চাঁদটা ভেসে বেড়াচ্ছে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ।
প্রচন্ড গরম পড়েছে ।
গাছের একটা পাতাও নড়ছে না ।
রনি ঘর থেকে বের হয়ে মাঠের এক কোণে এসে দাঁড়ালো ।
মাঠের মাঝখানে বিশাল এক বটগাছ ।
বহু বছরের পুরানো বটগাছটি কালের সাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ।
বটগাছের পাশেই পুরানো ভাঙ্গাচুরা একতলা একটা ইটের বাড়ি বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ।
গ্রামের একদিকটায় মানুষজনের আনাগোণা কম ।
হালকা চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে ।
হঠাৎ রনি দেখলো একজন বৃদ্ধলোক কাঁধে ঝোলা নিয়ে বটগাছের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ।
ও ভাবলো এত রাতে এই লোকটি ঝোলা কাঁধে করে কোথায় যাচ্ছে !!
রনি চুপিসারে লোকটার পিছনে হাঁটতে লাগলো ।
লোকটা বটগাছটা পেরিয়ে ভাঙ্গা ইটের বাড়িতে ঢুকলো ।
রনি বাহির থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো লোকটা ঝোলা থেকে কিছু মুক্তো ,
হীরা বের করছে । আবছা আলোতে ওগুলো চকচক করছে ।
রনি পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকলো ।
তখনই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ভাঙ্গা দরজাটা নিজে নিজেই আটকে গেল ।
পরদিন সকাল ।
পুব আকাশে সূর্যটা রাতের অন্ধকার দূর করে উদিত হল ।
হারু মাঠে আসলো ওর গরুকে ঘাস খাওয়াতে ।
ও-ই প্রথম দেখলো বটগাছে রনির ঝুলন্ত লাশটা ।
চোখদুটো খোলা ;
দেখে মনে হচ্ছে এমন কিছু দেখেছে যার ভয় এখনও কাটে নি ওর।
হারুর চিৎকারে গ্রামবাসীরা এসে জড়ো হল ।
রনির লাশ দাফন করা হল ।
পরের এক সপ্তাহ গ্রামের সবার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল রনির মৃত্যু ।
কিন্তু এত কিছুর পরও রনির অদ্ভুত মৃত্যুর রহস্য কেউ জানতে পারলো না ।
ছয় মাস পরের কথা ।
জহির মাছ ধরে নদী থেকে গভীর রাতে বাড়ি ফিরছিলো ।
বটগাছের কাছে আসতেই ও দেখলো একজন বৃদ্ধলোক বেশ কিছু স্বর্ণ নিয়ে বসে আছে ।
জহির খুব অবাক হল ।
এত রাতে এই লোক স্বর্ণ নিয়ে এখানে বসে আছে কেন !!
ও এগিয়ে যেতেই লোকটা স্বর্ণগুলো নিয়ে ভাঙা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো ।
জহিরও তার পিছু পিছু গেল ।
বাড়ির ভিতর ঢুকতেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ভাঙ্গা দরজাটা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেল ।
চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার ।
জহির কিছুই দেখতে পেল না ।
পরদিন সকালে হারু মাঠে আসলো ওর গরুকে ঘাস খাওয়াতে ।
সেদিনের মত ও-ই প্রথম দেখলো বটগাছে জহিরের ঝুলন্ত লাশটা ।
রনির লাশের মত এই লাশটারও চোখদুটো খোলা ।
হারু চিৎকার দিয়ে উঠলো ।
গ্রামবাসীরা এসে জহিরের লাশের সৎকারের ব্যবস্থা করলো ।
পরপর দুটি অদ্ভুত মৃত্যুতে গ্রাম থমথমে হয়ে গেল ।
বটগাছটা ভুতূরে আর ভয়ংকর বটগাছ হিসাবে পরিচিত হয়ে গেল গ্রামে।
হারু শান্ত আর প্রচন্ড চিন্তাশীল একজন কিশোর ।
সেদিন মাঠে বসে ও ভাবলো দুইটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো গ্রামে ।
অথচ কোন হদিসই পাওয়া গেল না কীভাবে মারা গেল রনি আর জহির ।
বটগাছেই কি তাহলে সব রহস্য লুকিয়ে আছে ?
সে রাতে পুরো গ্রাম যখন ঘুমিয়ে পড়লো হারু চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে বটগাছের তলায় আসলো ।
এদিক সেদিক তাকিয়ে ও কাউকেই দেখতে পেল না ।
ও বেশকিছুক্ষণ বসে রইলো সেখানে ।
কিন্তু অদ্ভুত বা ভয়ংকর কিছু ঘটলো না ।
অগত্যা ও যখন বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো ।
তখনই ওর কানে কারো পদশব্দ ভেসে আসলো ।
হারু পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো একজন বৃদ্ধলোক কাঁধে ঝোলা নিয়ে বটতলায় গিয়ে বসলো ।
লোকটার চেহারা অস্পষ্ট । ঝোলা থেকে বেশ কিছু স্বর্ণ আর মুক্তো বের করলো ।
চাঁদের আলোতে চকচক করে উঠলো সেগুলো ।
হারু একটু এগিয়ে যেতেই ওর মায়ের কথা মনে পড়লো ,
"কখনও অন্য কারো জিনিসের উপর লোভ করবি না ।
রাস্তায় কোন জিনিস পড়ে থাকলে হাত দিবি না তাতে ।
" মায়ের কথা মনে পড়তেই ও উল্টোপথে হেঁটে ওর বাড়ি চলে আসলো ।
ঘুমানোর আগে ও ভাবলো তাহলে কি লোভের কারণেই মৃত্যু হয়েছে রনি আর জহিরের?
পরদিন গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি রশিদ মিয়া তার বাড়ির উঠানে জমায়েত ডাকলেন ।
গ্রামবাসী সবাই আসলে তিনি ঘোষণা দিলেন পুরানো ভাঙ্গা
ইটের বাড়িটা ভেঙ্গে নিজের জন্য একটা বাড়ি বানাবেন ।
যদিও জায়গাটা তার না তারপরও গ্রামবাসীরা অমত করলো না কারণ রশিদ মিয়া গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি ।
সে রাতে রশিদ মিয়া নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন ।
হঠাৎ মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
নুপূর আর বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেলেন তিনি ।
ঘর থেকে বের হলেন । শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে তিনি ভাঙ্গা ইটের বাড়িতে চলে আসলেন ।
দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেন একজন যুবতী নর্তকী আবেদনময়ী ভাবে নাচছে ।
তার নুপূরের শব্দই এতক্ষণ শুনছিলেন তিনি ।
পাশে একজন বৃদ্ধলোক বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে ।
নর্তকী ইশারায় ডাকলো রশিদ মিয়াকে ।
কামনার লালসায় মজে গেলেন তিনি ।সাত পাঁচ না ভেবে ঢুকে পড়লেন দরজা দিয়ে ।
ঘরে ঢুকতেই নর্তকী অদৃশ্য হয়ে গেল ।
শুধু ঘরের মাঝখানে কাফনে ঢাকা দুইটা লাশ পড়ে থাকতে দেখলেন । হতবিহ্বল হয়ে গেলেন তিনি ।
এগিয়ে গিয়ে কাঁপা হাতে কাফনের কাপড় সরাতেই দেখলেন রনি আর জহিরের রক্তমাখা মুখ ।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে ।
ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল তার ।
কোনরকমে উঠে দরজার দিকে দৌঁড় দিলেন ।
কিন্তু তিনি কাছে আসতেই নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেল দরজা ।
মাঝরাতে টিনে খুটখুট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল হারুর ।
চোখে কচলে উঠে বসতেই ও শুনতে পেল ফিস ফিস করে কেউ ডাকছে ওকে ।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ডাকটা আরও জোরালো ভাবে শোনা গেল ।
ও হাঁটতে হাঁটতে বটতলায় চলে আসলো । চারদিকে আবছা অন্ধকার ।
বটগাছের নিচে দাঁড়াতেই ওর কাঁধে উপর থেকে টুপটুপ করে কিছু পড়লো ।
ও উপরে তাকিয়ে দেখলো রশিদ মিয়ার লাশ ঝুলছে বটগাছে ।
আর তার শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে ওর কাঁধে
মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল হারু ।
তখনই কড় কড় শব্দে ভাঙ্গা বাড়ির দরজাটা খুলে গেল ।
ও সেদিকে তাকিয়ে দেখলো ঘরের ভিতর প্রচুর স্বর্ণ আর মুক্তো চকচক করছে ।
দরজাটা যেন ইশারায় ডাকছে ওকে ।
হারু জানে লোভ করলে ওকেও নিষ্ঠুর ভাবে মরতে হবে ।
রশিদ মিয়ার লাশটা কাঁধে তুলে ও চলে আসলো ।
রশিদ মিয়ার মৃত্যুতে আতঙ্ক নেমে আসলো পুরো গ্রাম জুড়ে ।
হারুর মুখে বিস্তারিত সব শুনে ভয় আরও বেড়ে গেল গ্রামবাসীর মনে ।
হারু বলল,' যে লোভ করবে তাকেই এমন নিষ্ঠুর ভাবে মরতে হবে ।
তবে ঐ বটগাছ বা ভাঙ্গা বাড়ির সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না ।'
ও সবাইকে সতর্ক থাকতে বলল ।
পরদিন বিকালে হারু যখন গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো তখন
ও দেখতে পেল একজন বৃদ্ধ লোক মাটিতে পড়ে আছে ।
শরীরের কিছু অংশ পঁচে গেছে লোকটার ।
গ্রামের মানুষ নাকে হাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ।
লোকটা পানি পানি বলে কাতরাচ্ছে ।
হারু তাকে পানি খেতে দিল ।
রাতে ও লোকটাকে ওর ঘরে থাকতে দিল ।
মাঝরাতে হারু গায়ে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল ।
চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো বৃদ্ধলোকটি ওর পাশে বসে আছে।
- কিছু লাগবে আপনার ? হারু জিজ্ঞাসা করলো ।
- না । তুমি আমাকে তোমার ঘরে থাকতে দিলে অথচ আমার পরিচয় জানতে চাইলে না !
- আপনি অসুস্থ ছিলেন তাই সাহায্য করেছি । তবে আপনি চাইলে আপনার পরিচয় বলতে পারেন ।
- আজ থেকে একশ বছর আগে এই গ্রামের জমিদার ছিলেন কাশিম খান । অঢেল ধনসম্পদ ছিল তার ।
আট দশ গ্রামের জমিদাররা তার কাছে সাহায্য চাইতে আসতো ।
কিন্তু সে ছিল খুবই লোভী । গ্রামের গরীব মানুষদের জমি কেড়ে নিতো ।
একদিন এক গরীব দরবেশ আসলো তার কাছে ।
কিছু খাবার চাইলো । তিনি খুব বাজে ব্যবহার করলেন দরবেশের সাথে ।
দরবেশ চলে গেলেন ।তার পরদিনই অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাশিম খান ।
কয়েকদিনের মধ্যে তার শরীরে পচন ধরলো ।অনেক কবিরাজ এসেও তাকে সুস্থ করতে পারলো না ।
বাড়ির লোকজন তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলো।
ধুঁকে ধুঁকে ঐ বটতলায় পঁচে মারা গেলেন তিনি ।
তার এত ধনসম্পদ তাকে বাঁচাতে পারে নি ।
- বেচারা কাশিম খান !! আফসোস করলো হারু ।
বৃদ্ধলোকটি হারুর দিকে তাকিয়ে বলল,' আসো আমার সাথে ।'
হারুর লোকটার পিছনে হাঁটতে লাগলো । লোকটা বটতলায় এসে থামলো ।
- এই সেই বটগাছ যার নিচে মারা গিয়েছিলেন কাশিম খান ।
আর তার কবর এই ভাঙ্গা বাড়ি ভিতর ,লোকটা বলল ।
- কিন্তু এই বাড়ির ভিতর তো কাল আমি অনেক ধনসম্পদ দেখেছিলাম ।
আর আমাদের গ্রামের তিনজন লোক অদ্ভুত ভাবে মারা গেছে ।
- আমি জানি ।
- আপনি জানেন !! তারা কেন মারা গেল ? অবাক হল হারু ।
- লোভের কারণে ।
লোকটা ভাঙ্গা ঘরে ঢুকলো ।হারুও তার পিছন পিছন ঢুকলো ।
একটা ঝোলাভর্তি স্বর্ণ আর মুক্তো হারুর হাতে দিয়ে লোকটা বলল,'
তোমার প্রয়োজন মতো এখান থেকে কিছু রেখে বাকিটা গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিবে ।
তবে প্রয়োজনের বেশি নিবে না । আর কখনও লোভ করবে না |
হারু ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো ।
একটু ভেবে ও আবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ,
'কিন্তু আপনার পরিচয় তো জানা হলো না ?
লোকটা বীভৎস হাসি দিয়ে বলল ,'আমি কাশিম খান ।'
কথা শুনে থমকে গেল হারু ।ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল মৃ্ত্যু দরজা ।
আগুন ধরে গেল ভাঙ্গা ইটের ঘরটাতে ।
ঘুম ভেঙ্গে গেল হারুর ।
এতক্ষণ ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছিলো ও ।
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ও
পাশের রুমে গিয়ে দেখলো অসুস্থ বৃদ্ধ লোকটি যাকে ও কাল রাতে আশ্রয় দিয়েছিলো তিনি নেই ।
তার বদলে বিছানায় একটা ব্যাগ পড়ে আছে ।
ব্যাগটার মুখ খুলতেই ও দেখলো তাতে অনেক স্বর্ণ আর মুক্তো রয়েছে ।
সকাল হয়ে গেছে ততক্ষণে ।
বাইরে চেঁচামিচি শুনে ও ঘরের বাহিরে এসে দেখলো গ্রামের সবাই বটতলায় জড়ো হয়েছে ।
আর ভাঙ্গা বাড়িটা আগুনে জ্বলছে ।
লোকজন অবাক হয়ে বলাবলি করছে ,
'আগুন লাগলো কি করে এ বাড়িতে !'
হারু বাড়ি ফিরে আসলো ।
ওর কানে তখনও বাজছে স্বপ্নের শেষ কথাগুলো -
"কখনও লোভ করবে না ।"
সমাপ্ত...