বলছিলাম আমার স্ত্রী এর আগেও দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। একবার একগাদা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে আরেকবার সবজি কাটার ধারালো ছুরি দিয়ে বা'হাতের শিরা কেটে ফেলে। তাই হয়ত ওর হাত সুঁচ ফুটানো দেখে তত বেশি অবাক হই নাই।নীরা কনসিভ করার পর ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না৷ নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে কাছের মানুষকে মেন্টালি টর্চারে রাখা ওর একধরনের মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে।
তবু ওর প্রতি বিতৃষ্ণায় মন ভরে উঠল।
-ওর গর্ভে আমাদের বাচ্চা। কেমন মেয়ে ও সন্তানের কথা ভাবে নাই!
দু'দিন পর হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে এলাম। আত্মীয়-স্বজনেরা দেখতে হল।আমার মা এল গ্রাম থেকে তাবিজ আর পানি পড়া নিয়ে।
-বউকে দু'বেলা নিয়ম করে পানি খাওয়াবি আর এটা গলায় বেঁধে দিবি।
নীরা আপত্তি করল না। শুধু তাবিজ হাতে নিয়ে করুণ চোখে তাকাল,
-তুমি বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছাকৃত সুঁচ ফোটাই নি।
-নীরা, তাবিজটা পরে নাও।
-আমার উপর জ্বীন-ভূতের আছর এটা মনে করছ!
অনেকদিন পর নীরার পাশে বসলাম।
-নীরা তুমি অসুস্থ। গর্ভে সন্তান এলে হরমোনের পরির্বতনের কারণে অনেক মায়েদের মানসিক ডিজঅর্ডারের মত দেখা যায় অনেকটা সিজোফ্রেনিয়ার মত। এটা খুব কমন সমস্যা। এটাকেই আগের যুগের মানুষেরা বাতাস লাগা, কুদৃষ্টির প্রভাব ইত্যাদি বলে মনে করে!
-আমি সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছি কে বলছে তোমাকে তোমার জ্ঞানী বন্ধু, আফসারী।
-প্লিজ!
নীরা ফুসতে ফুসতে বলল,
-ওই ছাগল নিজে পাঁচ বছর ধরে লিভ ইনে আছে মেয়েটাকে বিয়ে করছে না আর তোমাকে বউয়ের কিভাবে যত্ন নিতে হয় শেখাতে আসছে! তুমি আমার সামনে থেকে দূর হও। আর পদ্মকে বলবে চিনি কম দিয়ে কাগজি লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসতে। আমি এখন ঘুমাব।
আমি নীরার ঘর থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নীরাকে ডাক্তার দেখাব। মানসিক রোগের চিকিৎসক। আফসারীর দেওয়া আপনার ভিজিটিং কার্ড তখন আমার পকেটে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস নীরাকে আসতে হল না আমিই এসে উপস্থিত হলাম।
আরো কয়েক পৃষ্ঠা গোটা গোটা অক্ষরের লেখা। ভোর সাড়ে চারটা বাজে। আর পড়ার রিস্ক নিলাম না। সকালে চেম্বারে বসতে হবে। ফজরের নামাজ শেষ করে কয়েকঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে হবে নতুবা অফিসে ঝিমুনি আসবে।
ঘুম থেকেই প্রথমে যা করলাম তা হচ্ছে আফসারীকে ফোন করা। ও সকাল সকাল আমার ফোন পেয়ে চমকে উঠল।
-স্যার, কোনো দুঃসংবাদ?
-না। তোমার বন্ধু রাজীব রহমানের বাড়ির অ্যাড্রেস ম্যাসেঞ্জারে পাঠাতে পারবে?
-অবশ্যই।
-ওর স্ত্রী মারা গেছে কতদিন হল?
-প্রায় সাত-আটমাস তো হবেই।
-ওদের বাড়ির কোনো পরিচারিকাকে দেখেছ? অল্পবয়স্ক, কালোমতন!
-পদ্ম!
-হ্যা।পদ্ম। ও এখন কোথায়?
-জানি না। ভাবী মারা যাবার পর জানাজার দিন দেখেছিলাম। এক কোণায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বিকট দর্শন বলেই এখনও মনে আছে। কেন বলুন তো?
-পরে জানাচ্ছি।
বিকেলে ঝরঝর বৃষ্টি। আমার ক্ষেত্রেই এমন হয় প্রকৃতি অবিচার করে বসে৷ দু'চারটা রোগী দেখে সারাদিন অবসর কাটালাম যেন মাথা ঝরঝরে থাকে। রাজীব রহমানের নামের হাঁটুর বয়সী একটা ছেলে আমার সাথে গেমস খেলছে। এরকমই হয় ভীষণ বুদ্ধিমান মানুষ বুদ্ধিমত্তা শো করতে গিয়ে আচমকা ভুল করে ফেলে। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে রাজীব রহমান তার স্ত্রীর আত্মহত্যার পিছনে প্রধান কালপ্রিট। পদ্ম, ফদ্ম এসব বাজে কথা। একটা কিশোরী মেয়ের উপর অযথা দোষ চাপানো হচ্ছে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর উবার ডেকে রওনা হলাম। বাড়ি চিনি না, কয়েকব্লক ঘুরতে হবে।মিটারের টাকা কিছু বেশি উঠবে। উপায় নাই। এই জৈষ্ঠ্য মাসের অবেলার বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি লাগানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
রাজীব রহমান বাড়িতেই ছিলেন। টাউজার আর গেঞ্জি গায়ে বারান্দায় বৃষ্টি দেখছিলেন
আমায় দেখে চমকাল না। হাসল।
-স্যার,আসুন। আমি জানতাম আপনি আসবেন।
-কিজন্যে আসব তা জানতেন?
-জানি। আপনি পুরো ভিজে গেছেন। দাঁড়ান তোয়ালে নিয়ে আসছি।
আমি ভদ্রলোকের ঘরবাড়ি দেখতে গেলাম। পরিপাটি বসার ঘর,মধ্যবিত্তের রুচির ছাপ আছে। ভদ্রলোক বা তার স্ত্রীর কোনো ছবি ফ্রেমে বন্দী নাই। দেয়ালে নতুন রঙ করা হয়েছে। বড্ড বেশি সাদা,চোখে লাগে। রাজীব কাঁধে তোয়ালে আর ধোঁয়া উঠা দুইকাপ কফি হাতে।
-আমার জন্য বানিয়েছিলাম আপনি আসাতে অতিথি অ্যাপায়নও হয়ে গেল।
রাজীব বসল। ছোট ছোট চুমুক দিয়ে কফি পান করছে।কোটরগত চোখ,মাইলাম ৭.৫ গ্রহন করছে বোঝা যাচ্ছে না।
-রাজীব সাহেব,
-বলুন।
-আপনাকে কিছু কথা বলব।
নিরদ্বিধায় শুরু করেন।
-আপনি প্যাড খাতা হারিয়ে ফেলেন নাই, বহুদিন আগে থেকেই আপনার লেখালেখির অভ্যাস ছিল আমি চাওয়াতে ডায়েরির পাতা কিছু যোগবিয়োগ করে আমার চেম্বারে নিয়ে এসেছেন। কলমের কালির হেরফেরের কারণে এটা ধরার জন্যে সাইকিয়াট্রিস্ট হবার প্রয়োজন নাই সাধারণ মানুষই যথেষ্ট। বোঝাতে পেরেছি।
-জ্বী। তারপর।
-প্রথম থেকে শুরু করি, আমি লিখতে বলেছিলাম আপনার কথা কিন্তু আপনি কোনোক্রমে শৈশবের স্মৃতিমন্থন করে হুট করে বিয়েতে চলে গেছেন। কেন? বাহানা হিসেবে উপস্থিত করেছেন যৌবনের শুরুর সময়টা আপনি জীবনগঠনে ব্যস্তসময় পাড় করেছেন। ডাহা মিথ্যা কথা। বুয়েট,মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েও প্রথম জীবনে প্রেম করে, এলএসডির নেশা শুরু করে, গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার জীবনে মাঝখানের দশ বছর এরকম কোনো স্মৃতি নেই! কেন? জানেন তো, আমরা সেই অতীতকে একেবারে গভীর থেকে মুছে ফেলি যা নিয়ে আমরা ভেতর থেকে লজ্জিত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করতে গিয়েও বুক কাঁপে। আপনার কি ওইরকম কোনো স্মৃতি আছে?
রাজীব চুপ হয়ে আছে।
-আপনি আমার সব প্রশ্নের উত্তর একেবারে দিবেন,আশা করছি। আপনি বাচ্চা চাইছেন শুনে আপনার স্ত্রী চুপসে গেল কেন? ওর কি এনিয়ে কোনো দুর্বিষহ স্মৃতি আছে? আপনার লেখার কোথাও প্রথম সন্তান কনসিভ করলে স্বামী-স্ত্রী দুজনের যে গভীর আনন্দ অনু্ভূত হয় তা একবারও প্রকাশ করেন নাই অথচ বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে প্রচুর আহ্লাদ করেছেন। আর নীরা কনসিভ করার পর আপনাকে সহ্য করতে পারত না। সম্ভবত ওর প্রথম বেবি গর্ভে নষ্ট হয় এবং সেটা আপনার ইচ্ছায়। আপনার স্ত্রী বারবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল তাতেও আপনার দায় ছিল। নতুন দম্পতির কিচিরমিচির ঝগড়ায় হয় সুমধুর এতে সম্পর্ক আরো মজবুত করে। আপনাদের এত প্রেম আবার ঝগড়ার উৎস কি?ব্যবসায়িক কাজে বছরের বেশিরভাগ দেশের বাইরে কাটান,আপনার ধারণা ছিল নীরা গোপনে পরকীয়া করছে এবং সেই জের ধরেই ঝগড়া হত। নীরার কনসিভ করেছে শুনে বিশ্বাস করতে পারেন নাই বাচ্চাটা আপনার। তাই গর্ভপাত করিয়েছিলেন।আমি কিছু ভুল বললাম?
আবছা অন্ধকারে আমি ওর মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পারছিলাম না। আস্তে করে বলল,
না।
-এখানে আপনার কাহিনী ইতি ঘটতে পারত। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দের কারণে নীরা আত্মহত্যা করেছে।আমাদের দেশে এখনও নারীর সবচেয়ে দূর্বলতম জায়গা তার সতীত্ব এবং আপনি সেখানেই আঘাত করত। নীরা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে বলেই সংসার করে গেছে নতুবা অন্যের বাচ্চা ভেবে ভ্রুণহত্যা করবার পর কোনো মা সহ্য করত না। আপনাকে ওর ত্যাগ করা উচিত ছিল। আপনি আমার লজিকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে ফেলেছেন পদ্মকে নিয়ে এসে। মেয়েটা কে? কি তার পরিচয় ওসব বাদ দিন।আমি প্রথমে ভেবেছি পদ্ম একটা রুপকথা। তারপর আফসারীর কথা শুনে শিউর হলাম।আপনি বা নীরা কেউই পদ্মকে পছন্দ করেন না। পদ্মর আচরণ সন্দেহজনক তবু ও আপনি ওকে বাড়ি থেকে বের করলেন না। কেন? কারণ আপনি চেয়েছিলেন নীরা কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকুক আর সেটা পদ্ম।
পদ্ম আপনার স্ত্রীর কাপড় ছিঁড়েছে, এমনও হতে পারে ওই নীরার শরীরে সুঁচ ফুটিয়েছে জানার পরও আপনি চুপ থেকে গেছেন। পদ্মকে গালিগালাজ করেন নাই কেন? কারণ পদ্ম আপনার সম্পর্কে এমন কিছু জেনে গেছিল যা আপনার স্ত্রী জানে না।তাই আপনি পদ্মকে ভয় পেতে শুরু করেন। রাজীব সাহেব বাকি ঘটনা আমি আপনার মুখে শুনতে চাই।
রাজীব সাহেব ততক্ষণে ঘামতে শুরু করেছেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম একজন মানুষ তার বহুবছরের পুরানো পাপ নতিস্বীকার করবে। ঠিক যেমন সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে ফাসির মঞ্চে প্রবেশ করবার আগে তওবা পড়ানো হয় ঠিক তেমন।
রাজীব সাহেব বলতে লাগলেন,
-এইচএসসি পড়ার সময় আমার সাথে এক মেয়ের প্রেম হয়। মাধবী মজুমদার৷ আমি ফার্স্ট ইয়ার ও সেকেন্ড ইয়ার। প্রথম ভালোবাসা,মেয়েটাকে পছন্দ করতাম খুব।দুজনেরই কাঁচা বয়স, ও হিন্দু আমি মুসলমান। কিছুতেই এসম্পর্ক পরিবার মেনে নিবে না বুঝতে পেরে আমরা চিটাগাং পালিয়ে গেলাম। সেখানকার এক সস্তা হোটেলে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে ঘর নিলাম। ইচ্ছা ছিল পরদিন সকালে বিয়ে করব। রাত দুইটার দিকে দরজায় চপোটাঘাত। মাধবী ভয়ে আমার বুকে লুটিয়ে পরল,ও ভেবেছিল হোটেল রেড করতে পুলিশ এসেছে। আমাদের কাছে কাবিননামা বা বিয়ের কোনো পরিচয় নাই ধরা পরে যাব। না! পুলিশ আসে নাই ঘরে ঢুকল একদল হায়েনা। আমাদের অল্পবয়স আর আমতা আমতা কথা শুনে হোটেল ম্যানেজার বুঝতে পেরেছিল পালিয়ে এসেছি। তিনি সুযোগ বুঝে বাজে পাড়ায় বিক্রি দিয়ে নিয়ে এসেছে এবং টাকার বিনিময়ে মাধবীকে বিক্রি করে দিয়েছে।ওরা ছিল চার-পাঁচজন।ওদের পা ধরেও আমরা রক্ষা পাই নাই। আমাকে লাথিগুঁতা জুতার আঘাতে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলল আর সারারাত ধরে চোখের সামনে মাধবীকে রেপ করল। সকালে জ্ঞান ফিরে দেখি ফুটপাতে শুয়ে আছি,মাধবী নেই। ওকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে। সকালে কোনোরকমে আধমরা হয়ে ঢাকা ফিরলাম। কেউ জানত না,মাধবী আমার সাথে পালিয়েছে তাই কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় নাই৷ কিন্তু আমার জন্যে মাধবী নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে এই পাপবোধ সারাজীবন তাড়া করে বেরিয়েছে। অনেক অনেক বছর আমি নারী সঙ্গ বিবর্জিত। তার কারণ ছিল মাধবী। ওকে ভুলতে পারি নাই।বহু বছর পর নীরাকে দেখার পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আপনাকে আমি মিথ্যা বলেছিলাম, আমার স্ত্রী সুন্দরী। চোখে পরার মতই সুন্দরী তারজন্যে আমি সবসময় আতঙ্কে থাকতাম৷ একে তো ওর শরীর সম্পর্কে উদাসীন,দ্বিতীয়ত মাধবীর ঘটনার পর আমার কাছে সব পুরুষকে একরকমই লাগত। মনে হত সবাই নীরাকে কামনার দৃষ্টিতে দেখছে। নীরা প্রচুর ছেলে বন্ধু ছিল,আত্মীয়স্বজন কাজিনেরও অভাব নাই। আমি ওদের সাথে নীরার মেলামেশা একেবারেই পছন্দ করতাম না। আমাকে লুকিয়ে প্রায়ই কথা বলত, টেক্সট করত। ওর এই স্বভাবের জন্য প্রচুর ঝগড়া হয়েছে,গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি। লাভ হয় নাই।ও যখন কনসিভ করে মাসের কুড়িদিন আমি ব্যবসায়িক কাজে সিলেট থাকতাম। ওর বন্ধুবান্ধব বাড়িতে এলেও আমার জানার কথা না। যাই হোক, বলছি না বাচ্চাটা অন্য কারো ছিল। কিন্তু জোর করে মিসক্যারেজ করানো ছিল ওর জন্যে একটা শাস্তিস্বরূপ। পাখি বেশি উড়লে যেমন পাখা ভেঙে দিতে হয় অনেকটা তেমন।আপনি আমাকে খুনী ভাবছেন কিন্তু নীরাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারতাম না আবার ওর অবাধ আচরণ বরদাস্ত ও করতে পারতাম না। তাই এটা ছিল ওকে ঘরে বন্দী করার একমাত্র মেডিসিন।
রাজীব সাহেব ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেল। আমি কিছু বললাম না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে লাগল,
-সবে আড়াইমাস ওর গর্ভে সন্তান ছিল। খুব তো বেশি তো নয় বলুন! আমি দেখতাম নীরা হাসত,কাঁদত বাচ্চার সাথে কথা বলত। ওর প্রথম মা হওয়া, রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেট দেখত কতটা পাগলামি! আমরা ছেলেরা বাবা হই সন্তান বাবা বলে ডাক দিলে মেয়েরা তো পুতুল খেলার বয়স থেকেই মা হবার স্বপ্নে বিভোর থাকে। পুতুলের মা হয়,পুতুল হারিয়ে গেলে কেঁদেকেটে অস্থির হয়। আর সেই মেয়ের বাচ্চা হারানোর পর অনুভূতি কেমন ছিল,জানেন? অধিক শোকে মানুষ যেমন পাথর হয় অনেকটা তেমন। ও আমার সাথে হাসছে, খেলছে গল্প করছে কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলি আমার স্ত্রী পাশে নাই। জায়নামাজে বসে অঝোরে কাঁদছে। ও প্রার্থনায় আল্লাহপাকের কাছে আবার সন্তান চাইত না ওর চাওয়া ছিল একটাই,
-
-হে পরম করুণাময় পরকাল বলে যদি কিছু থাকে আমি যেন আমার সন্তানকে একটিবারের জন্যে হলেও দেখতে পাই।
নীরা পবিত্র ছিল তাই ওর সেই আকাঙ্খা আল্লাহপাক খুব দ্রুতই পূরণ করে ফেলেছেন।
রাজীব সাহেব কাঁদছে। ফোটা ফোটা চোখের জল গড়াচ্ছে। তিনি কান্না লুকানোর কোনো চেষ্টা করছে না।
আমারও চোখের কোণায় অশ্রু জমতে শুরু করল। একটা অজানা অচেনা মেয়ের জন্যে যাকে কোনোদিন দেখি নাই তার জন্যে বুকের ভেতরটা কেমন খচখচ করে উঠছে।
রাজীব সাহেবকে ধাতস্থ হতে সময় দিলাম। তিনি চোখের জল মুছে মুখ ধুয়ে এলেন,
পরেরবার নীরা কনসিভ করল আমার ইচ্ছায়,বলতে পারেন আমাকে খুশি করতে। আর আমারো মনে হচ্ছিল একটা বাচ্চা না হলে নীরা স্বাভাবিক হবে না। সেই সময়ে পদ্মর আগমন। পদ্মকে আমার প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয় নাই। ওর মাঝে অদৃশ্য কিছুর কালো ছায়া দেখতে পারতাম।মেয়েটা দাঁত বের করে হায়েনার মত হাসত। পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত হাসি। আমার শরীরের শিরায় শিরায় ভয়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিত। ওকে প্রথম দিনই আমি বের করে দিতাম৷ আমি সেদিন অফিসে যাবার সময় ও নীচু গলায় বলল,
-আপনের কাছে আজকা মাধবী দি আইব।
-কিহ?
-তুমি! তুমি মাধবীকে চিনো কি করে?
-হেয় আমারে চিনে না কিন্তু আমি তারে ঠিকই চিনি। হের পোলার খুব অসুখ আপনের কাছে টাকা চাইতে আইব।
-তুমি এসব কিভাবে জানো?
-আমি না আমার লগে যে আছে হেয় দুনিয়ার ভূত+ভবিষ্যৎ সবই জানে। আপনেরটা কমু?
সেদিন কাঁপতে কাঁপতে অফিসে গেলাম। সত্যি মাধবী এসেছিল। ও ততদিনে আগাগোড়া কলগার্ল। নিজের পরিচয় পাল্টে ফেলেছে, নাম রেখেছে মিস চুমকি। ওর একটা ছেলেও আছে৷ হার্টের অসুখে ভুগছে। বহুকষ্টে আমার অফিসের ঠিকানা যোগাড় করে চলে এসেছে। যদি পুরানো পরিচয়ের কথা ভেবে আমি কিছু সাহায্য করি।ওর দুই লক্ষ টাকা দরকার পাঁচ লক্ষ টাকার চেইক লিখে দিলাম। হাতজোড় করে পুরানো পাপের জন্যে ক্ষমা চাইলাম,
-আর যেন কোনোদিন না আসে।
যাবার সময় ওকে প্রশ্ন করলাম,
-তুমি পদ্ম নামের কোনো মেয়েকে চিনো?
মাধবী হাসতে হাসতে জবাব দিল,
-আমি মেয়েছেলের খবর রাখি না তবে পুরুষ মানুষ হইলে ভিন্ন কথা। তোমার কাছে কাস্টমার থাকলে খবর পাঠাইও। একবার খালি চুমকি কইয়া ডাক দিবা,
-বান্দা সরি বান্দী হাজির।
-চলবে
© bnbooks.blogspot.com