মাঝ রাতে গোঙানির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভয়ে ভয়ে উঠে রুমের লাইট অন করলাম। শব্দটা ধীরে ধীরে আরও বাড়তে লাগলো। ঈদের ছুটিতে সবাই যে যার বাড়িতে চলে গেছে। বাসায় আছি বলতে আমি আর পিয়া আপু। সাহারা আর শোভা আপু গতকালই বাড়ি চলে গেছে। পিয়া আপু আমার রুমমেট। উনিও বাসায় আছে কাল বাড়ি যাওয়ার কথা উনার। কিন্তু রুমে কোথাও উনাকে পেলামনা। ভয়ে ভয়ে ডাইনিংয়ের দিকে পা বাড়ালাম। ডাইনিংয়ে এসে যা দেখলাম তাতে ভয়ে আমার গা হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছিল।
পুরো ফ্লোর পানিতে ভেসে যাচ্ছে সেই পানির সাথে রক্ত মিশে পুরো ঘরে ভয়ংকর এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পিয়া আপুই মেঝেতে পরে গোঙাচ্ছিল। মেঝেতে থাকা পানিতে পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে উনার মাথা ফেটে গেছে। উনার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আর সেই রক্তেই পুরো ঘর মাখামাখি। আমি কী করব না করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলামনা। গায়ে থাকা ওড়নাটা খুলে উনার মাথায় চেপে ধরলাম। রাত বাজে ৩ টা এত রাতে কাকে ডাকব কী করব ভেবে পাচ্ছিলামনা। ৯৯৯ এ কল দিতেই এ্যাম্বুলেন্স চলে আসলো। আমি কোনমতো নিজের পার্সটা নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়লাম।
কিছুসময় পর একটা হসপিটালের সামনে এসে এ্যাম্বুলেন্স থামল। পিয়া আপুকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেল। এখানেও ঘটলো বিপত্তি, হসপিটালের খরচের টাকা পুরোটা ক্যাশ নেই আমার কাছে আমি উনাদের বললাম কার্ডে পেমেন্ট করে দিচ্ছি কিন্তু এখানেও অদ্ভুত কথা এত বড় হসপিটাল তাদের নাকি কার্ড পেমেন্ট সিস্টেম নেই শুনে মেজাজ গেল আরও খারাপ। এক কথা দুই কথায় রিসিপশনের সেই লোকের সাথে বেঁধে গেল তুমুল ঝগড়া এক পর্যায় ইমারজেন্সীতে থাকা ডাক্তার সব শুনে নিজে দায়িত্ব নিয়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করল। আমি পিয়া আপুর আম্মা আর ছোটভাইকে কল দিয়ে সমস্ত কিছু জানিয়ে দিলাম। উনারা রওয়ানা করেছে কিছু সময়ের মধ্যে পোঁছে যাবেন।
পিয়া আপুকে ওটিতে নেওয়া হলো উনার মাথায় সেলাই দেওয়া হল। এরপর রক্ত দেওয়া হলো। ওটি শেষ করে উনাকে আইসিইউতে দেওয়া হলো। মাথা থেকে বেশ রক্ত বের হয়েছে আর অনেকটা কেটে গেছে তাই ডাক্তাররা এখনি উনার ব্যাপারে সঠিক মতামত দিতে পারছেননা। ২৪ ঘন্টা পর উনারা একটা মতামত দিতে পারবেন বলে জানালেন।
আমি ওটির বাইরে বসে আছি আমার পুরো জামা রক্তে মেখে গেছে তাছাড়াও হাতে মুখে রক্ত লেগে আছে। এরকম পরিস্থিতিতে আসলে নিজের খেয়াল রাখা যায় না। পিয়া আপুকে আমি বড় বোনের মতো দেখি তাই উনার জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল।
ভোরে একজন ওয়ার্ড বয় এসে এককাপ চা দিয়ে গেল। আমি বেশ অবাক হলাম তবুও প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিল তাই নিষেধ করলামনা তার কাছ থেকে চায়ের কাপটা নিলাম। টাকা দিতে চাইলাম কিন্তু সে নিলনা। চা শেষ করে কাল ইমারজেন্সিতে থাকা ডাক্তারকে খুজতে লাগলাম। নার্স বললেন উনি চেম্বারে আছেন। আমি গিয়ে চেম্বারের দরজায় নক করলাম উনি আমাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ভেতরে ঢোকার পর উনি আমাকে বসতে বললেন। আমি উনার সামনে থাকা চেয়ারটা টেনে বসলাম। উনার টেবিলে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলাম উনার নাম ডক্টর সাগর চৌধুরী। বয়স খুব বেশি হবে বলে মনে হয়না। মাথায় ঘন কালো চুল গায়ের রং ফর্সা মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি তবে উনার নামের সাথে উনার চোখের বেশ মিল আছে। গাড়ো নীল চোখ, আমি খুব কম মানুষ দেখেছি যাদের চোখ নীল হয়।
- আপনাকে অনেক ধন্যবাদ রাতে আপনি যদি হেল্প না করতেন অনেক বড় বিপদে পড়ে যেতাম।
- এটা আমাদের দায়িত্ব।
- আচ্ছা প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড আপনাকে আমার বেশ চেনাচেনা লাগছে কেন বলুনতো?
- তাতো আমি বলতে পারবনা। তবে আপনাকে আমি দেখেছি আপনি নিউজ রিপোর্টার এনি আমি কী ঠিক বলেছি?
- জ্বী আমিই এনি।
- যাই হোক চিন্তা করবেননা আপনার রোগীর তেমন কিছু হবেনা তবে কিছুদিন সময় লাগবে ঠিক হতে।
- ওকে থ্যাংকস ওয়ানস এগেইন। বাট আপনাদের কার্ডে পেমেন্ট সিস্টেম রাখা উচিত কারণ এই যুগে সবাই ক্যাশ সাথে রাখেনা সো এরকম পরিস্থিতিতে সত্যিই খুব হেনস্তা হতে হয় তাই এই সিস্টেমটা আপনাদের চালু করা উচিত।
- হুমম তা ঠিক আমি এই বিষয় নিয়ে অবশ্যই কথা বলব।
- ধন্যবাদ। আমি এখন উঠি তাহলে।
- জ্বী অবশ্যই।
ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে মনে মনে ভাবছি ডাক্তার সাগরকে আমার ভীষণ চেনা চেনা লাগছে তবে উনাকে কোথায় দেখেছি তা ঠিক মনে করতে পারছিনা।
পিয়া আপুর মা আর ছোট ভাই চলে এসেছে। উনাদের বসিয়ে রেখে আমি বাসায় আসলাম। সারা গায়ে রক্ত লেগে আছে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে এগুলো দেখে। বাসায় ঢুকার আগেই বুয়া খালাকে কল দিলাম। পুরো বাসার ফ্লোরে রক্ত মেখে আছে এগুলো দেখলে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাব। বুয়া খালা আসার পর উনাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে আমি সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। গোসল সেরে বের হয়ে দেখলাম বুয়া খালার কাজ শেষ। কাল ঈদ তাই বুয়া খালা জানতে চাইল আমি বাসায় থাকব কিনা। আমি উনাকে বললাম আমি বাসায় থাকব তবে উনার আসার প্রয়োজন নেই। সব কাজ শেষ করার পর উনাকে ২০০ টাকা বখশিশ দিলাম উনি খুশি হয়ে চলে গেলেন।
গত ৪ বছরে আমার জীবন থেকে ঈদ আনন্দ এই জিনিসগুলো হারিয়ে গেছে। একা একা নিজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে আছি। একলা পথ চলাটা আমি শিখে গেছি। বাড়ির মালিকের স্ত্রী এসে আমাকে কাল উনার বাসায় দাওয়াত দিয়ে গেছেন। আন্টি আমাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। পিয়া আপুর কথা শুনে উনিও কষ্ট পেয়েছেন উনি আমাকে বলে গেলেন সন্ধায় পিয়া আপুকে দেখতে যাবেন। আমি একটু রেস্ট নিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা করলাম।
আইসিইউ এর বাইরে পিয়া আপুর মা আর আদিল ভাই বসে আছেন। আদিল ভাই পিয়া আপুর হবু স্বামী। আদিল ভাই আমাকে দেখে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। আমি কাল রাতের ঘটনা সম্পূর্ণ উনাকে বললাম। আন্টিকে আমি বাসায় যাওয়ার কথা বললেও তিনি মেয়েকে রেখে যেতে নারাজ।
সন্ধ্যায় আদিল ভাই আর আমি হসপিটালের বাইরে একটা কেন্টিনে বসে কফি খাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো দরজার দিকে ডক্টর সাগর কেন্টিনে ঢুকলেন। আদিল ভাই উঠে উনার কাছে গিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। ডক্টর সাগর আমাদের সাথে বসল। আদিল ভাই আমাকে উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাগর সাহেব আদিল ভাইয়ের অনেক পুরনো বন্ধু। উনারা কথা বলছিলেন আমি উঠতে চাইলেও আদিল ভাই উঠতে দিচ্ছিলেননা। আমি উনাদের মাঝে বোর হচ্ছিলাম। সাগর সাহেব জানালেন পিয়ার জ্ঞান ফিরেছে সে এখন বিপদমুক্ত। কথাটা শুনে আদিল ভাই বেশ খুশি হলো। ফরমালিটি রক্ষা করতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনাদের সাথে আমার কথা বলতে হচ্ছিল। এক পর্যায় আদিল ভাই আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন আমি ঈদে বাসায় যাব কি না? উনার প্রশ্নটা আমার বুকে তীরের মতো বিধলো। চোখের কোণে জলেরা উঁকি দিল। নিজেকে সামলে নিয়ে আদিল ভাইকে বললাম আমি এতিম।
আমি একমুহূর্তও দেরী না করে উঠে চলে আসলাম। কীভাবে এত বড় কথাটা বলে ফেললাম। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম সত্যিই কী আমি এতিম?
চলবে,,
© bnbooks.blogspot.com