আহমদ ছফা - পরিচিতি
আহমদ ছফা (জুন ৩০, ১৯৪৩- জুলাই ২৮, ২০০১) একজন বাংলাদেশীলেখক, কবি ও সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর লেখায় বাংলাদেশী জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদকলাভ করেন। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী, নিমোর্হ, অকপট দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বুদ্ধিজীবি মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন।
জন্ম
তাঁর জন্ম ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন চট্টগ্রামেরচন্দনাইশ উপজেলারহাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতা মরহুম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
শিক্ষা
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬০খ্রিস্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনেরবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েবাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমীর পিএইচডিগবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্তশ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
পরে ১৯৮৬-তে জার্মানভাষার ওপর গ্যোটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যে জ্ঞান তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্টঅনুবাদে সাহস জুগিয়েছিল।
সাহিত্য
তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনীমিলিয়ে তিরিশটির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ একটি উপন্যাস- সূর্য তুমি সাথী। প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ জাগ্রত বাংলাদেশ। প্রকাশকাল শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। সাতই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক গণকণ্ঠ ধারাবাহিকভাবে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনা প্রকাশ করেন। এর কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাঁকে। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশ পায়। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। বাংলা একাডেমী থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ।
ছফা মহাকবি গ্যোতের ফাউস্টঅনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে । মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে । ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র। স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতির গোপন-রহস্য, শৌর্য মৃত্যু ও কপটতার গীতিকা এই উপন্যাস।১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ এবং অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী প্রকাশিত হয়। ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ পূর্বে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রাণপূর্ণিমার চান নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। জাপানী ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে । পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তাঁর এই উপন্যাসে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ।
তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে আহমদ ছফা রচনাবলি দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পায়। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছেন।