চারদিকে মাগরিবের আযান পড়েছে। হসপিটালে রাতের খাবার দেয়ার তোড়জোড় চলছে স্টাফদের মধ্যে।এমনই সময় হসপিটালের নিচতলায় দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতি। বাবার জন্য অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পরও আসছে না দেখে ভিতরের দিকে হাঁটতে লাগল।কিছুক্ষন হাঁটার পর খেয়াল করল এই দিকটায় মানুষের উপস্থিতি নেই বললে চলে।গা ছমছম করতে লাগল অভ্রের।চারপাশে অনেকগুলো বন্ধ রুম দেখতে পেল।হাঁটতে হাঁটতে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।রুমের দরজার সামনে বড় করে লিখা,"লাশ কাটা ঘর।সর্বসাধারণ এর প্রবেশ নিষেধ।"বাইরে থেকে রুম বন্ধ থাকায় ভিতরে কি আছে তা সে দেখতে পেল না।দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল প্রকৃতি।
-এই ছেলে,এইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?এখানে আসা বারন জানো না সেটা? পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল ওর্য়াড বয় দাঁড়িয়ে আছে।আচমকা এমন প্রশ্ন করায় সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল।একটু হকচকিয়ে বলল,আমার বাবার কাছে এসেছি। -তোমার বাবা কে?মর্গের এখানে তোমার বাবা আসবে কোথা থেকে? -আমার বাবা ডাঃ আসাদ শফিক।
-ওওও তুমি শফিক স্যারের ছেলে।স্যার তো নামাজ পড়তে গেছে।এখানে আর কখনো আসবে না।কি দেখতে কি দেখে পরে কিছু একটা হয়ে যাবে,শেষ কথাটা বেশ গম্ভীর হয়ে বলল ওয়ার্ড বয়। -কি দেখবো মানে?এখানে কি দেখার আছে যে কিছু হয়ে যাবে আমার? -এখানে মাঝে মাঝে অনেক কিছু দেখা যায়।আর এগুলো দেখলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। বিংশ শতাব্দীতে অশরীরি বলতে কিছু আছে তা প্রকৃতি বিশ্বাস করে না।ওয়ার্ড বয় এর কথা শুনে হেসে ফেলে।বলল,এসব পাগলের মত কথা বলবেন না।এসব আমি বিশ্বাস করি না। -তোমরা আধুনিক যুগের ছেলে এসব বিশ্বাস না করাটাই স্বাভাবিক।আচ্ছা চলো,স্যারের নামাজ মনে হয় শেষ।মসজিদের দিকে রওনা দেই।তবে এখানে না আসাই ভালো হবে। মসজিদের দিকে আসতেই প্রকৃতি তার বাবাকে দেখতে পেল।নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বেরিয়েছেন।সে তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
-বাবা,আমি তোমার জন্য অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম নীচতলায়।তারপর মর্গের ওইদিকটায় হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি। -কি,তুমি ওইদিকে কেন গেছো?ওইদিকে যাওয়া বারন তা জানো না? -আমি তো জানতাম না,ওইদিকে মর্গ আছে।তারপর একজন ওয়ার্ড বয় এসে জিজ্ঞেস করল,এই ছেলে এখানে কি করো? -ওর্য়াড বয়?বেশ অবাক হলেন ডাঃআসাদ শফিক। কিন্তু মাগরিবের সময়ে ওইদিকে তো কেউ যায় না।যাদের ডিউটি শেষ তারা এসে নামাজ পড়ে মসজিদে।আর বাকিরা ওয়ার্ডে থাকে ডাক্তারদের সাহায্যে করার জন্য। এমন কথা শুনে প্রকৃতি চমকে উঠল।তাহলে ওয়ার্ড বয়টা কে ছিল?তবুও সে এসব না ভেবে বলল,হয়ত কেউ ওইদিকে কোনো কাজে গিয়েছিল। -অসম্ভব,এই সময়ে ওইদিকে কেউ যাবে না।প্রতিদিন রাত ১২ টার পর মর্গের দরজা খোলা হয়।আর ভোর ৫ টায় বন্ধ করা হয়।এর পর আর ওইদিকে কেউ যায় না।তাছাড়া আজকে মর্গ বন্ধ।আচ্ছা ওই ওয়ার্ড বয় দেখতে কেমন ছিল মনে আছে?
-স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো।বেশ সুদর্শন দেখতে ছেলেটা।হ্যাঁ,ওর ব্যাচে শিহাব নাম দেখতে পেলাম। ডাঃ আসাদ শফিকের মুখটা একটু চুপসে গেল।তিনি মনে হয় কিছু শুনে ভয় পেয়েছেন।কথা এড়িয়ে বললেন-প্রকৃতি,আর কখনো ওইদিকে যাবে না।এখন বাসায় চলো তাড়াতাড়ি,তোমার আম্মু আমাদের জন্য বসে আছেন। -তুমি কি শিহাবকে চেনো?তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা লুকিয়ে রাখছো আমার থেকে। -আমি কাউকে চিনি না।তুমি এখন চলো।এই বিষয়ে আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। প্রকৃতি চুপ করে গেল।আর কথা না বলে বাবার সাথে হাঁটতে শুরু করল।
ঘড়িতে সময় রাত ১২ টা।শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো নিজেদের এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়।চারপাশে ফোঁটাফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে।সব মিলিয়ে পরিবেশ বেশ গা ছমছমে।হাসপাতালের গেট পেরিয়ে প্রকৃতির পা পড়ল নিচতলার গেটে।তারপর রওনা দিল মর্গের দিকে।বেশকিছুক্ষন হাঁটার পর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।এখন আর ভয় লাগছে না প্রকৃতির ।চারপাশে একবার ভালো করে তাকালো।না,আশেপাশে কেউ নেই।দরজাটায় তালা মারা নেই দেখে বেশ অবাক হলো ।তবে ভিতরে ঢুকতে পারবে এই ভেবে বেশ খুশি হলো সে।আস্তে করে দরজাটা খুলল।ভিতরে টিমটিম আলো জ্বলছে।আলো জ্বলতে দেখে প্রকৃতি অবাক হয়ে গেল।বাবা তো বলেছে আজ মর্গ বন্ধ।তাহলে ভিতরে আলো জ্বলছে কিভাবে,ভাবতে লাগল প্রকৃতি।
দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল পুরো রুম খালি,কেউ নেই।স্টিলের টেবিলে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ পড়ে আছে।ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল সে।ফ্রিজার এর সামনে এসে দাঁড়ালো।কাঁপা কাঁপা হাতে ফ্রিজ এর দরজা খুলল।সেখানে বিভৎস চেহারার তিনটা লাশ পড়ে আছে।সহ্য করতে না পেরে দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল।পেছনে ফিরতেই চমকে উঠল প্রকৃতি।চারজন লোক চেয়ারে বসে আছে। -আরে প্রকৃতি সাহেব যে!
-তোমরা এখানে কখন আসলে?আমি তো রুমে কাউকে দেখিনি।আর আমার নাম কিভাবে জানলে? -আমরা এই মাএ এসেছি।তুমি ফ্রিজার খুলছো তাই আর ডাক দেইনি।তোমার বাবার মুখে তোমার কথা অনেক শুনেছি।তোমার ছবিও দেখেছি ওনার মোবাইলে।তাই তোমাকে দেখেই চিনতে পেরেছি,তাদের মধ্যে থেকে একজন বলল। -
আজকে তো মর্গ বন্ধ।তোমরা এখানে কেন? -আমাদের আজ ডিউটি নেই।তাই ভাবলাম সবাই মিলে একটু আড্ডা দেই।আর হাসপাতালে এটাই সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গা।তাই সবাই এখানে চলে এসেছি।
-ওওও আচ্ছা।আমি কি তোমাদের সাথে আড্ডা দিতে পারি? -হুম অবশ্যই।এখানে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ো। প্রকৃতি একটা চেয়ার টেনে তাদের পাশে বসে পড়ল। -এইদিকে তো কেউ আসে না।তাও আবার এত রাতে তো অসম্ভব।তুমি এইদিকে পা বাড়ালে কেন?তাদের মধ্যে একজন বলল।
-মর্গের ভিতরটা কেমন তা কখনো দেখিনি।বাবাকে অনেকবার বলেছি কিন্তু তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যায় না।তাই আজ লুকিয়ে এখানে চলে এসেছি।আচ্ছা সবাই এখানে আসতে বারন করে কেন? -মর্গে যারা মারা যায় তাদের এখানে নিয়ে আসা হয়।অনেকের মাথা কাটা,অনেকের শরীর টুকরো করা,আবার আত্মহত্যা করা লাশও এখানে আসে।অনেকসময় এই লাশগুলো হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠে।তাছাড়া অশরীরি খারাপ জিনিসের আনাগোনা এসব জায়গায় বেশি থাকে।দিনের বেলায় অনেকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। লোকটার কথা শুনে প্রকৃতি হেসে উঠল।বলল,আমি এসব বিশ্বাস করি না।তোমরা যদি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব বলো তাহলে বলব ভুল।আমি এসবে ভয় পাই না।মৃত লাশ জীবন্ত কিভাবে হয়ে উঠবে।তাছাড়া অশরীরি বলতে কিছু নেই।
-তুমি তাহলে এসব বিশ্বাস করো না?যদি এখন তোমার সাথে খারাপ কিছু ঘটে তাহলে কি করবে? প্রকৃতির নিচের দিকে চোখ পড়ল।আর যা দেখতে পেল তা হয়ত ওর দেখা সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্য।চারজনের সবার পা নেই।রক্তে মেঝে লাল হয়ে আছে।প্রকৃতি মাথা তুলে তাদের দিকে তাকাতেই বিভৎস হাসি দেখতে পেল।সঙ্গে সঙ্গে রুমের আলো নিভে গেল।প্রকৃতি চেয়ার থেকে উঠে হাঁটতে লাগল।হঠাৎ কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল।পকেট থেকে মোবাইলের ফ্লাশ অন করে যা দেখতে পেল তা প্রকৃতি প্রস্তুত ছিল না।সাদা কাপড়ে ঢাকা দেয়া লাশটা আর কারো নয়,একটু আগে কথা বলা চারজনের মধ্যে একজনের।ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল।কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।হঠাৎ মনে পড়ল,বাবাকে কল দেই।কিন্তু নেটওয়ার্ক এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।প্রকৃতি শুনতে পেল,ফ্রিজারগুলো মনে হয় একটু নড়ে উঠল।কিন্তু সেখানে তো মৃত মানুষের লাশ।লাশ কিভাবে নড়বে,তা ভাবতে লাগল প্রকৃতি।
প্রকৃতিকে অবাক করে দিয়ে ফ্রিজ এর দরজা আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করল। ওর মনের ভিতর আস্তে আস্তে ভয় জমাট বাঁধছে শুরু করেছে।পুরো শরীর ভয়ে যেন অবশ হয়ে গেছে তার।এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে।চারজন লাশ উঠে হাঁটতে শুরু করল।শরীরে কারো শীতল হাতের স্পর্শ পেল প্রকৃতি।নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করল সে।হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল।রুমের আলো আচমকা জ্বলে উঠল। প্রকৃতি দেখতে পেল রুমের সবকিছু আগের মতই স্বাভাবিক।
দরজা ভেঙে প্রবেশ করল ডাঃ আসাদ শফিক।সঙ্গে দুজন সিকিউরিটি গার্ড।দৌড়ে এসে প্রকৃতিকে জড়িয়ে ধরলো। -প্রকৃতি,সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া তুমি বেঁচে আছো।আমি তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। -বাবা,তুমি একটু দেরি করে আসলে আমি মারা যেতাম।কি ভয়ানক দৃশ্য,কাঁদতে কাঁদতে বলল প্রকৃতি। -এই মর্গের জায়গাটা খুব খারাপ।অনেকে অনেক কিছু দেখে।সন্ধ্যায় ওয়ার্ড বয় শিহাবের কথা তুমি বললে।খুব ভালো একটা ছেলে ছিল।সবাই খুব পছন্দ করত।কিন্তু আজ থেকে ২ বছর আগে এই মর্গে তার বিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।সবার ধারনা,হয়ত কোনো কাজে মর্গে একা প্রবেশ করেছিল।মর্গে ঢুকতে হলে সাথে কাউকে থাকতে হয় সেটা শিহাব জানত না।তবে অনেকে বলে শিহাবকে মাঝে মাঝে এই মর্গের আশেপাশে দেখা যায়।হয়ত নিজের করা ভুল যাতে অন্য কেউ না করে তাই সবাইকে সর্তক করে।এই জন্য সন্ধ্যায় তোমাকে বারন করেছিল এই জায়গায় না আসতে।রাতে ঘুমাবার সময় মনটা সায় দিল না।ছোটবেলা থেকে তুমি একরোখা।যা একবার মুখ দিয়ে বলবে তা করেই ছাড়বে।রুমে তোমাকে না পেয়ে সোজা এখানে চলে আসি।
প্রকৃতি নিজের ভুল বুঝতে পারল।কিছু না জেনে এভাবে এত রাতে একা চলে আসা উচিত হয়নি।একরোখামি সব জায়গায় প্রয়োগ করলে তার ফলও মারাত্মক হয় তা সে ভালোই প্রমান পেল।
সমাপ্ত