি উনার বড় মেয়ের সাথে গল্প করতে করতে অল্প করে নাস্তা শেষ করলাম। নাস্তা শেষে আন্টি টেবিলে খাবার দিলেন। উনার পুরো পরিবারের সাথে বসে আমাকে খেতে হবে, আন্টি আমাকে জোর করে বেশি বেশি করে খাওয়ালেন।
আন্টির বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে হসপিটালে আসলাম। আজ ঈদের দিন আর পিয়া আপুর এই অবস্থা। উনার মা ভীষণ ভেঙে পড়েছেন। তবে পিয়া আপু আগের চাইতে এখন অনেকটা ভালো। পিয়া আপুর ছোট ভাই পিয়াস আর আদিল ভাই আছেন। পিয়া আপুর আম্মু সকালে বাসায় গেছেন। আমি গিয়ে ওদের সাথে বসলাম।
- এনি তুই যদি সময়মতো না আসতি তাহলে হয়তো মরেই যেতাম।
- আরে আপু কী যে বলনা। আচ্ছা তুমি এত রাতে ডাইনিংয়ে কী করছিলে?
- আর বলিসনা পানি খেতে উঠেছিলাম। কে জানত যে ফ্লোরে পানি পরে আছে অল্প আলোয় ভালো বুঝতেও পারিনি স্লিপ খেয়ে
পড়েই তো এই বিপত্তি টা ঘটলো।
- যাই হোক নেক্সট টাইম সাবধানে থাকবে ওকে।
- ওকে। তা তুই কিছু খেয়েছিস?
- হুমম বাড়িওয়ালি আন্টির বাসায় দাওয়াত ছিল।
- যাক ভালো করেছিস।
- আরে আমাকেও তো বলার সুযোগ দাও।
- জ্বী আদিল ভাই বলেন।
- আগামী মাসের কোন এক শুক্রবার বিয়েটা সেরে নিতে চাইছি তোমরা কী বল।
- হুমম ভালোই হয়। আন্টি আঙ্কেল যদি রাজি থাকে তাহলে সমস্যা নেই।
- আমার বাসায় কোন সমস্যা নেই আর পিয়ার আম্মা আসলে বাকি কথাটা সেরে নিচ্ছি।
- ওকে।
কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে আসল। ৭ টার দিকে সাগর সাহেব এসে পিয়াকে দেখে গেলেন। আজ তিনি কালো একটা পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। আসলে সুন্দর মানুষকে সব কিছুতেই ভালোলাগে তবে উনাকে যেন একটু বেশিই ভালোলাগছে। আমি জীবনে কোনদিন কোন পুরুষ মানুষকে এত খুটিয়ে দেখিনি যতটা ডক্টর সাগর চৌধুরীকে দেখছি। উনার ওই নীল চোখ দেখলে আমার বরাবরই ওই চোখের প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে। উনার ওই চোখ জোড়া দেখলে মনে হয় কতদিনের যেন চেনা।
ছিঃ ছিঃ এসব কী ভাবছি ভেবেই আমি অন্যদিকে ঘুরে গেলাম। সাগর সাহেব পিয়াকে দেখে চলে গেলেন। আদিল ভাই উনার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলেন।
রাতে পিয়ার আম্মা আসার পর আমি বাসায় চলে আসলাম। ৩ দিন পর পিয়াকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হলো। ওর মা ওকে বাসায় নিয়ে গেল। আগামী মাসের ৭ তারিখ ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি আমার মতো কাজে যোগ দিলাম। সবকিছু আবার আগের মতো হতে লাগলো।
অফিসের কাজ শেষ করে বের হতে হতে ১১ টা বেজে গেল। একা একা উবারে যেতে ইচ্ছে করছেনা তাই দাড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুসময় পর আমার সামনে একটা কালো গাড়ি এসে থামলো। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিতেই চোখ পড়লো ড্রাইভিং সিটে। ডক্টর সাগর চৌধুরী ড্রাইভিং সিটে বসা। তিনি জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাব। আমি উনাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও উনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন আমি তাকে ভরসা করতে পারি। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। উনি গাড়ি চালাতে লাগলেন। রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা এরকম রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। আমি চুপচাপ থাকলেও উনিই নিরবতা ভাঙলেন
- তা আপনি কী এত রাত পর্যন্ত কাজ করেন?
- নাহ্ তবে মাঝে মাঝে একটু লেট হয়ে যায়। তা আপনি এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?
- বাসায় ফিরছিলাম।
- আপনার বাসা কোথায়?
- মোহাম্মদপুর। আর আপনি কোথায় থাকেন?
- আমি ধানমন্ডিতে থাকি।
- ওহ আচ্ছা। তা আদিল আর পিয়ার বিয়েত আগামী মাসের ৭ তারিখ আপনি যাচ্ছেন তো?
- না গিয়ে আর তো উপায় নেই সো যেতেই হবে। আপনি থাকবেন তো?
- জ্বী থাকব।
কথায় কথায় আমি বাসার সামনে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নেমে সাগর সাহেবকে বিদায় দিলাম। উনি চলে গেলেন। বাসায় এখন আর আমি একা নই। পিয়া আপু না থাকলেও অন্য দুই আপু আছে। তারা দুজনেই ব্যাংক কর্মকর্তা। রাতে বাসায় ফিরে আমরা তিনজন খাবার খেয়ে একসাথে আড্ডা দেই আমাদের মধ্যে অজানা এক বন্ধন গড়ে উঠেছে।
পিয়া আপুর বিয়ে উপলক্ষে আমরা সবাই ৫ তারিখ থেকে চারদিনের ছুটি নিলাম। ৫ তারিখ সকালেই আমারা সবাই পিয়া আপুদের বাসায় পৌঁছে গেলাম। আপুদের বাসায় অনেক মেহমান। সবাই আপুর বিয়ে উপলক্ষে এসেছে।
গত ৪ বছরে এই প্রথম আমি কোন বিয়ে বাড়িতে আসলাম। আসলে বিয়ে বাড়ি দেখলে আমার ভয় হয়। সেই ভয়ংকর বাস্তবতা গুলো এক এক করে চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
চলবে,,