লাশ - পর্ব ০১ - ভৌতিক গল্প

লাশ
সাকিব ফারহান
পর্বঃ ০১



"ভাই, আমার একটা লাশ লাগবে। কমবয়সী কোন মেয়ের লাশ হলে ভালো হয়।" খাটের উপর শুয়ে কথাটা বলল রাফিন।
লাবিব তখন ফ্লোরে বসে ফেসবুকিং করছিলো। রাফিনের কথা শুনে ওর ভ্রু কুচকে গেল। মোবাইলের স্ক্রীন থেকে চোখ সরিয়ে রাফিনের দিকে তাকাল। তাকিয়েই থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল, "ওইটা এখনও তোর মাথা থেকে যায় নি?"
"কীভাবে যাবে বল? ব্যাপারটার মাঝে আলাদা একটা আনন্দ আছে। কেমন জানি একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। তাছাড়া টাকাটাও কম না। ভালো ভিডিও বানাতে পারলে নিশ্চিন্তে বিশ হাজারের মতো পাবো। ব্যাপারটা তুই বুঝার চেষ্টা কর।"
"তোর যা খুশি কর।" বলেই আবার মোবাইলের স্ক্রীনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল লাবিব। ওদিকে আর কিছু বলল না রাফিন।
রাফিন আর লাবিব। একটা প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ছে। থাকে এই নির্জন দো'তলা বাড়িটাতে। ঢাকার শহরে এরকম নির্জন জায়গায় বাসা ভাড়া পাওয়া বেশ কঠিন। যদিও কোন ভাড়া দেওয়া লাগেনা ওদের। কেন দেওয়া লাগেনা সেটা পরে জানতে পারবেন।
দু'জনেই উঠে এসেছে অজপাড়াগাঁ থেকে। তাই সাহসটাও একটু বেশি। মেডিকেলে ভর্তি হবার পরে প্রথমদিকে যখন অন্যরা মর্গের কাছেই যেতে চাইত না, রাত-বিরাতে সেখানে ওরা দিব্যি চলে যেত। প্রথম প্রথম লাশ কাটার সময় অনেক স্টুডেন্টই ভয়ে জ্ঞান হারাতো। কিন্তু ব্যাপারটা ওরা উপভোগ করতো। এভাবেই চলছিলো সবকিছু। কিছুদিন পর ম্যাচ ছেড়ে দিয়ে ওরা এই নির্মাণাধীন বাড়িটার দোতলা ভাড়া নেয়। যদিও নিচের তলা'ই আগে কমপ্লিট হয়েছিল।
মফস্বল এলাকা হওয়াতে ভাড়াটাও কম। বাড়তি টাকা দিয়ে নিশ্চিন্তে দামী দামী হুইস্কি গিলতে পারে। তবে এক্ষেত্রে রাফিনই একধাপ এগিয়ে। লাবিবের এগুলো ভালো লাগে না। তবে খারাপও লাগে না।
রাফিনের মামা থাকতো আমেরিকায়। সে দেশে আসার সময় ওর জন্য একটা ভিডিও ক্যামেরা আনলো। সেটা পেয়ে বেশ খুশি হলো রাফিন। বাচ্চারা নতুন সাইকেল চালানো শিখলে যেমন সারাক্ষনণ ওই সাইকেল নিয়েই পড়ে থাকে, রাফিনের দশাও ঠিক তেমন হলো। দিন রাত সে ভিডিও ক্যামেরা নিয়েই পড়ে থাকলো। যা পেল তা-ই ভিডিও করা শুরু করল। ভয়ে তো লাবিব বাথরুমে যাওয়াই বন্ধ করে দিল। না জানি কখন আবার ও বাথরুমের মধ্যে ভিডিও ক্যামেরা চালিয়ে রাখে। তবে বাঁচতে পারলো না লাবিব। রাফিন ঠিকই ওই বিশেষ মুহুর্তটার ভিডিও করে নিলো। এবং রীতিমতো সেটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইলও করা শুরু করল। প্রতিদিন পকেট থেকে বাড়তি টাকা যেতে শুরু করল লাবিবের। করার কিছুই নেই। একটু এদিক ওদিক হলেই ওই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাবে।
সেই থেকেই শুরু।
কাছেই আরেকটা বাড়িতে বাড়িওয়ালারা সপরিবারে থাকতো। কোন এক কাজে একদিন বাড়িওয়ালাদের বাড়িতে গেল রাফিন। যথারীতি ক্যামেরাটা সঙ্গে রয়েছে। বাড়িওয়ালা তখন নিজের বেডরুমে ছিলো। রাফিন জানালা দিয়ে এমন কিছু দেখলো, যেটা দেখে ওর মাথায় দারুণ একটা বুদ্ধি খেলে গেল। এই সুযোগটা সে হারাতে চাইল না। জানালা দিয়েই ভেতরের দৃশ্যটা ভিডিও করতে শুরু করল সে। বেচারা বাড়িওয়ালা কিছুই টের পেল না। পাবেই বা কী করে, সে তো তার সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্টের শরীর নিয়ে ব্যাস্ত আছে। যখন টের পেল তখন আর করার কিছুই নেই।
ভিডিওটা বাড়িওয়ালাকে কৌশলে দেখিয়ে রাফিন বাড়িভাড়া সারাজীবনের জন্য মওকুফ করে তো নীলই, সাথে প্রতি মাসে হাতখরচ বাবদ দশ হাজার টাকাও আদায় করে নিল। কিছুই করার নেই বাড়িওয়ালার। একটু এদিক ওদিক হলেই তার আর তার সুন্দরী অ্যাসিস্ট্যান্টের রমরমা ভিডিওটা নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাবে। সেটার সামনে এই বাড়িভাড়া আর দশ হাজার টাকা তুচ্ছ ব্যাপারই বটে।
এবার প্রফেশনালি ব্ল্যাকমেইলের কাজটা শুরু করল রাফিন। পেইন-ক্যাম, বাটন-ক্যাম সহ আরও বেশকিছু স্পাই ক্যামেরা কিনলো সে। মেডিকেলের অনেকের গোপনীয় ব্যাপার-স্যাপার ভিডিও করে তাদের থেকে অর্থ আদায় করতে শুরু করল।
মেডিকেলের প্রফেসর আর চতুর্থ ইয়ারের ছাত্রী অর্পার মধ্যে যে এক ধরনের ইটিসপিটিস সম্পর্ক চলছে, সেটা কোনভাবে জেনে গেল রাফিন। কাজেই সুযোগটা সে হারাতে চাইল না। কৌশলে তাদের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের দৃশ্যটা ভিডিও করে ফেলল। তারপরেই ব্ল্যাকমেইল। তবে এবার নিজের পরিচয় ফাস করল না রাফিন। এতে করে সমস্যা হতে পারে। প্রফেসর ব্যাটার ক্ষমতা অনেক বেশি। ধরতে পারলে ওকে একেবারে উপরেও পাঠিয়ে দিতে পারে।
রাফিন কৌশলে প্রফেসরের কাছে ভিডিওটা পাঠিয়ে দিল। সেই সঙ্গে একটা মেসেজ। যেখানে লিখে দিল, "২৩৬ থেকে ২৬০ রোল পর্যন্ত সকল স্টুডেন্টের বেতন-ভাতা মওকুফ করতে হবে এবং প্রতিটা পরীক্ষায় এদের পাশ করিয়ে দিতে হবে, অন্যথায় এই সুন্দর ভিডিওটি অতিসত্বর নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হবে।"
উল্লেখ্য, রাফিনের রোল হলো ২৪৫, আর লাবিবের ২৫০।
বেচারা প্রফেসরের করার কিছুই নেই। কে তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে সেটাও তার পক্ষে জানা সম্ভব না। বাধ্য গোলামের মতো সে রাফিনের কথা মানতে থাকলো।
এদিকে অর্পাকে খাওয়ার লোভটাও সামলাতে পারলো না রাফিন। লাবিব অবশ্য ওকে এটা না করার কথা বলেছিলো। এতে করে প্রফেসর ওদের ধরে ফেলতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভিডিওটা সে অর্পাকে দেখিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ব্ল্যাকমেইল শুরু করল। ওর সাথে ফিজিক্যালি করতে বাধ্য হলো অর্পা। রাফিন সেই ভিডিওটাও করে ফেলল। এরপর সেই ভিডিও দেখিয়ে ইচ্ছেমত ব্যাবহার করল অর্পাকে। সেইসাথে মোটা অংকের টাকাও হাতিয়ে নিল।
ওদের ব্যাচের সবথেকে সুন্দরী এবং মেধাবী ছাত্রী হলো আনিশা। ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবগুলো ছেলে ওর জন্য পাগল। কিন্তু আনিশা কাউকেই পাত্তা দেয় না। পাত্তা দেয় না বলতে, ও আসলে এইগুলো পছন্দ করে না। একটু ধর্মভীরু টাইপের।
আনিশার পেছনে লাগল রাফিন। এবং খারাপ ব্যাপারটা এখানেই ঘটলো।
রাফিন অনেক চেষ্টা করেও রিলেশন করানোর জন্য আনিশাকে রাজি করাতে পারল না। এদিকে লাবিবও আনিশাকে পছন্দ করত। কিন্তু ওই পছন্দ করা পর্যন্তই। কখনোই এই কথাটা সে কাউকে বলেনি। এমনকি রাফিনকেও না।
রাফিন যে আনিশার পেছনে লেগেছে এটা জানার পর রাফিনকে বাধা দিল লাবিব। ওকে বিরক্ত করতে নিষেধ করল। ওর কথা হেসেই উড়িয়ে দিল রাফিন। একদিন সে লাবিবকে বলল, "আনিশাকে রাজি করারনোর জন্য দারুন একটা বুদ্ধি পেয়েছি।"
"কী?"
"ওর গোসলের দৃশ্যটা ভিডিও করে ওটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করব। দারুন হবে না?"
কিছুই বলল না লাবিব। পরপর দু'টো ঘুসি বসিয়ে দিল রাফিনের নাকের ওপরে। তারপর থেকে হলে থাকতে শুরু করল সে। সপ্তাহ দুয়েকের মতো রাফিনের সাথে কোন যোগাযোগ রাখলো না। এমনকি ক্যাম্পাসে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলেও কথা বলত না।
পুরানো বন্ধুত্ব ওদের। সেই ন্যাংটো কালের বন্ধু ওরা। সুতরাং এই মনমালিন্য বেশিদিন টিকলো না। আবার ওদের মধ্যে ভাব হয়ে গেল। হল ছেড়ে দিয়ে আবার রাফিনের সঙ্গে থাকতে শুরু করল লাবিব।
এদিকে রাফিন ঠিকই আনিশার গোসলের করার দৃশ্য ভিডিও করল। লাবিব সেটা জানতে পেরে ওর সাথে আরেক পশলা ঝগড়া করল। ওর ল্যাপটপ থেকে ভিডিওটা ডিলিট করে দিল। কিন্তু লাবিবের জনা ছিলো না, রাফিন ভিডিওগুলো তার আরেকটা পেন ড্রাইভেও ব্যাকাপ করে রাখে। লাবিবের অজান্তেই সে আনিশাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করল। কিন্তু কোনভাবেই রাফিনের প্রস্তাবে রাজি হলো না আনিশা। একপর্যায়ে সইতে না পেরে সুইসাইড করল সে। বিষ খেয়ে মরে গেল।
ব্যাপারটা বুঝতে পারলো লাবিব। রাফিনই সব স্বীকার করল। আসলে ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে সেটা ভাবতেও পারেনি রাফিন। ও আসলে কখনোই ভিডিওটা নেটে ছাড়তো না। এমনকি অন্য কাউকে দেখাতোও না। আনিশাকে শুধু একটু ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাতেই সুইসাইড করল মেয়েটা।
প্রচণ্ড রকমের শক খেল রাফিন। ব্ল্যাকমেইল-টেইল সব ছেড়ে দিল। লাবিবও প্রাণের বন্ধুর কথা চিন্তা করে কাউকে কিছু বলল না।
এভাবেই চলছিলো সব। কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। আনিশার কথা ভুলতে শুরু করেছে ওরা। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেছে। সেদিন সন্ধ্যায় ব্যাগ থেকে ভিডিও ক্যামেরাটা বের করল রাফিন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটাকে দেখতে লাগল। শেষে বলল, "অনেকদিন এটাকে কাজে লাগানো হয় না। এভাবে পড়ে থাকলে তো নষ্টই হয়ে যাবে।"
"তো আবার কী ব্ল্যাকমেইল করার কথা ভাবছিস?" জিজ্ঞেস করল লাবিব।
"আরে নাহ। ব্ল্যাকমেইল-টেইল ওসব কিছু না।"
"তাহলে?"
"ভাবছি আমাদের লাশকাটার দৃশ্য শুটিং করলে কেমন হয়?"
"তুই কি ভৌতিক কিছু বানানোর কথা চিন্তা করছিস?"
"হুঁ তেমনটাই। তাছাড়া, তুইও ভেবে দেখ, শুধু লাশকাটার দৃশ্যটা ধারণ করতে পারলে একটা নতুন কিছু করা হবে। তাছাড়া আমি খুব নামি-দামি একটা ইউটিউব চ্যানেলের সাথে কথা বলেছি। ওরা হরর সীন বানায়। মানসম্পন্ন কোন ভিডিও ওদেরকে বানিয়ে দিতে পারলে বেশ কিছু টাকা দিবে।"
"কিন্তু স্যারেরা লাশকাটার ঘরে শুটিং করতে দেবে বলে মনে হয়?"
"আমিও সেটাই ভাবছি। কী করা যায়? একটা আস্ত তাজা লাশ যদি ব্যাবস্থা করা যেত।"
"লাশ এত সোজা জিনিস ভেবেছিস নাকি? বেওয়ারিশগুলোও আঞ্জুমান মফিদুলে চলে যায়।"
আর কথা বাড়ালো না রাফিন। ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু বললও না। সপ্তাহখানেক চুপ থাকলো।
কিন্তু আজ আবার তুললো সেটা।
"একটা কাজ করলে কেমন হয়?" কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার বলল রাফিন।
মোবাইলের স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়েই লাবিব জিজ্ঞেস করল, "কী?"
শোয়া থেকে উঠে বসলো রাফিন। "আফসার ভাইকে বললে কেমন হয়?"
"দেখ, বলে।"
"আজই বলবো।"
"হুঁ, ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। রেডি হয়ে নে।"
"আমি রেডিই আছি। তুই রেডি হ।"
উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলে লাবিব। রেডি হয়ে দু'জনে একসাথে ক্লাসে গেল।
মর্গের পাহারাদার আফসার উদ্দিনকে ব্যাপারটা বলল রাফিন। বলল, "আমার একটা লাশ লাগবে।"
"কিন্তু এখানের সব লাশ তো হিসেবের লাশ।" বলল আফসার উদ্দিন। "এখান থেকে একটা লাশও উধাও হলে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।"
আফসার উদ্দিনের হাতের মুঠোয় হাজার টাকার দু'টো নোট গুঁজে দিল রাফিন। "বেওয়ারিশ কোন লাশের ব্যবস্থা করতে পারবেন না?"
টাকা পেয়ে একগাল হাসলো আফসার উদ্দিন। বলল, "লাশ কবে লাগবে ভাই?"
"এই দুয়েক দিনের মধ্যে হলে ভালো হয়।"
"কেমন লাশ?"
"অল্পবয়সী কোন মেয়ের লাশ হলে সবথেকে ভালো হয়, তবে ছেলেদের হলেও সমস্যা নেই।"
"অল্পবয়সী মেয়েদের লাশ পাওয়া তো দুষ্কর।" মাথা চুলকে বলল আফসার উদ্দিন। "আসোলে ওরা মরে কম। তয়, আমি ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।"
"আচ্ছা।"
পরদিন রাত সাড়ে এগারোটা। আকাশে খুব মেঘ করেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। এমন সময় আফসার উদ্দিনের ফোন।


© bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.