-স্যার,আপনি কি ভাবছেন আমি আমার স্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছি?এতটা নিষ্ঠুর আমি!
-আপনার সাবেক প্রেমিকা এখন কলগার্ল৷ পতিতালয়ে পচে মরছে। ওর জন্যে আপনার চোখে বিন্দুমাত্র মায়াও দেখলাম না। মানুষকে দ্বারা অবিশ্বাস্য বলতে কিছু নাই।
-ও আর সেই আগের মাধবী নেই। পরিচয় না দিলে চিনতেও পারতাম না। রঙচঙে চেহারা, উদ্ভট সাজপোশাক। ওকে মিস চুমকি নামে মানিয়ে গেছে।
-আর আপনার স্ত্রী যে আগুনে পুঁড়ে আত্মহত্যা করেছে তার জন্যে মায়া হয়?
রাজীব সাহেব চমকে তাকাল।
-আপনি একটু বসুন প্লিজ।
ভদ্রলোক চলে গেলেন।দুই মিনিট পর ফিরলেন। হাতে নীল মখমলের কাপড়ে মোড়া অ্যালবাম।
-বিয়ের পর বন্ধুবান্ধবকে বাড়ির ত্রিসীমানায় আনতাম না। আত্মীয়স্বজন খুব কম আসত। কেন যেন,নীরাকে লোকচক্ষুর মুখোমুখি করতে ভয় হত খুব। লোকে যেমন সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন সিন্দুকে লুকিয়ে রাখে তেমনি নীরাকে আড়ালে রাখতাম। ওর সমস্ত ছবি পেনড্রাইভে ছিল, ওর মৃত্যুর পর অ্যালবামে সাজিয়ে রেখেছি। আমাদের ব্যক্তিগত অ্যালবাম,আপনাকে প্রথম দেখাচ্ছি।
দেখলাম, রাজীব সাহেবের গলা ধরে টুকটকে লাল বেনারসি গায়ে একটা মেয়ে মিটিমিটি হাসছে। তীক্ষ্ণ নাক, বাঁকা ভ্রুর নীচে আল্পনায় আঁকা চোখ। আমি দেখলাম যুবতী বয়সের শ্যারন স্টোনকে। এমন সুন্দরী স্ত্রীকে লুকিয়ে রাখতে চাওয়া অসঙ্গত কিছু নয়। মুগ্ধ হয়ে বললাম,
-আপনাদের দুজনকে চমৎকার মানিয়েছে,রাজযোটক।
-আপনি পরের ছবিগুলোও দেখুন।
অ্যালবামের পাতা উল্টালাম। নবদম্পতি মেঘালয় ঘুরতে গেছে, কাশ্মীর তারপর বেনারস। রঙবেরঙের ছবি। দুজনের প্রেমময় মুহূর্ত। তারুণ্যের সবচেয়ে বড় উপহার প্রাণপ্রাচুর্যময় হাসি। আমি উপভোগ করছিলাম। পিছনের ছবিতে নীরা একা। পেটে হাত। মুখে সলাজ হাসি।
রাজীব সাহেবের দিকে তাকালাম,
-জ্বী। ওর কনসিভ করার পর তোলা।ফটোগ্রাফার আমি।
-আচ্ছা।
-পরের ছবিগুলোতে নীরার মুখ মলিন। চোখের নীচে কালি। শরীর শুকিয়ে গেছে। কয়েকটা ছবি হাসপাতালের নীল পোশাক। চোখমুখে আতঙ্ক। কেমন গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে।
রাজীব অধোমুখে বলল,
-ওর অসুস্থতার সময় তুলে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, বাচ্চা বড় হলে ছবি দেখিয়ে বলব,দেখ বাবা, তোর মা তোকে জন্ম দিতে গিয়ে কতটা কষ্ট করেছে। সৌভাগ্য হল না।
-নীরা আত্মহত্যার সময় ওর গর্ভে বাচ্চা ছিল?
-না। তার কয়েকদিন আগেই মিসক্যারেজ হয়ে যায়। প্রথমবার আমার দোষ ছিল বলে পরেরবার যথাসাধ্য যত্ন নিয়েছিলাম। কিন্তু বাথরুমের পিচ্ছিল মেঝে আমাদের সর্বনাশ করে। নীরার খুব পরিষ্কার থাকার বাতিক ছিল , বাথরুমের মেঝেতে চুল মাখার তেল কিভাবে পরল কে জানে! কপালে দূর্ভাগ্য লেখা থাকলে যা হয়।
রাজীব সাহেবের স্ত্রীর করুণ কাহিনীর চেয়ে একটা ছবি বেশি আকর্ষণ করছিল। একটা ছবি, নীরা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শরীর শুকিয়ে কঙ্কালটপ্রায়। হাড় ক'টা গোণা যায়। নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে বেশ ব লালচে ঘা। ছবিতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পিছনে একটা ভয়ঙ্কর কালো মুখ৷ বিষাক্ত সরীসৃপ দেখলে যেমন শরীর হাত পা রি রি করে তেমন অনুভূত হচ্ছিল।
-এটাই পদ্ম?
-হু।
-পদ্মর কোথায় আছে কোনো খোঁজ আছে আপনার কাছে?
-জ্বী না।নীরার মৃত্যুর পর ওকে গ্রামে দিয়ে আসি। শুনেছি সেখান থেকেই নিঁখোজ হয়। থানায় জিডি করতে ওর পরিবার সম্মত হয় নাই। পদ্ম দীর্ঘদীন বাড়ির বাইরে থাকায় পরিবারের কেউ ওকে আপন ভাবে না। ওর খোঁজ পাওয়া মানে একটা বাড়তি মানুষের অন্ন যোগান দেওয়া।
-ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র!
-কিছুই নাই। আমার ধারণা ও হারিয়ে যায় নাই সব নিয়ে ভেগেছে। এছবিটা হঠাৎ ফোনের ক্যামেরায় পদ্মর অগোচরে তোলা। পদ্ম ছবি তুলতে চাইত না।
এই একটা ছাড়া ওর আর কোনো ছবি নাই।
-আপনার স্ত্রীর ঘরটা দেখানো সম্ভব হবে?
-জ্বী।অবশ্যই আসুন।
বসার ঘরের পর গেস্টরুম। লম্বা করিডোর পাড় করে উনাদের শোবার ঘর। দরজা ভেজানো। রাজীব রহমান বললেন,
-দেখবেন, দরজা খুললেই কি অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। নীরার গায়ের ঘ্রাণ সারা ঘরে জড়িয়ে আছে।
দরজা খুলে রুমে ঢুকে রাজীব সত্যি নাক টেনে সুবাস নিল। আমি কোনো ঘ্রাণ পেলাম না। মেয়েলি হাতে পরিপাটি সাজানো ঘর। একটা দেয়াল দুজনের বিয়ের বিশাল ছবি ফটোবন্দী হয়ে অতীতে আটকে আছে। ড্রেসিংটেবিলের পাশে বেডটেবিলে কয়েকটা রঙিন কাঁচের জার থেকে কৌতুহল লাগল।
-এগুলো কি?
-ওহ! নীরার শখের জিনিস। এর ভেতর বকুল ফুল,কাঠগোলাপ মমি করে রেখেছে। ফুলের মমি। ফুলগুলো পদ্ম সংগ্রহ করে এনে দিয়েছে।
কাছে গিয়ে হাতে নিলাম। ফুল বলেই গন্ধ শুঁকলাম।
সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। ছিপি খুলে ঝাঁকি দিতে সাদা পাউডারের মত বস্তু মেঝেতে ছড়িয়ে পরল। ছাব্বিশ বছর ধরে মানসিক রুগী নিয়ে আদিনক্ষত্র বিচার করায় এবস্তু সাথে সাথে চিনে ফেললাম।বেনজয়েলমিথাইলএকজোনিন।কিছুটা অদলবদল করে যাকে আমরা চিনি কোকেইন নামে।
ব্যাপারটা স্রেফ চেপে গেলাম।
-নীরা মেডিসিন নিত?
-হ্যা।
-দেখি।
গর্ভবতী মায়েদের ফলিক এসিড, ভিটামিন ট্যাবলেটের পাশে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ।
-ওর শ্বাসকষ্টের রোগ ছিল বা এলার্জি?
-না। তবে মাইগ্রেনের ব্যথা ছিল।
-রাজীব সাহেব, আপনি আমার সাথে এক সপ্তাহ পর দেখা করুন। ততদিন দয়া করে আপনি এঘরে ঘুমাবেন না।পদ্ম নামের মেয়েটা আপনার স্ত্রীকে কোকেইনের নেশা করতে সাহায্য করত। ব্যাপারটা আপনার স্ত্রী জানে নাকি সম্পূর্ণই পদ্ম দায়ী বুঝতে পারছি না। ফুলের ভেতর পাউডার। আরো কয়েক জায়গায় পাউডার লুকানো আছে নির্ঘাত। নীরার নাকের কাছে ঘা দেখে তখনই সন্দেহ হয়েছিল। আপনি যে এঘরে স্ত্রীর ঘ্রাণ পান তা আসলে কোকেইনের বাষ্প। আপনারও নেশা হচ্ছে। সুতরাং এই ঘর আজ থেকে তালাবদ্ধ।
রাজীব সাহেবের চোখ বিস্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে
আসছে। আরো কিছু প্রশ্ন করত। সুযোগ দিলাম না। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসলাম। একটার পর একটা রহস্য আমারই মাথা ঘোরাচ্ছে।
...
পদ্মর একমাত্র ছবি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম রাত বারোটায়। ছেলের মা না খেয়ে অপেক্ষা করে আছে। রাতে খাবার মুড ছিল না কিন্তু ও অপেক্ষারত চেহারা দেখে না করতে পারলাম না। ভুলে গিয়েছিলাম, আজ আমাদের বাইশতম বিবাহবার্ষিকী। টেবিলে সাজানো চিংড়ি মাছ দিয়ে পুঁই শাক চচ্চড়ি, বেগুন ভর্তা, দেশী মুরগির ঝোল, লইট্টা শুটঁকি ভুনা আর মাষকলাইয়ের ডালের আয়োজন দেখে মনটা আনচান করে উঠল। কাজের চাপে নিজেদের ব্যক্তিগত উৎসবগুলো প্রায়ই ভুলে যাই। সন্তানের মা তাই আশাও করেন নাই আমি উপহার নিয়ে আসব কিন্তু স্বামীর পছন্দমত খাবারের আয়োজন করেছেন। খেতে বসতেই কড়কড়ে ভাজা ইলিশ মাছ আর এক চামচ ঘি আগুন গরম ভাতে ঢেলে দিল।
-লতা, তোমার জন্যে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া কিনেছিলাম।। সিএনজিতে ভুলে ফেলে এসেছি।
লতা সুন্দর করে হাসল,
-কেন মিথ্যা বলছ? ঝড়বাদলের দিনে রাত বারোটায় ফুলের দোকান খোলা থাকে না। আমার উপহার কালকে দিলেও চলবে।
মাথা নীচু করে খাচ্ছি। আমি পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট আর লতা ডিগ্রিধারী না হয়েও মনের অলিগলির সত্যমিথ্যা ঠিকই টের পেয়ে ফেলে।
-আজ রাতে তোমাকে একটা গল্প বলব। সত্যি বলব, মনোযোগ দিয়ে শুনবে। এত সুন্দর রান্না করে খাওয়ালে তাই এটা তোমার রির্টান গিফ্ট।
-আচ্ছা। আগে খাওয়া শেষ করো।
বেলকুনিতে দুজনে বেতের চেয়ারে আরাম করে বসেছি। বৃষ্টি নেই,দূরে কোথাও থেকে হাওয়া আসছে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমানোর আবহাওয়া। কাল সকালে অফিস। তবু বসলাম লতাকে সময় দেওয়া হয় না বহুদিন৷ লতা আমার পাশে থেকে ভালো শ্রোতা হয়ে গেছে। মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনল।মন্তব্য করল,
-তুমি শিউর,মেয়েটার হাতের মাংসের ভেতর সোনামুখি সুঁই পাওয়া গেছিল?
-হ্যা। রাজীব সাহেবের ডায়েরিতে তাই লেখা।
লতা কয়েক মুহূর্ত চুপ।
-আমার মনে হচ্ছে ব্লাকম্যাজিক। বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়ছিলাম,আমেরিকায় একজন সৎ বাবা তার দুই বছরের ছেলের সারা শরীর সুঁচে বিদ্ধ করেছিল। পরে পুলিশের জেরার মুখে স্বীকার করে তিনি ব্লাক ম্যাজিকের চর্চা করেন। আর ছেলেটাকে মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
- নয়ত পদ্ম মেয়েটা কেন নীরার ক্ষতি করবে? বাথরুমে তেল ছিটিয়ে রাখবে? ওর পরনের কামিজ ছিঁড়ে ফেলবে? ওকে ড্রাগের নেশায় পাগল করে ছাড়বে? তুমি নিজেই বলো।
উত্তর নেই। লতা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে গেল। আমি ল্যাপটপ নিয়ে আসলাম। সাথে রাজীব সাহেবের খাতা। আমার একজন বন্ধু আছে জুলহাস কবীর, অতিপ্রাকৃত বিষয়ে ওর আগ্রহ প্রচুর ওকেও নক করলাম। প্রায় আধাঘণ্টা ঘাটাঘাটির পর চমকপ্রদ তথ্য পেলাম।
ব্লাক ম্যাজিক এমনই এক নিষিদ্ধ চর্চা ওই কমিউনিটির লোকজন যতটুকু প্রকাশ করতে চায় ততটুকুই আমরা জানি। ওরা বস্তুত লুসিফার নামের শয়তানের পূজা করে এবং শয়তানের সাথে যোগাযোগের মিডিয়াম হিসেবে কিছু সাধারণ মানুষকে বেছে নেয়। এরা স্কপোলামিন, এসএসডি, গাজা বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্যের সাহায্যে মিডিয়ামের হ্যালোসিনেশন ঘটায়। আর তন্দ্রাচ্ছন্ন মিডিয়াম তখন পরাবাস্তব জগৎ চোখের সামনে দেখতে পায় এবং তাদের বিশ্বাসমতে সাক্ষাৎ শয়তান মিডিয়ামের দেহে এসে ভর করে। শিউরে উঠার তথ্য হল, এইসব মিডিয়াম কাজ করে অনেকটা দম দেওয়া পুতুলের মত। নিজের দেহকে ক্ষতবিক্ষত করা, সন্তানদের গলা টিপে ধরা এমনকি কাছের মানুষকে হত্যা করার মতও তথ্যও রয়েছে। এরা যতই নিকৃষ্ট কাছে ধাবিত হয় লাভ হয় ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানদের। এমনও উদাহরণ আছে,একজন সুস্থ সবল কানাডিয়ান মা তার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছে। হুট করে একদিন ছোট ছেলের শরীর সবজি কাটার ছুরি দিয়ে চার টুকরো করে ফেলে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়,সাইকিয়াট্রিস্ট এসে ঘোষণা দেয় ভদ্রমহিলা সাইকো। মাথায় সমস্যা আছে।ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারে না তিনি হয়ত মনের অজান্তে ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানের খপ্পরে পরে মিডিয়ামের কাজ করে যাচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে পত্রপত্রিকায় দু'চারদিন লেখালেখি হয়,তারপর নিশ্চুপ।উপরন্তু মহাপ্রভুকে সন্তুষ্টি করার উদ্দেশ্য প্রিয়বস্তুকে বলি দেবার চর্চা আদিমকাল থেকে হয়ে এসেছে। পশ্চিমা দেশে পোষ্য প্রাণীকে ভালোবাসা হয় সন্তানতুল্য। তাই পোষা কুকুর,বিড়ালকেও বলি হিসেবে ধরা হয়।
-আর আমাদের দেশে! আমি যদি আদিম ভারতীয় সভ্যতার বিষকন্যাদের এখনও লালন করা হয়। পত্রিকার পাতা খুললে দেখতে পান গৃহকর্মী দুই বছরের শিশুকে হত্যা করে আলমারি লুট করে টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়েছে। বিবেচনা করে দেখেছেন কি,
-বাবামা দুজনেই চাকুরীজীবী। দুধের শিশুকে আয়ার ভরসায় রেখে গেছে। দুই বছরের বাচ্চা সাক্ষী দিতে পারবে না। তবে স্বর্ণগহনা হাতিয়ে নেবার সময় বাচ্চাটাকে খুন করবার কি দরকার ছিল!
-উত্তর নেই।
আমরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাই না। এড়িয়ে যাই।
রাতে ঘুম হল না। সকালে চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েও ক্লিনিকে ঢোকা হল না। মাইকো ভাড়া করে জুলহাসকে নিয়ে চলে গেলাম সোজা নেত্রকোণা। কেন্দুয়া থানার সরিষাহাটি গ্রাম। নীরার দাদারবাড়ি খুঁজে পেতে দশ মিনিটও লাগল না। গ্রামের বাড়ি এই এক সুবিধা, সবাই সবাইকে চিনে। তারা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পক্ষ শুনে যথেষ্ট আদরযত্ন করল। চা-নাস্তা খাবার পর পদ্মর মায়ের খোঁজ করলাম।
জীর্ণ শাড়ি পরা বয়স্কা একজন বৃদ্ধা মহিলা লাঠি ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাজির হল। বয়স পঞ্চাশ হয়েছে কি হয় নাই রোগেশোকে ষাটোর্ধ্ব দেখায়।এসেই মরাকান্না জুড়ে দিল। নীরাকে তিনি নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন। ফুলের মত মেয়েটার প্রাণ অকালে ঝরে গেল। কান্নার রেশ কিছুটা কমতে কথা বললাম,
-আপনের মেয়ে পদ্ম ওকেও তো খুঁজে পাওয়া যায় না।
-কে? ওই কালিবেটি আমার পদ্ম না।
-কি বলছেন?
-হ। পদ্মর পিঠে রাজহাঁসের ডিমের লাহান এত্তবড় জন্মদাগ আছিল।এই মাইয়ার কিছু নাই।
-একথা নীরা জানত?
-ওগো বাড়ির কেউই জানত না। আমিই নীরার চল্লিশার দিা কলপাড়ে ওরে উদাম গোসল করতে দেইখা প্রথম দেখলাম। চুলের মুঠি ধইরা টাইন্না কইছি ওই বেটি তুই কেডা?
কিছু কয় না। খালি কান্দে। হেইদিন রাইতেই দেখি মাগী উধাও। আর আহে নাই।
টলতে টলতে গাড়িতে উঠলাম। পদ্ম আসলে পদ্ম নয়। যেই মেয়েটা পদ্মর পরিচয়ে নীরার ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল সে তাহলে কে? কেনই বা গর্ভে বাচ্চা নষ্টের মত এতবড় ক্ষতি করে যাবে মাথায় ঢুকছিল না। গাড়িতে বসে রাজীব সাহেবের খাতার শেষ কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করলাম,
নীরা হসপিটাল ফিরে এল ট্রমাটাইজ হয়ে। যা মুখে দেয় তাই বমি করে ফেলে দেয়। হা করে নিশ্বাস নেয়। শোবার ঘর থেকে বের হলেই ওর প্রাণ হাঁসফাঁস করে। যখনি ওর কাছে যাই দেখি ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। দরজা -জানালা বন্ধ। ধুনুচির মত ছোট্ট মাটির হাড়িতে ধূপ জ্বলছে। আবদ্ধ ঘরে ধূপের গন্ধ আর ধোঁয়া মিলে অশরীরী অবয়ব তৈরি করে। আমার নিজেরই কেমন ভয় ভয় করত। নীরা নির্বাক। ওর ধূপের গন্ধ এক প্রকার নেশা হয়ে গেছে। শ্বাস টেনে ঘ্রাণ নেয়।
-স্বামী, স্বামী! কাছে আসো।
কাছে গেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
-ভালোবাসো?
-খু্ব।
-আমিও তোমায় ভালোবাসি। আমার বাচ্চাটাকে ওকে আরো বেশি ভালোবাসি। ওতো বাঁচবে নাগো।
-ছি! নীরা। এসব কি বলছ?
-সত্যি বলছি।
-নীরা ঢুকরে কেঁদে উঠে।
-পেটের ভেতর কালসাপ বড় হচ্ছে। ও সুযোগ পেলেই আমার বাবুটাকে ছোবল মারবে।
-নীরা,এসব কে বলেছে তোমাকে?
-আমি স্বপ্নে দেখেছি,বিশ্বাস করো মিথ্যা স্বপ্ন নয়। হাত বাড়িয়ে বাবুটার আঙুল ছুঁয়ে দেখছিলাম।
বলতে বলতে নীরা কান্নায় ভেঙে পরে। দরজার পাশে পদ্ম এসে দাঁড়ায়। নীরা চুপ।দ্রুত আমার আলিঙ্গন মুক্ত হয়।
-তুমি যাও,এখন আমি ঘুমাব।পদ্ম আয়,আমার মাথা টিপে দে।
ওর মিসক্যারেজ হয় শুক্রবার। আমি সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। নীরার অভ্যাস ছিল গোসল সেরে বাথরুমের ভেতর থেকেই চুল আঁচড়ে বাহিরে আসা। প্রেগন্যান্সির পর থেকে ভীষণ চুল উঠছে। । সারাবাড়ি ওর বড় বড় চুলে মাখামাখি হয়ে থাকত,ঝাড়ু দিতেও ঝামেলা হয়। বাথরুমে চুল আঁচড়ালে নাকি ঘর নোংরা কম হয়। তাই ওর যাবতীয় প্রসাধনীর সাথে নারিকেল তেলের বোতলও বাথরুমে থাকত। অসতর্কতা বশত সেদিন তেলযুক্ত পিচ্ছিল মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পরে। একটা আর্তনাদ বাথরুম থেকে ভেসে আসলে দৌঁড়ে যাই।।বাথরুমের দরজা খোলা।নীরার শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এত রক্ত আমি জীবনে কখনও দেখি নাই। ওকে হসপিটালে নিয়ে ছুটোছুটি করতে গিয়ে দেখি আমার কোমরের নীচ থেকে পা অবধি অবশ হয়ে যাচ্ছে। শক্তি পাচ্ছি না। একবারও মাথায় আসে নাই নীরাকে মাথায় তেল দিয়ে দিত পদ্ম, ওই জাহান্নামি মেয়েটাকে কি তেল ছিটিয়ে রেখেছে! নীরা আত্মহত্যা করে তার এক সপ্তাহের মাথায়। গাইনোকোলজিস্টের কাছ থেকে রির্পোট নিয়ে ড্রয়ারে লুকিয়ে রেখেছিলাম। নীরাকে দেখাই নি ওর গর্ভে টুইন বেবি বড় হচ্ছিল, যার একটার অবশিষ্টাংশ এখনও রয়ে গেছে। আবার ডিএনসি করাতে হবে।
নীরার শরীরে তখন প্রবল জ্বর। ব্লিডিং চলছে। শূন্য দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। খেতে দিলে খায়,ঘুমাতে বললে ঘুমায়।চোখ দিয়ে পানি জমে না, এক প্রকার পাথর হয়ে গেছে। ওর মাথায় হাত রেখে ধীরে ধীরে বললাম,
-নীরা,আমাদের আরেবার হসপিটালে যেতে হবে।
নীরা হাসছে। ওর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।তবু ঠোঁটে হাসি।
-কেমন মা আমি সন্তানকে রক্ষা করতে পারলাম না।
-আমাদের আবার সন্তান হবে নীরা। তুমি মা হবে।
-
-মা হব! প্রথম বেবি তুমি নষ্ট করেছ আমি রক্ষা করতে পারি নাই। এরপরের একজন পেটের ভেতর মরেই গেল অন্যজন তো বেঁচে আছে। তুমি বলো?
-তুমি রির্পোট দেখেছ?
-হু।
-নীরা। সামান্য একটু মাংসপিণ্ড রয়ে গেছে। যা তোমার জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। ডাক্তার আজকে গেলে সিদ্ধান্ত নিবেন ঔষুধের মাধ্যমেই ক্লিয়ার হবে নাকি ডিএনসি...
নীরা আমার কথা শেষ করতে দেয় না।
-তুই একটা অমানুষ। মাংসপিণ্ড বলার তুই কে রে? এটাই আমার সন্তান।
ওর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ওর মা আমার মা ছুটে আসে। ও তখন মৃগী রুগীর মত হাতপা ছুঁড়ছে। পরদিন রাতেও নীরাকে বোঝাই। ও অবুঝ শিশুর মত পাগলামি শুরু করে কিছুতেই আর হসপিটালে যাবে না। তারপরের রাতেই দূর্ঘটনা। হাসতে হাসতে শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেয়।কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার তিন বছরের সাজানো সংসার ছিন্নভিন্ন। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই নীরার চুল পুঁড়ছে,শরীর পুঁড়ছে আমি জাপ্টে ধরে আছি।নীরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে,
-স্বামী,মাফ করে দাও। আমার বাচ্চাগুলো আর মা ছাড়া থাকতে চাইছে না...
রাজীব সাহেবের সাথে আর কোনোদিন আমার দেখা হয় নি। তাকে সাতদিন পর চেম্বারে দেখা করতে বলেছিলাম।তার বদলে চিরকুট আসে,
-স্যার,ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে চলে যাচ্ছি। নীরাকে ছেড়ে পৃথিবীর কোনো কোণায় আমি শান্তি পাব না তবু যেতে হবে। কোকেইন খেয়ে নেশা করবার মত মেয়ে আমার স্ত্রী ছিল না।ধূপের ধোঁয়া বলে পদ্ম নামের ডাইনীটা ওকে নেশা করতে বাধ্য করেছে। জানি না, কোন অপরাধে একটা ছোট মেয়ে আমাদের সংসার ধ্বংস করে দিল। প্রতিজ্ঞা করেছি, ওকে কোনোদিন চোখের সামনে পেলে খুন করব আমি। ও মানুষ নয় পিশাচ।আপনি ভালো থাকবেন
-রাজীব রহমান।
-
পদ্ম মানুষ নাকি পিশাচ সেই ভাবনা বহুরাত আমাকে ঘুমাতে দেয় নাই। রাজীব রহমান উনার স্ত্রী নীরা সবাইকে আমি ভুলে গেছি কিন্তু পদ্মকে নয়। ওর ছবি এখনও আমার ডায়েরি পাতায় ট্যাপ দিয়ে আটকানো। কালোমতন অল্পবয়স্ক মেয়ে হলেই চেয়ে দেখি পদ্ম নয়ত!পাঁচ বছর পর কল্যাণপুর বাস কাউন্টারে বসে আছি। উদ্দেশ্য সিলেটগামী গ্রীন লাইন পরিবহনের টিকেট কেনা।একজন সুন্দরী মহিলা পাশে এসে বসল।ভদ্রমহিলার সাথে স্কার্ট পরা আরেকজন কিশোরী।হাতে পানির বোতল। ভদ্রমহিলা বলছে,
-রিয়া,পানি বসে খেতে হয়। গলায় পানি আটকাবে। বসে খাও।
আমার স্মৃতিশক্তি কখনই বিশ্বাসঘাতকতা করে না। একেবারে চোখের দেখাই বলছে রিয়া নামের মেয়েটিই আমার ছবিতে দেখা পদ্ম। কুচকুচে কালো রঙ, কোঁকড়ানো চুল। চোখের নীচে তিলটা পর্যন্ত ঠিক আছে। পাঁচ বছরে মেয়েটা লম্বায় অনেকখানি বেড়ে উঠেছে।পদ্ম মানে রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা কিছুর স্রোত অনুভব করলাম।কথা বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেছে, আমতা আমতা করে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-এ আপনার মেয়ে?
- হ্যা। আমি চুমকি আমার মেয়ে রিয়া।
আরেকবার ঢোক গিললাম,
-আপনি চুমকি! কিছু মনে করবেন না আপনার চেহারার সাথে মেয়ের চেহারার একটুও মিল নাই।
চুমকি হি হি করে হেসে উঠল,
-সবাই একই প্রশ্ন করে। শুনতে শুনতে কান পচে গেল। ও দেখতে ওর বাবার মত হয়েছে।
-ওর বাবার নাম..
-রাজীব রহমান।
দুই সেকেন্ড দাঁড়াই নাই। সেদিন আর সিলেট যাওয়া হল না। বাড়ি ফিরলাম।লতা বলল,
-এমন ঘামছ কেন? কি হয়েছে?
-মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল,পদ্ম...পদ্ম রাজীবকে ডাকত আব্বা বলে আর নীরাকে আম্মা।
-পদ্মটা আবার কে?
-কেউ না। কিছু মানুষের পরিচয় জানতে হয় না।
© bnbooks.blogspot.com