রাজীব মৃত স্ত্রীকে বিছানায় দেখতে পান শুনে অবাক হলাম না। এধরনের ভ্রান্তি ঘটনা অবিশ্বাস করার জন্যে মনোবিশারদ হবার প্রয়োজন নাই চোখকান খোলা রাখাই যথেষ্ট। আমার পিঠাপিঠি বোন বিন্তি আট বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা যায়। ওর মৃত্যুর পর রাতের বেলা বাথরুমে একা যেতে ভয় পেতাম।এমনকি জানালার পাশে ওর কথার গুণগুণ শুনতে পেতাম। রাজীব সাহেব আরো কিছু বলতেন কিন্তু উনাকে নিয়ে আড়াইঘণ্টা সময় ব্যয় করে ফেলেছি এবং পেটের ভেতর থেকে মূল বিষয়বস্তুই উদ্ধার করতে পারি নাই। আজকাল সাইক্রিয়াটিস্ট নাম শুনলেই লোকজনের চোখের সামনে মিসির আলির চেহারা ভাসতে থাকে। যা বিশেষজ্ঞদের ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। লোকজনের মনের গতির খবরাখবর নিয়ে আমাদের পেট চালাতে হয় এবং মিসির আলির মত যুক্তির উপর নির্ভর করে দিন চলে না মেডিসিনের উপরও ভরসা করতে হয়। যাই হোক, একটা প্যাড আর বলপ্যান ড্রয়ার থেকে বের করে দিয়ে রাজীবকে বললাম,
-তোমার কাজ হচ্ছে, আগামী সাতদিনে পুরো প্যাড লিখে ভরাট করে আনা।
-কি লিখব?
-তোমার আর তোমার স্ত্রীর গল্প।
-আমি তো আপনাকে সবটা বললাম।
-কিছুই বলো নাই। যা বলেছ ছাড়া ছাড়া। তোমার স্ত্রী যতটুকু বুঝতে পেরেছি তোমার চরিত্র একভাগও নয়। পেসেন্ট তুমি,তোমার স্ত্রীর চেয়ে তোমার চরিত্র জানা বিশেষ প্রয়োজন।
রাজীব অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাতা নিয়ে উঠল। আমার চিকিৎসাপদ্ধতি ওকে আশ্বাসিত করে নাই বুঝতেই পারছি। ভাবছে বেগাঢ় ভিজিটের দুই হাজার টাকা গচ্চা গেল।
রাজীব এর সপ্তাহেও এল না এবং তার পরের সপ্তাহেও না। স্বভাবতই আমি রাজীবকে ভুলে গেলাম। স্রেফ সুঠাম শরীরের কোনো পুরুষের সঙ্গে দেখা হলে আড়চোখে আরেকবার তাকাই,
-এমন কাকে যেন দেখছিলাম!
নাম করতে পারি না।আমার স্মতিশক্তি দূ্র্বল।।রাজীব প্রায় ছয়মাস পর। সেদিন আমি চেম্বারে ছিলাম না। বড় বোনের মেয়ের পানচিনির অনুষ্ঠান ছিল। পরের সোমবার অফিসে ঢুকতে অ্যাসিসেন্ট নোটখাতা এগিয়ে দিল।
-এটা একজন প্যাসেন্ট আপনাকে পড়ার জন্যে দিয়ে গেছে।
বেশ কয়েকজন ইন্ট্রোভার্ট রুগীই তাদের সমস্যার কথা আমাকে লিখে জানায়। তাদের একজনের মনে করে খাতা হাতে নিলাম। রাজীব রহমান নাম দেখে মনে পরল সেই সুদর্শন যুবককে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
সেদিন রাতে বৃষ্টি ছিল। যথারীতি পুত্রদের মায়ের সাথে ঝগড়া লাগছে। তিনি পাশের ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আমি বড় এক মগ কফি আর রাজীবের নোটখাতা নিয়ে বারান্দায় বসলাম।
কিছুটা বাঁকানো হাতের লেখা স্পষ্ট অক্ষর কিন্তু লাইনগুলো বেঁকে আছে। বহুদিন কলম না ধরার ফল। ছেলেটার প্রস্তাবনা বেশ সুন্দর। প্রথম লাইনে মার্জিত ভাষায় ক্ষমা চেয়েছে যে ও আমার দেওয়া প্যাড, বলপ্যান দুটোই হারিয়ে ফেলেছে। এরপর আরো কিছু এলোমেলো লাইন আমাকে উদ্দেশ্য করে। ওসব কথা থাক, মূলগল্পে আসি-
আমার নাম রাজীব রহমান। নাইনে ফর্মফিলাপের আগে নাম ছিল ছোটু, ছোটু শেখ। নাইনে ফর্মফিলাপের সময় অঙ্কের শিক্ষক জাহাঙ্গীর স্যার কানে ধরে বলল,
-এ কেমন নাম রে! তোর বয়স আশি হবে আর লোকে তোকে ডাকবে ছোটু শেখ! এহয় না। তিনি পাল্টে নাম দিলেন রাজীব রহমান।
শৈশব থেকেই আমি কিছুটা একরোখা আমাদের অঞ্চলে একে বলে ঘোড়া রোগ। যেমন ধরেন, কোনো জিনিস একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে তা না পাওয়ার পর্যন্ত চিৎকার করে হাত-পা ছুঁড়ে কান্না করতে থাকতাম।বাবা মারা যাবার আগপর্যন্ত জীবন সহজ ছিল না হয়ত সারাজীবন অবোধই থেকে যেতাম মাথার উপর বাবা নামক বটবৃক্ষের ছত্রছাত্রায় মানুষ হলে। আমি দূর্ভাগ্যবান, বাবা মারা যান সাত বছর বয়সে৷ এরপরের অংশটুকু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আমি নিজেকে পৃথিবীর সুখী মানুষ ভাবতে ভালোবাসি তাই দুঃখগুলো চাপা থাক। তবে একটা কথা বলতে পারি, বাবার মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজন -ঘনিষ্ঠজনর কাছে থেকে যেই শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষা আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে যোজনগুণ বেশি কাজে দিয়েছে।। জীবন থেকো বহুবছর কেটে গেছে স্রেফ টাকার পিছনে ছুটেতে কেননা আমাদের সমাজের রীতি এমন টাকা থাকলেই সম্মান এসে ধরা দেয়। টাকা হল,সম্মান হল। পরিবারের মানুষজন যখন বিয়ের জন্য চেপে ধরেছে আমিও মুখে না না করি কিন্তু মনে মনে সত্যিই একটা মেয়েকে খুঁজি। সোশ্যাল মিডিয়ার কয়েকজনের সাথে পরিচয় হল আরো কয়েকজনের সাথে বহু আগে থেকেই কথা চলে তবে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না।
গ্রীক বচনে আছে মানুষ ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী। তার চার হাত-চার পা, একই মুখমণ্ডলে দুই চেহারা।মানুষেন ক্ষমতা দেখে স্বয়ং দেবতা জিউস ভয় পেয়ে যান। তিনি মানুষকে দুই টুকরা করে পৃথিবীতে পাঠান আর মানুষের কাজ হয়ে যায় সারাজীবন অর্ধেক অংশকে খুঁজে বের করা। কেউ পায় কেউ পায় না। আমিও হন্যি হয়ে খুঁজি,যাদের পাই তাদের ছুঁয়ে তৃষ্ণা মিটে না। একদিন সিগারেট কিনতে গাড়ি থামিয়ে মুদি দোকানেন সামনে দাঁড়ালাম। এক কাপ চা হাতে নিয়ে সিগারেট ধরালাম, দেখি পাশে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতান্ত সাধারণ সালোয়ারকামিজ পরনে, ভ্রু কুঁচকে বারবার ফোনের স্কিনে ঘড়ি দেখছে। খালি রিকশা আসতেই উঠে চড়ে গেল। সবমিলিয়ে বড়জোর দুই মিনিটের ব্যাপার হবে, বিশ্বাস করুন আমি চোখের পলক পর্যন্ত ফেলতে ভুলে গিয়েছিলাম।হাতে সিগারেটের ছ্যাকা খেয়ে হুশ ফিরল। মেয়েটা দেখতে কেমন, খাটো না লম্বা, চেহারা কেমন কিছুই আমার মনে নাই শুধু মনে হচ্ছিল এই সেই মেয়ে যে বহু আলোকবর্ষ দূরে লক্ষকোটি বছর আগে আমার দেহের অংশ ছিল। যার প্রতিটা নিশ্বাসের শব্দ আমার চেনা শুধু আপন করে নেবার অপেক্ষা। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ওর সাথে কথোপকথন করা সহজ হল। নাম নীরা, ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সহজ-সরল নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অহরহ মা কত এমন সম্বন্ধ দেখেছে কিন্তু এই মেয়েকেই বিয়ে করা দুরুহু হয়ে গেল। নীরা এমন যেন জলের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে হাত বাড়ালেই তলিয়ে যাচ্ছে। ওর এই টালমাটাল স্বভাব আমাকে ওর দিকে টেনে অসংখ্যবার। জল্পনাকল্পনা শেষে আমাদের বিয়ে হল একেবারে অনাড়ম্বর ভাবে। বিয়ের পরদিন কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করত,
-পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?
চিৎকার করে বলতাম,
-আমি,এই আমি রাজীব রহমান।
আমাদের দেশে বিয়ের সময় মিল খুঁজে। চাকুরিজীবী বনাম চাকুরীজীবী,ধনী বনাম ধনী, ডাক্তার বনাম মহিলা ডাক্তার। যত্তসব বাজে ব্যাপার। চৌম্বকের যেমন উত্তর মেরু বনাম দক্ষিণ মেরু তেমনি আপনি সবচেয়ে আকৃষ্ট হবেন বিপরীত চরিত্রের মানুষকে ঘিরে।কেননা সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলাই এমন,তিনি বৈচিত্র্য পছন্দ করেন। আমি গোছানো নীরা অগোছানো। পোশাক,ঘড়ি,সানগ্লাসে একটা ফ্যাসিনেশন কাজ করে নীরা সাদামাটা একটা গায়ে চড়ালেই হল। আশ্চর্য ওকে সবকিছুতে মানিয়েও যেত। সস্তা ডুরে শাড়ি গায়েও নীরা আমার কাছে অপরুপা। আমি দিনে ১০০ বাক্য উচ্চারণ করি কী না সন্দেহ, ও পাঁচ মিনিটে হড়বড় করো একশ কথা বলে ফেলে। রাতের পর রাত জেগে ডকুমেন্টারি দেখি,ওয়েবসিরিজ দেখি।নীরা ঘুমাতে পছন্দ করে। আমি আলসে,বোকা, বাচাল মেয়েটির প্রেমে পরে গেলাম। সে এক মধুরতম প্রেম। ও আধাঘণ্টা কথা না বললে হাসফাঁস শুরু হয়।
-এই তুমি কথা বলছ না কেন?
- কি বলব?
-প্রশ্ন করে আপনা থেকেই কথা শুরু করে।
বিয়ের পর প্রেমে পরার মত পবিত্রতম মুহূর্ত আর কিছু নেই।ভোরে ঘুম ভাঙার পাশের বালিশে শোওয়া একটা অগোছালো শরীর, বাসিগন্ধে মাখানো আধখোলা ঠোঁট আর এলোমেলো চুলের মানুষটা শুধুই আমার। তার জন্যে অপেক্ষায় কৈশোর কেটেছে,যৌবন এসেছে...এই অনুভূতি ঠিক লিখে প্রকাশ করা যাবে না।
এইটুকু পড়ে আমি নোটখাতা বন্ধ করলাম। রাত্রি তখন দুইটা। চট করে পাশের ঘর থেকে ছেলেদের মাকে ডেকে আসলাম। বুকের ভেতরটা কেমন স্নেহে ভরে গেছে। মধ্যবয়স্কা, গালে ভাজ পরা দুই বাচ্চার মা ইনিও তো শুধু আমার, হারিয়ে যাচ্ছে না। ইগোর বর্শবতী হয়ে রোজ যা করি না আজ তাই করলাম স্ত্রীর পাশে গিয়ে শুয়ে পরলাম। ও গভীর ঘুমে।আহা,বাচ্চাদের পিছনে বেচারীর কি খাটুনিই না খাটতে হয়।
পরদিন চেম্বারে ঢুকে দেখেই রাজীব হাজির। আজ তো ওর আসার কথা ছিল না। উদভ্রান্তের মত চেহারা,চোখের নীচে কালশিটে পরে গেছে। কালকে রাতে পড়া ওর গল্পের নায়কের সাথে ওকে মেলাতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে?
-বিশ্বাস করুন, নীরা রাতে আমার কাছে আসে। কাল রাত চিৎকার করতে যেতেই পিঠে কামড়াতে শুরু করল।এই দেখুন..
রাজীব শার্টের একপাশ খুলে আমাকে দেখাল।
কাঁধের বামপাশে লাল ছোপছোপ তাজা ক্ষতচিহ্ন।
-চলবে
© bnbooks.blogspot.com