আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ইদ্রিস তুমি ছাড়া আর কেউ দেখেছে?
-না স্যার। তয় আগে শুধু দেখতাম এহন ধরবার ও পারি! এই দেহেন স্যার হাত ধরলাম।
এই বলে বা পাশে ফিরে অদৃশ্য কিছু একটা ধরলো সে। তার পর সেটা ধরা অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ালো!
আমি আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলাম না। ঝাঁজালো কন্ঠেই বললাম,
-কি তুমি বলো ইদ্রিস। কে তোমাকে বললো যে আমি এসব আজগুবি গল্প বিশ্বাস করবো? বিজ্ঞানের বাহিরে কোন কিছুই আমি বিশ্বাস.....কথা শেষ করার আগেই প্রচন্ড অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ইদ্রিসের সাথে তার পাশের বেঞ্চের গদিটাও কেমন যেন একটু নড়ে উঠলো। নরম গদিতে ভারী কিছু চাপা দিয়ে তা উঠিয়ে নিলে সেটা যেমন একটু উপরে উঠে আসে ঠিক তেমন। আমি চমকে একটু পেছনে সরে আসলাম। তখনই করিডোরের দেয়ালে শুন্য থেকে লাল তরল কিছু একটা গড়িয়ে পরতে দেখলাম। ইদ্রিস ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
-পানের অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারেনাই! আগের মতই হেকিমপুরি জর্দা দিয়া পান খায় আর একটু পর পর পিক ফেলে! কিন্তুক কথা কয়না। আমি এতো কিছু জিগাইছি কিন্তু একটা কথা বাইর করতে পারি নাই। তয় স্যার হেয় কেলাস ফাইভ পাশ ছিলো। আরবি লেখতে পড়তে পারতো। অহন কিছুই পারেনা। কিছু পড়তে কইলে ফ্যালফ্যাল কইরা তাকাইয়া থাকে।
আমার মাথা ঘুরে পরবার মতো অবস্থা হলো। কি বলবো কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে ইদ্রিস বলে উঠলো,
-যাই স্যার। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম।
বলেই ইদ্রিস আর তার অদৃশ্য বউ হাঁটতে শুরু করলো। আমি ধ্বক করে নাকে পান জর্দার তীব্র গন্ধ পেলাম, বোধহয় হেকিমপুরি জর্দাই হবে আর ইদ্রিসের চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম। কি ভাবলেশহীন ভাবেই না সে হেঁটে যাচ্ছে। কিছু মিথ্যা বললো বলে তো মনে হলোনা।
কমন রুমে ঢুকতেই ইংরেজির শিক্ষক জয়নাল সাহেব কিছুটা টিটকিরি দিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,
-বিয়ের দাওয়াত পেলেন নাকি ভাই?
জবাবে কি বলবো ভেবে পেলাম না। উনার দিকে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ক্লাস নিতে চলে গেলাম। ঠিক মতো পড়াতেও পারলাম না। কিছুক্ষন পরে আমার কপাল ঘামতে শুরু করলো। সারাজীবন বিজ্ঞান ছাড়া কিছু বিশ্বাস করিনি। আমি অংকের শিক্ষক। আমার কাছে দুই আর দুই যোগ করলে সবসময় চারই হয়। অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। সেই আমাকে আজ যা দেখতে হলো তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। আমি ছাত্রদের ছুটি দিয়ে আবার কমনরুমে চলে এলাম। জয়নাল সাহেব সহ অন্য শিক্ষকেরা গোল হয়ে বসে কি নিয়ে যেন আলাপ করছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখেই চুপ হয়ে এমন ভাব করতে লাগলেন যেন তারা কিছুই করছিলেন না। ঠিক সেই সময় শামসুল আমার জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে সেখানে আসলো। আমি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে গেলাম সেদিনের জন্য ছুটি চাইতে। পুরো উজিরপুরে আমি যদি একজন মানুষকেও ভক্তি শ্রদ্ধা করি সেটা উনি জনাব আব্দুর রহমান স্যার। উনার মতন এত ভদ্র আর সব বিষয়ে জ্ঞানী মানুষ আমার উনিশ বছরের শিক্ষকতার জীবনে দেখিনি আমি। বলা মাত্র একবারও কারন না জিজ্ঞেস করেই উনি ছুটি দিয়ে দিলেন। আমি আর দেরি না করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসার আগে শামসুলকে বলে আসলাম সে যেন কলেজ শেষে ইদ্রিসের কাছে যেয়ে রাতে আমার সাথে দেখা করতে বলে। শরীর প্রচন্ড ঘামছিল। আমার উনিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কোনদিন কলেজে এসে ক্লাস শেষ না করে ছুটি নিয়েছি কিনা মনে করতে পারলাম না। শামসুল আমার শরীর খারাপ আঁচ করতে পেরে আমার সাথে আসতে চেয়েছিল আমি আনি নি।
কলেজ থেকে ফেরার পথে কেমন যেন লাগছিলো। ঝাঁজালো গরম পড়েছে। আষাঢ় মাস অথচ বৃষ্টির নাম গন্ধ নেই। ভরদুপুরে জীবন কেমন যেন স্থবির। দুরে পুকুর চালায় দু'জন বসে নিজেদের ভেতর খোশগল্প করছে! পুকুরে ছেলে ছোকরার দল ঝাঁপাঝাপি করছে! বাড়ির বৌ আর মেয়েরা রান্নায় ব্যাস্ত। মনে মনে ভাবলাম এসব আগে চোখে পড়েনি কেন। পরক্ষনেই বুঝলাম এই সময়ে তো আমার বাহিরে ঘোরা হয়না তাই হয়তো খেয়াল করা হয়নি। এদিকে আমার শরীরটা ক্রমেই খারাপ হতে লাগলো। দু'মিনিট হাঁটার পর মেইন রোডে এসে পরলাম। রাস্তা পেরিয়ে ওপার গেলেই মসজিদ। ভাবলাম একবার ইমাম সাহেবকে বলে যাই। ইমাম সাহেব অমায়িক লোক হলেও আমাকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। কারন আমি নিয়মিত নামাজ পড়তে মসজিদে আসি না। বাসায় পড়ি বললেই উনি বলেন পুরুষ মানুষের নামাজ হলো মসজিদে আর মহিলাদের নামাজ হলো বাসায়। মসজিদ ছাড়া পুরুষের নামাজ হয় ক্যামনে! আমি জবাব না দিতে পেরে চুপ থাকি। ইমাম সাহেবকে ইদ্রিসের কথা বলতেই উনি পাত্তা না দিয়ে বললেন সে একটা দুষ্ট লোক নিশ্চয়ই কোন রকম কারসাজি করে আমাকে বোকা বানিয়েছে। বলেই উনি নামাজের জন্য তারাহুরো করে চলে গেলেন। আমি আর আমার কথা শেষ করতে পারলাম না। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। মাথা থেকে কিছুতেই ইদ্রিসের বৌয়ের ব্যাপারটা দুর করতে পারলামনা। বিকেলে শামসুল এসে জানালো ইদ্রিস রাতে আসবে আমার সাথে দেখা করতে। আমি ওকে ফেরার পথে মলয় ভৌমিককেও খবর দিতে বললাম। শামসুল ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেলো। আমি নিজে তেমন বিশ্বাসী না হলেও মলয় খুবই ধর্মভীরু তাই সে হয়তো কোন ব্যখ্যা দিলেও দিতে পারে। আর মলয়ের সাথে নানবিধ জিনিস নিয়ে কথা বলে আরাম পাই। আমার খুব মনে আছে সে একবার আমাকে মৃত মানুষ ফিরে আসার কি এক গল্প করেছিলো। অপশক্তি না কালো তপস্যা কি নাকি আছে সেগুলো দিয়ে এসব করা যায়। আর যারা এগুলো করে তাদের কাপালিক বলে। সাধারনত শ্মশানের আশেপাশে এদের দেখতে পাওয়া যায়। শ্মশানের ছাই এরা নিজেদের গায়ে মাখিয়ে রাখে। এছাড়াও মড়ার মাথার খুলিকে পাত্র বানিয়ে তাতে পানাহার করে। ভাবলেই গা গুলোয়। এরা সাধারা মৃত্যুর পরের জগৎ আর এই জগতের সেতুবন্ধন করতে দেখা যায় এদের। হিন্দু ধর্মে এদের সযত্নে এড়িয়ে চলা হয়। কিন্তু সাদার পাশে কালোর সহাবস্থান যে অনস্বীকার্য। কেউ মানুক আর নাই মানুক। কখন যে দিনের আলো ফুরিয়ে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে টেরই পাইনি। মলয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। এমন গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলাম যে হারিকেনটাও জ্বালাতে ভুলে গিয়েছিলাম। তড়িঘড়ি করে সেটা জ্বালালাম। দরজা খুলে দেখি ইদ্রিস আর মলয় দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই সাথে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো। মলয় বললো স্যার আর একটু দেরী হলেই বাদলার মইধ্যে পরতাম। ওরা দুজন ঘরে ঢোকা মাত্রই বৃষ্টি শুরু হল। আষাঢ় তার চিরচেনা রুপে না আসলে কি আর ভালো লাগে? আমি ইদ্রিস আর মলয় আমার টানা বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বৃষ্টি ততক্ষণে বেশ জোরে শোরেই শুরু হয়েছে। হালকা পানির ছিটা এসে গায়ে লাগছে। ভেপ্সা গরমে বেশ প্রশান্তিকর আরাম। আকাশ আলো করে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। প্রচন্ড শব্দ করে বাজ পড়লো। আমি ইদ্রিসকে শুরু করতে বললাম তার গল্প। কোনকিছু গোপন না করে একদম সত্যটাই বলতে বললাম। বাকীটা ওর জবানিতেই বলছি
-গেলো সপ্তাহে সেই দিন ছিলো বুধবার। পাশের গ্রামের আকলিমার সাথে আমার বিয়া ঠিকঠাক কইরা সাইকেলে ফিরতেছিলাম। ফেরার পথে সার্কাস দেখতে যাইয়া একটু রাত হইয়া গেছিলো। করিমগঞ্জ ঘাটে আইসা দেখলাম খেয়া নৌকা বন্ধ হইয়া গেছে। ঘড়িডা নষ্ট তাই আকাশের দিকে তাকাইয়া ঠাওর করবার চেষ্টা করলাম কয়ডা বাজে কিন্তু প্রচুর মেঘ থাকনে বুঝবার পারলাম না। পুরা খেয়া ঘাটে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলোনা। সাইকেলটা ঘুরাইয়া ঠিক করলাম কেওড়া বনের ভিতর দিয়া ঘুরা পথে গ্রামে ফিরমু। একটু সামনে আগাইতেই স্কুল ঘরের দিক থিকা কান্দনের আওয়াজ পাইলাম। আমি ভাবলাম হেই গেরামের মরিয়ম পাগলী হইবো। সাইকেলে প্যাডেল মারতেই কান্দনের আওয়াজটা আরও কাছ থিকা আইলো। আমি এইবারে বেমাক্কা ভয় পাইলাম। আমার রাইত বিরাতে চলাচল কইরা অভ্যাস কিন্তুক ক্যান জানি বুকটা কাইপ্পা উঠলো। দোয়া কালেমা পড়তে লাগলাম। আবার সাইকেলে প্যাডেল মারা শুরু করলাম। চাইরদিক ক্যামুন জানি আলকাতরার লাহান কালা হইয়া অন্ধকার নামছিল। হঠাৎ মেঘ সইরা ফকফকা চান্দের আলো পইরা চাইরদিক দিনের মতো সাদা হইয়া গেলো! বাঁশ ঝাড়ের নীচে দাঁড়ায় ছিলাম সাইকেল থিকা নাইমা। চিকন বাঁশ পাতার মধ্যিখান দিয়ে চান্দের আলো ছুরির ফলার মতো আইসা বিন্ধাইতে ছিলো আমারে! হের লগে কান্দনের আওয়াজ! জীবনে এমন ভয় আর পাইনাই স্যার। চাইরদিক ভালো কইরা দেইখাও কাউরে খুঁইজা পাইলাম না। হঠাৎ উপর থিকা কি জানি পড়লো মাথায়। একটা পরিচিত বাসনা পাইলাম, জর্দা পানের বাসনা। এইডা আমার খুব পরিচিত। আমার প্রথম বৌ বিলকিস পান খাইলে সবসময় এই বাসনা পাইতাম। তেরো বছর আগে সে মইরা গেছে আইজ এতো বছর পরে আমার কেমুন জানি শরীরে কাঁটা দিয়া উঠলো। তাইলে কি বিলকিস আবার ফিরা আইলো! কিন্তু আমি নিজ হাতে ওরে কব্বরে শোয়াইছিলাম। আইজও ভুলিনাই! ততোদিনে আমি আরেকটা নিকা করছি। ছোট বৌয়ের নাম হাসনা বানু। হেয় তখন বাপের বাড়ি গেছিলো। বিলকিসের বাপ-মা আছিলো না। ভাইয়েরা গঞ্জে থাকে। যোগাযোগ রাহে না। এছাড়াও সে-সময় গেরামের রাস্তা ছিলোনা তাই পুরা একদিন লাগতো যাইতে। বিলকিস আমারে ছাইড়া কোনদিন কোথাও যায় নাই। আমারে বেজায় ভালোবাসতো। কিন্তুক মাইয়াডার বাচ্চাকাচ্চা হয়না দেইখা আমি আবার বিয়া করছিলাম। বিলকিস খুব কান্নাকাটি করছিলো। তিন দিন মাইয়াডা না খাইয়া আছিলো। কিন্তুক হাসনা বানুরও বাচ্চাকাচ্চা হইলোনা। আমার মনে হইছিলো বিলকিসের বদদোয়া লাগছিলো। হেই সন্দেহ থিকা আমি একবার গঞ্জে যাইয়া বিলকিসের বদদোয়া কাটাইতে এক পীরের কাছ থিকা পরা পানি আনলাম। হাসনা বানুরে দিয়া হেই পরা পানি গোপনে বিলকিসরে খাওয়াইতে লাগলাম। পীর সাহেবে যেমনে করছিল তেমনে না দিয়া হাসনা বানু হেইডা নিজের ইচ্ছামত দেয়া শুরু করলো। আমি অনেকবার সাবধান করছিলাম কিন্তুক হেয় আমার কথা শুনে নাই। পীর বাবায় নিষেধ করছিলো উল্টাপাল্টা খাওয়াইতে। কইছিলো যেমুন যেমুন নিয়ম তার একচুল এদিক সেদিক হলেই খুব বিপদ হইবো। বিপদডা কার হইবো সেইটা বাবারে আর জিগাইতে মনে নাই। কিন্তু হাসনা বানু বিলকিসরে দুই চক্ষে দেখতে পারতোনা। বিলকিসের উপরে রাগ থাকলেও ওরে আমি খুব ভালোবাসতাম তাই উপায় না দেইখা আমি হাসনা বানুর পায়ে ধরতেও বাকি রাহি নাই কিন্তু আমার কোন কথাই সে কানে লয় নাই। আমি হেই পীর বাবারে অনেক খুঁজছি কিন্তু আর পাই নাই।
চলবে....
© bnbooks.blogspot.com