আপনার নেশা করার অভ্যাস আছে?
-মানেহ!
-বীয়ার খাই, সিগারেটের অভ্যাস আছে।
-এলএসডি, ইয়াবা?
-আরে না। তবে আমার স্ত্রীর পাল্লায় পরে সবকিছু একবার করে ট্রাই করেছিলাম। তাও বহুদিন আগের কথা। বিয়ের কিছুদিন পর ওর যখন নিত্যনতুন শখ জাগত, তখন।
আমি রাজীব সাহেবের পিঠের ক্ষতগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম।কিছুতেই মনে হচ্ছিল না কামড়ের দাগ। ধারালো ছুরি বা কাঁচির মাথা দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করেছে। খামচির দাগও আছে।
-আপনার নখ দেখি।
ভদ্রলোকের নখ ছোট।
-আপনি বাড়িতে কুকুর বা বিড়াল পোষেন?
- না।
-তাহলে খামচির
-
দাগগুলো কীসের?
-আমি জানি না। তবে...
-নীরা আসে।
-কীভাবে বুঝেন ও আসে?
-এক ধরনের ঘ্রাণ পাই।ওর নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে এক ধরনের সুগন্ধ থাকত, ও যখন রাতের বেলা ঘরে আসে সারাঘর সেই ঘ্রাণে একাকার হয়ে যায়...
-আপনার রাতে ঘুম হয়?
-জ্বী না।মাঝে মাঝে কয়েকরাত ঘুম আসে না। আবার কয়েকদিন পর্যন্ত চোখ মেলে তাকাতে পারি না।
আমি প্রেসক্রিপশনে ফটাফট "মাইলাম ৭.৫" লিখে দিয়ে বললাম,
-আপনি ঘুমাতে যাবার আধাঘণ্টা আগে খাবেন। তারআগে নয়। আর আপনার ডায়েরী শেষ করবার আগে অন্য কোনো মেডিসিন সাজেস্ট করতে পারছি না। আপনার ঘুম দরকার। বাড়িতে গিয়ে টানা রেস্ট নিন।আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?
-টাঙ্গাইল। আমার মা থাকে বড় ভাইয়ের সাথে।
-সম্ভব হলে গ্রামে গিয়ে ঘুরে আসুন। আর এক সপ্তাহ পর আমার সাথে দেখা করবেন।
-আচ্ছা। একটা কথা...
-বলুন।
-প্রথমদিন আপনি আমাকে তুমি করে নাম ধরে ডাক ছিলেন আজ আপনি করে।
হাসলাম।
- আপনাকে প্রথমদিন দেখে মনে হয়েছিল সহজসরল স্বপ্নবাজ যুবক,স্ত্রী মারা যাবার পর বিষণ্নতায় ভুগছেন।ডায়েরী পড়ে ভুল ভাঙল, আপনার মানসিক পরিপক্বতা আমার বয়সের কাছেপিঠে।
রাজীব সুন্দর করে হাসল। ছেলেটার চোখের নীচে কালশিটে দাগ, উশকোখুশকো চুল হাসিটা মলিন করতে পারল না। আমি জানতাম,রাজীবের আরো কিছু কথা বাকি আছে কিন্তু ডায়েরীর মানুষটাকে না চিনে এলে শুধুই ওর বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে গেলে এলোমেলো হয়ে যাবে। একটা গল্পকে যদি আমরা বটবৃক্ষ হিসেবে কল্পনা করি গল্পের সত্যমিথ্যা বর্ণনা হয় বটগাছের শাখাপ্রশাখার মত বিস্তর, বিষয়বস্তু মূল বৃক্ষ কমই জায়গা দখল করে, সূচনার ধারা হয় বটমূলের মত বিশাল। আমার সর্বপ্রথম সূচনা জানা প্রয়োজন।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরে একটা ছোট্ট ঘুম সেরে ডায়েরী নিয়ে বসলাম। মিসেস সেজেগুজে ভাইয়ের ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বেরিয়ে গেল। আমি মাথা যন্ত্রনার উছিলা ধরে বাড়ি থেকে গেলাম । স্ত্রী আজ ছেলেদের নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরবে না। বাপের বাড়ি হৈ-হুল্লোড় করবে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, ইলেকট্রিসিটি নেই, নিভু নিভু মোমবাতির আলোয় গরম গরম বেগুনি ভাজা নিয়ে রাজীবের খাতা খুলে বসলাম বলপয়েন্টে লেখা, ছাপার অক্ষরে হলে একটা উপন্যাস পড়বার ফিল হত। তবু মন্দ কি! যাহা জীবন তাহাই তো উপন্যাস।
পাঠক চলুন,আমরা রাজীবের খাতার ভেতর ডুব দেই,
নীরা, বাইশ বছর বয়সে আমার ঘর করতে এসেছে। বড় বড় চোখ করে যা দেখে তাই অবাক হয়৷ বিছানার কম্বল ভাজ করে দশ মিনিট সময় ধরে, চুলের জট খুলতে চিরুনি বুলাতে গিয়ে সব চুল ছিঁড়ে ফেলে। একদিন ডাল রান্না করেছিল, আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম ডালের স্বাদ দেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ। রান্না জানে না,সাজতে জানে না। ক্লাস টপকে ভার্সিটি উঠা ছাড়া মেয়েটার কোনো গুণ নাই। গায়েগতরে বড় হয়েছে নিজের শরীরটাকে যে ঢেকেঢুকে রাখব তারদিকেও নজর নাই। ওড়না ঠিক থাকে না, শাড়ি পরলে পিঠের একাংশ বেরিয়ে থাকে। আমার রাগ হয়, বেশকয়েকদিন চিৎকার চেঁচামেচি করেছি লাভ হয় নাই। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত হলে ওর ওপর দোষারোপ করা যায়। যাই হোক,নীরা কিন্তু আমায় ভালোবাসে। ওর ভালোবাসা উগ্র, অদ্ভুত,হিংস্র। ধরুন, দূরে কোথাও আছি। কয়েকদিন বাড়ি ফিরব না। ও ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করত। বস্তির মেয়েরাও ওর গালি শুনলে লজ্জায় মুখ লুকাবে।বকতে বকতে একসময় হাঁপিয়ে উঠত তারপর কান্না। আর দশজন অবুঝ পুরুষের মত আমিও কিন্তু বুঝতে পারতাম না স্ত্রীর রাগের উৎস কি! অযথা বাজে ব্যবহার কেন! বহুদিন পর বুঝেছি ওর যত রাগ-ক্ষোভ, হতাশা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ও আমাকে মিস করছে। পোষা বেড়াল যেমন মুনিবের আদর পাবার জন্য গরগর শব্দ করে অভিযোগ করে তেমনি আমার বউটা কাছে থাকার জন্যে চেঁচামেচি শুরু করে। আমি হয়ত এরআগেও বেশ কয়েকবার লিখেছি আবারও লিখছি আমি নীরাকে নিয়ে সুখী ছিলাড়ম।যতক্ষণ বাড়িতে থাকি ওর একটা হাত চেষ্টা করত সারাক্ষণ আমাকে ছুঁয়ে থাকার। সবাই যখন পাশে থাকত, ও আড়চোখে লক্ষ্য করে যেত। ঘন কালো চোখের মনি অব্যক্ত ভাষায় বলে যেত,
-ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।
এত ভালোবাসা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে আমি কি অসুখী থাকতে পারি!
মানুষ যেন কখনই পরিপূর্ণ সুখী না পারে তারজন্যে সৃষ্টিকর্তা একটার পর একটা চাহিদা তৈরি করেন। যেমন,দু বছর পর থেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন প্রশ্ন করা শুরু করল,
-বাবা হচ্ছি কবে!
-তাই তো। এখনি তো বাচ্চা নেবার উত্তম সময়। নীরাও নিশ্চয়ই প্রশ্নের সম্মুখীন হত,আমার কাছে শেয়ার করত না।
একদিন জিজ্ঞেস করলাম,
-তোমার একা একা লাগছে না?
-কেন?
-আমাদের ছানাপোনা হলে বেশ হয়।
ভেবেছিলাম নীরা খুশি হবে। ওর মুখ অন্ধকার।
-এত তাড়াহুড়ার কি আছে?
-তাড়াহুড়ার কই করলাম! চাইলেই তো আর আসমান থেকে বাচ্চা আসছে না। কত মানুষ বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা সন্তানের আশায়। আমাদের ভাগ্যে কি আছে আল্লাহপাকই ভালো জানেন।
-হু!এব্যাপার নিয়ে পরেও আলোচনা করা যাবে।
-বলো, লক্ষ্য করেছ আজ অমাবস্যা!
মানুষ পূর্নিমা রাতে আহ্লাদ করে। অমাবস্যাকে নিয়ে মাতামাতির কি আছে!
এর আগেও লক্ষ্য করেছি নীরা তিথি,রাশিচক্র এসব খুব মানে।
-অমাবস্যা তো কি হল!
-ছাদে চলো।অন্ধকার দেখব।
-দুর।মাঝরাতে যত্তসব পাগলামি ঘুমাতে আসো।
আমি ঘুমিয়ে গেলাম। নীরা জানালা কাছে দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখছে। এতো অজপাড়াগাঁ নয় যে অমাবস্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারপাশ তলিয়ে যাবে।শহরের সোডিয়ামের চোখধাঁধানো আলোয় জ্যোৎস্না,অন্ধকার সব দূরে পালায়।
পরদিন ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।ফজরের আযান হচ্ছে। নীরা জানালার কাছ থেকে সরে এসে আমার ঘুম ভাঙাল।
-এত সকালে কেন উঠেছ? সারারাত ঘুমাও নাই?
-শুনছ,আমি বাচ্চা নিতে পারব।
-বাচ্চা নিতে পারবে মানে এটা কেমন কথা!
-কিছু না। তুমি ঘুমাও।
নীরা পিঠের কাছে গা ঘেষে লেপ্টে থাকল।
-জানো,আমার কোষ্ঠীতে আছে প্রথম সন্তান বাঁচবে না।
-নীরা,স্টপ ইট। রাত থেকে নাটক করছ, ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে আবোলতাবোল কথা শুরু করেছ।মুসলমান ঘরের সন্তান কোষ্ঠী বিশ্বাস করে নাকি!
নীরা আর কিছু বলল না। শক্ত করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-এপাশে ঘুরো। আমার ভয় করছে।
নীরার দিকে ঘুরতেই মনে হল,খোলা জানালার পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ একজন আমাদের লক্ষ্য করে যাচ্ছে। অবশ্যই মনের ভুল। চারতলার উপর কে আসবে!
নীরা অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাল। আমি সকালের নাস্তা বানিয়ে অফিসে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি এমন সময় দরজায় চপোটাঘাতের শব্দ হল। কলিংবেল আছে তবু অসভ্যের মত থাপড়িয়ে যাচ্ছে।
-আসছি। আধ মিনিট দেরি সহ্য হয় না।
দরজা খুলে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম।একটা মেয়ে। কোঁকড়া চুলের দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে। কুচকুচে কালো রঙ। ওর চোখ,ঠোঁট এমনকি দাঁতগুলোও পর্যন্ত ধূসর কালো। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সব জীবকে পরম মমতায় জীবন দান করেছেন। তার সৃষ্ট কোনো মানুষকে কুৎসিত বলার অধিকার আমাদের দেন নাই। তবু বলছি,মেয়েটা ভীষণ কুৎসিত। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ও শীতল গলায় বলল,
-আম্মা,আমাকে আসতে কইছে।
-আম্মা কে?
নীরা ততক্ষণে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-ওকে চিনো তুমি?
নীরার চোখমুখেও আতঙ্ক। কোনোক্রমে মাথা নাড়াল।
-পদ্ম,তুই ভিতরে আয়। তোর সাথে জিনিসপত্র কিছু আছে!
পদ্ম ওর চেয়ে দ্বিগুণ ওজনের ট্রাঙ্ক টানতে টানতে ঘরে ঢুকল। টি-টেবিলের কাছে ওর বাক্সপেটরা রেখে নাক টানল,
-পোঁড়া গন্ধ পাই।চুলায় কিছু বসাইছেন!
সত্যি, চুলায় আলুভাজি বসিয়েছিলাম।ছুটে রান্নাঘরে গেলাম। ওখান থেকেই শুনতে পাচ্ছি ভয়ঙ্কর মেয়েটা বলছে,
-পোঁড়া গন্ধ আমার ভালোই লাগে।
-চলবে
© bnbooks.blogspot.com