ছোট্ট মফস্বল উজিরপুর। এখানেই ইদ্রিসের দোকান 'ইদ্রিস ভ্যারাইটি স্টোর'। ছোট্ট এই জায়গায় সাপ্তাহে একদিন হাট ছাড়া এই দোকানটিই সবার একমাত্র ভরসা নিত্যকার কেনাকাটার জন্য। এখান থেকে দক্ষিণে আধা ঘন্টার দুরত্বে শেওড়া বন। প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরী হওয়া কমপক্ষে হাজার দুয়েক শেওড়া গাছের সুবিন্যস্ত বনভূমি। এই বনের কারনে এখানকার মানুষ দক্ষিনাঞ্চল থেকে আসা নির্মল পরিশুদ্ধ বাতাস পায়। উজিরপুরের উত্তরে বয়ে চলেছে মরা গাঙ। নামে মরা হলেও সেটা আসলে মরা না। বর্ষাকালে তার সর্বগ্রাসী রুপ দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই নদীতে অনেক লাশ ভেসে যেত জন্যই নদীর এই নাম দিয়েছিল সবাই। পরবর্তীতে সেই নাম টা-ই স্থায়ী হয়ে গিয়েছে। আবার ইদ্রিসের কথায় ফিরে আসা যাক। মানুষ হিসেবে সে খুবই ধূর্ত স্বভাবের। এর কথা ওর কাছে ওর কথা এর কাছে চালাচালি করাই তার নেশা। অনেকটা পাড়াবেড়ানি তৃতীয় শ্রেণীর মহিলাদের মতন। ইদ্রিসের বয়স আর বউয়ের সংখ্যা ঠিকঠাক করে কেউই বলতে পারেনা। নিঃসন্তান ইদ্রিস সন্তানের আশায় একের পর বিয়ে করে গেছে কিন্তু কপাল বলে তো একটা কিছু আছে! কিছুতেই কিছু হয়নি। এলাকায় এটা নিয়ে যথেষ্ট কানাঘুষা চলে। মুরুব্বীরা বলেন তারা নাকি তরুন বয়সে ইদ্রিসের বিয়ে খেয়েছেন আবার এখনকার ছেলে ছোকরা যারা তারাও নাকি ইদ্রিসের বিয়ে খেয়েছে। মোটকথা ইদ্রিস অত্র এলাকার এক আলোচিত বিষয়। একবার তো ইদ্রিসের বিয়ের সংখ্যা পাঁচ না ছয় এই নিয়ে এলাকার দু গ্রুপের মধ্যে দাংগা বেধে গেলো। সে এক বিশ্রী ব্যপার। দশ বারো জন লোক ভীষন আহত হলো। শেষমেশ পুলিশ এসে স্থানীয় ভাবে মীমাংসা করে দিয়ে যায়।
আমার সাথে ইদ্রিসের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই। উজিরপুরের একমাত্র সরকারী কলেজে মাস্টারি করার সুবাদে আমার বেশ পরিচিতি আছে। ছেলে বুড়ো সবাই আসতে যেতে সালাম দেয়। ছেলেছোকড়া দুর থেকেই সিগারেট লুকোয়। আমার এটাই ভালো লাগে। টাকাপয়সা তেমন একটা করতে পারিনি সত্য কিন্তু আমি একা মানুষ তাই জীবন চালাতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। পৈত্রিক সূত্রে একদম খারাপ কিছু পাইনি কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যায় ঢের বেশী হওয়ায় সেসবও প্রায় শেষের পথে। প্রায়ই প্রচন্ডরকম হতাশ লাগে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়। একা মানুষ কি আর হবে এতোকিছু করে। ক'দিনই বা আর বাঁঁচবো। সকালে নুরুর হোটেলের দুই পিস তেল ছাড়া পরোটা, পেঁয়াজ মরিচ বেশী দিয়ে ডিমের কড়া ভাজি আর এক বাটি সব্জি এই আমার কাছে অমৃত। নাস্তার এক ঘন্টা পর বড় একটা মগে করে আসে ধোঁয়া উঠা আগুন গরম চা। দুপুরে আমি কিছুই খাই না। শুধু এক মগ ঠান্ডা দুধ। সেটা কলেজে বসেই খাওয়া হয়। কলেজে আমার আর্দালি শামসুল খুব যত্ন সহকারে কাজটি করে আসছে সুদীর্ঘ কাল ধরে। আর রাতে হাফ প্লেট ভাত, মাছ অথবা মুরগীর ঝোল আর মুগ ডাল। পানি ছাড়া অন্য কোনো খাবারই আমি একবারের বেশী দুইবার রিপিট করিনা এক দিনে। এই একই রূটিন আমার ১৯ বছর ধরে চলছে। শীত,গ্রীষ্ম বর্ষা যাই হোক না কেনো। রুটিনের কোন পরিবর্তন নেই। আল্লাহর রহমতে আমার কোন অসুখ বিসুখ ও নেই। আমার কাছে কারো কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। আমার নিজেরো কারো কাছে কোন দাবী নেই। মাঝে মাঝে ভাবি কেনো যে সবাই বিয়ে শাদি করে। নিজের জীবন নিয়ে বড্ড সুখী আমি।
বিকেলের দিকটায় আমি একটু হাঁটতে বের হই। নিয়ম করে ঘাম ঝরানো হাঁটা বলতে যা বুঝায় তেমন কিছু না। এমনি একটু আয়েসি ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে গায়ে হাওয়া লাগানো আর কি। খুব বেশিদিন বাঁচার সাধ নেই আমার। তবে যে কয়দিন হায়াত আছে সুস্থ ভাবে বাঁচতে চাই। উজিরপুর খুব চমৎকার জায়গা। এখানকার মানুষেরা খুবই অমায়িক আর বন্ধুবৎসল। সপ্তাহের প্রতি রবিবার এখানে হাট বসে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সবাই সেখান থেকেই কিনে রাখে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই প্রচুর সব্জি ও ফলের গাছপালা আছে। নিজেরা খেয়েও সেসব তারা প্রতিটি বাড়িতেই পাঠায়। এলাকায় মাস্টারি করার সুবাদে আমার কাছে সে-সব প্রচুর পরিমানে আসে। আমি তার তেমন কিছুই খেতে পারিনা। আমার আর্দালি শামসুলকেই দিয়ে দেই। ওর বাসা আমার বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। উজিরপুরে আমার সুখে দুখের সঙ্গী বলতে এই লোকটা ছাড়া আর কেউ নেই। শামসুলের বয়স নেহায়েত কম নয়। পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে বেশ কয়েকবছর আগেই। গত শীতে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিলো। সাধ্যাতীত আয়োজন করেছিল। আমি সহ কলেজের সব শিক্ষক কর্মচারীদের দাওয়াত করেছিল। আদর আপ্যায়নের কমতি রাখেনি সে তার সীমিত সামর্থ্যের মাঝেও।
এই অঞ্চলটা আমের জন্য বিখ্যাত না হলেও এখানে এসে থেকে আজ অবধি দেখছি প্রচুর আমের ফলন। আমের স্বাদটাও একটু অন্যরকম। কেমন যেন একটু নোনতা ভাব আছে আর এটাই স্বাদটাকে শতগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর দেখা যায় আনার। এখানে এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে আনার গাছ নেই। এটা খুবই দীর্ঘজীবী গাছ। এখানে আমি নিজেই একশো বছরের বেশি বয়সের আনার গাছ দেখেছি। সবচেয়ে পুরাতনটির বয়স কম করে হলেও দেড়শোর কাছাকাছি হবে। আমার বন্ধু আনোয়ার বোটানির নাম করা অধ্যাপক। তাকে দিয়ে আমি পরীক্ষা করিয়ে দেখেছি। কথার সত্যতা আছে।
আমার সহকর্মী অন্যান্য শিক্ষকদের কেউ আমাকে তেমন একটা পছন্দ করে না। কারনটা আমি অনেক গবেষণা করেও ধরতে পারিনি। হয়ত আমার এই স্বাধীনচেতা স্বভাব আর জীবনযাপন তাদের ঈর্ষান্বিত করে তুলেছে আমার প্রতি। শামসুল আমাকে অনেক বছর আগেই সাবধান করেছিল আমি ওর কথা তেমন একটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু এর জন্য আমাকে চরম মাশুল দিতে হয়েছিল। আমি একা থাকি। অকৃতদার মানুষ। পারতপক্ষে কারো সাতেপাঁচে নেই। এই আমাকেই কিনা তারা চরিত্রহীন বানানোর অপচেষ্টা করেছিল। সে-সময় অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। সুখের কথা সেই দুঃসহ দিনগুলো আমি পার করে এসেছি তাই সে-সব কথা এখন না বলাই ভাল। কিন্তু সেই সময়ের স্মৃতিগুলো আজও আমাকে দুঃস্বপ্নের বেশে তাড়া করে ফেরে। যাক সে-সব কথা। দিন গড়িয়েছে অনেক আর সময়ের সাথে সাথে স্মৃতির পাতায় ধুলো জমে গেছে।
আর একজন মানুষের সাথে আমার বেশ কথা বার্তা হয় সে হলো মলয়। বছর চল্লিশের মতো বয়স। গোলগাল গড়নের হাসিখুশি মানুষ। পারিবারিকভাবে দুধের ব্যবসায়ী। বর্তমানে প্রায় ত্রিশটার মতো গরু আছে ওদের। মলয় আর তার একমাত্র ছেলে ফটিক মিলেই সব দেখাশোনা করে। মলয় এখন আর সবার বাড়িতে দুধ দিতে যায় না। এলাকার চেয়ারম্যান আর আমার বাড়িতেই শুধু আসে। বাকিটা ওর ছেলে ফটিক কাভার করে। আমাকে মাঝেমাঝেই নিজের অনেক কথা বলে মলয়। একাত্তরে তার পরিবারের সবাই ইন্ডিয়া চলে গেলেও সে আর তার স্ত্রী রয়ে গিয়েছিল। জন্মভূমি ছেড়ে যেতে তাদের মন সায় দেয়নি। এর পরে কেটে গেছে দশ বছর। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করতে হয়েছে তাকে ও তার পরিবারকে। গ্রাম্য ও অশিক্ষিত মানুষ হলেও মলয় আশ্চর্যজনকভাবে অসাম্প্রদায়িক। মুসলমানদের প্রতি তার কোন বিদ্বেষ কোনদিন দেখিনি। মলয়ের সবচেয়ে বেশি বলা গল্প হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানকার বড় মসজিদের হুজুর কিভাবে নিজের জীবন বাজী রেখে সে ও তার স্ত্রীকে বাঁচিয়ে ছিল সেই গল্প। এছাড়াও তার অসংখ্য গল্প আছে তবে সেগুলোর সবই গরু কেন্দ্রিক। মলয় বেশ ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তার বাপ দাদার আমল থেকে চলে আসা বিভিন্ন রকমের পূজা আনুষ্ঠানিকতার বিস্তারিত বর্ননা সে আমাকে দেয়। যদিও তার কোনকিছুই আর এখন হয় না। মানুষের বিশ্বাস যে এখন আর নেই এই নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই তার। মনের কথা বলার মত কেউ তারও নেই এখানে। স্ত্রী মারা গিয়েছেন গত বছর। ছেলেটাও বড় হয়ে গেছে বলে আর কাছে আসতে চায়না! আমার মতই একাকী সে।
বেশ কিছুদিন থেকেই একটা জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে ইদ্রিস নাকি আবার বিয়ে করতে চলেছে। আর সবার মতন আমিও ভিষণ অবাক হলাম এই বয়সে আবার! আজ শুনলাম আগামী শুক্রবার বিকেলে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। দুপুরের পরে যখন কমন রুমে বসে ক্লাসের ফাঁকে অলস সময় পার করছিলাম তখন দেখলাম ইদ্রিস কেমন যেন লাজুক ভংগিমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। আমি বেশ বুঝলাম যে সে আড়চোখে আমাকেই দেখছিল। নাহলে সাথে সাথেই কিভাবে বুঝল যে আমি তাকিয়েছিলাম। আমি তাকে ভেতরে ডাক দিলাম। কাচুমাচু করতে করতে সে ভেতরে আসলো। ভেতরে এসে সে আবার এক কোনায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি ওর চোখ দেখেই বুঝলাম কিছু একটা বলতে চায়।
-কি হে ইদ্রিস কেমন আছ?
-জ্বি ভালো আছি স্যার। আপনি স্যার কেমন আছেন?
-আমি একা মানুষ ভালই থাকি।
হঠাৎ ইদ্রিস আমার কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-স্যার আমার খুব বিপদ।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-শুনলাম বিয়ে করছো, এটাই কি বিপদ?
ইদ্রিস লজ্জা আর ভয় মিশ্রিত একটা অভিব্যাক্তি দিয়ে বললো,
-না স্যার অন্য ব্যাপার। আপনি আমার সাথে একটু বাইরে আসেন।
আমি কোন কথা না বাড়িয়ে ওর সাথে কমনরুম থেকে বের হয়ে করিডোরে গেলাম। সেখানে পাতা গদিওয়ালা বেঞ্চে ওকে বসতে বলে আমিও পাশে বসলাম। ইদ্রিস আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললো,
-স্যার দয়া করে আমার কথা বিশ্বাস করবেন। কাউরে বলিনাই কারন জানি কেউ বিশ্বাস করবো না।
-ভনিতা ছেড়ে এবার আসল কথাটা বলো ইদ্রিস। আমার ক্লাশ আছে একটু পরে।
একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম কথাটা। সে কেমন যেন মিইয়ে গেলো আমার কথায়। আমার নিজেরই একটু খারাপ লাগলো এভাবে বলে। বেচারা ভরসা করে আমার কাছে এসেছে! ইদ্রিস কানের কাছে মুখ এনে যা বললো তাতে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড় হলো।
-স্যার তেরো বছর আগে মইরা গেছিল সেই বড় বৌ বিলকিসরে আমি গত সপ্তাহ থেইকা দেখতাছি।
-আরে কি বলো! সেটা কিভাবে সম্ভব। মৃত মানুষ কিভাবে আসবে। তুমি হয়ত তার কথা বেশি ভাবার কারনে ভুল দেখছো।
-স্যার আমি আগেই জানতাম আপনে আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তাই সাথে কইরা নিয়া আইছি!
হতবাক হয়ে বললাম,
-সে কি কোথায় সে?
-এই যে আমার বাম পাশেই বইয়া রইছে!! কেউ হেরে দেখে না কিন্তু আমি দেখি।
আমি আতংকিত হয়ে উঠে পড়লাম! বলে কি এই লোক!! পাগল হয়ে গেছে নাকি। আমি ওপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না।
চলবে....
© bnbooks.blogspot.com