দ্বন্দ - পর্ব ১ - ভৌতিক গল্প

দ্বন্দ
লেখিকা: হাবিবা সরকার হিলা
পর্ব ১




আমার স্ত্রী মারা যায় অপঘাতে। রাত দুটোর সময় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার কয়েক সেকেন্ড বুঝে উঠতে সময় লাগছিল নীরা আগুনের ভেতর নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি কম্বল দিয়ে ওকে জাপ্টে ধরি। সিনথেটিক কামিজ পরনে ছিল। হসপিটালে নিতে নিতে সিক্সটি ফাইভ পার্সেন্ট বার্ন।দুদিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে নীরা মারা যায়। দুদিন ওর হসপিটালের বেডে ঢোকার সাহস নাই। করিডোর দাঁড়ালে জানালায় ওর ক্ষতবিক্ষত পোঁড়া শরীর....আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
বলতে বলতে সে দু'হাতে মুখ ঢাকল। ভদ্রলোকের বয়স কত ত্রিশ-বত্রিশ। স্ত্রীর বয়স নিশ্চয়ই আরো কয়েক বছরের ছোট হবে।ওইটুকু বয়সের একটা মেয়ে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলল। মৃত্যু কি আজকাল এতই সস্তা! আমি গত আটাশ বছর ধরে ডাক্তারি পেশায় থাকার পরেও খবরের কাগজে,নিউজফিডে রক্তারক্তির ছবি এড়িয়ে যাই আর সামনে বসা যুবক চোখের সামনে স্ত্রীকে একটু একটু পুঁড়ে যেতে দেখেছে। কতটা লোমহর্ষক! নেভিব্লু টির্শাট গায়ে ছেলেটাকে তুমি করেই সম্বোধন করলাম,
-এধরনের ঘটনায় সাধারণত ভিক্টিমের পরিবার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করে। তোমার ক্ষেত্রে ওরকম কিছু ফেইস করতে হয় নাই।
-না,নীরা মানে আমার স্ত্রী এর আগেও কয়েকবার সুইসাইড অ্যাটেম্প করেছিল। ওর বাবার বাড়ি থাকতে একবার এক পাতা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ফেলে। ভালোবাসা দিবসে দেখা করতে যাই নি বলে হাত পা কেটে রক্তাক্ত করে ফেলে।
-অটোফ্যাজিয়া ছিল সম্ভবত।
-মানে?
-এটা একধরনের মানসিক ডিজঅর্ডার। এরা নিজের শরীরকে আঘাত করে আনন্দ পায়।
-ও আনন্দ পেত কী না জানি না তবে ও জানত এতে আমি প্রচণ্ড কষ্ট পাই। আমাকে টর্চার করার সবচেয়ে মজবুত পন্থা হল ওর নিজের শরীরকে আঘাত করা। ওকে ভালোবাসি আমি।
এইবার আমি ভদ্রলোকের আপাদমস্তক আরেকবার নিরীক্ষণ করলাম। নাম রাজীব রহমান, বয়স বত্রিশ,তেত্রিশই হবে। ওকে পাঠিয়েছে সাবেক ছাত্র আফসারী।২০০৭ এর ব্যাচ, আমার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। কালকে চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরে মেসেঞ্জারে ঢুকতেই টুং করে শব্দ হল,
-স্যার, আমার খুব কাছের বন্ধু কাল আপনার সাথে দেখা করতে যাবে। ওর স্ত্রী মারা যাবার পর ও খুব মানসিক অবসাদে ভুগছে আরো কিছু বোধহয় ওর ভেতর চলছে আমি সঠিক জানি না।
খুব ভরসায় আপনার ঠিকানা দিলাম, ওকে সাহায্য করবেন,প্লিজ।
নতুন রুগী এলে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে প্রথমেই আমি তার বেশভূষা, চালচলন লক্ষ্য করি। আজ রাজীবকে দেখে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ইনিই ছাত্রের পাঠানো সেইজন। লম্বা, পেটানো শরীর। কালোবর্ণের কৃষ্ণের রুপে অসংখ্য গোপিকা প্রেমে মজে ছিল। এই ছেলেও শ্যাম তবে আট-দশজন বাঙালি পুরুষের তুলনায় বেশ সুঠাম দেহ। তীক্ষ্ণ নাক, মাথা নীচু করে কথা বলায় চোখদুটো দেখতে পারছিলাম না। তবে চেহারায় পুরুষালি জৌলুস অসামান্য। চোখের নীচে কালি, কালশিটে পরা টিঙটিঙে চেহারা নিয়ে অল্পবয়স্কা মানসিক রোগীরা চেম্বারে আসে। দেখলেই বোঝা যায়, এরা ঘুমায় কম, এক একটা হিস্টিরিয়া রোগীর মত সারারাত মোবাইল গুতায়, প্রেমে ছ্যাকা খায়,সিজিপিএ কমে-বাড়ে। পরিবারের লোকজনকে ভাবে শত্রুপক্ষ। জীবনে একটা ভালো চাকুরি আর ভালো বিয়ে করা আর কোনো লক্ষ্য নাই। শেষ পর্যন্ত আত্মমগ্ন থাকতে থাকতে মানসিক অবসাদে ভুগে৷ এদের সংখ্যার বাড়ছে,বিস্তর বাড়ছে। কিন্তু রাজীব পোশাকপরিচ্ছদে কেতাদুরস্ত। হাতের ফসিল ঘড়ি আর ব্রান্ডের সানগ্লাস দেখা বোঝা যায় পয়সাকড়ি আছে আবার বিলাসীও বটে। এবয়সী ছেলেরা বউকে নিয়ে মালদ্বীপে গিয়ে সমুদ্রস্নানের ছবি পোস্ট করে আর ও এসেছে স্ত্রীকে হারিয়ে মানসিক সমস্যার সমাধান করতে।ভবিষ্যৎকে আমরা যতটা সহজ করে ভাবি, ভবিষ্যৎ ততটাই গরল।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, ছেলেটা গত আধাঘণ্টায় নাম ছাড়া নিজের সম্বন্ধে একটা কথাও বলে নাই৷ ঘুরেফিরে সব কথা নীরাতে শেষ হয়। এত সহজ গলায় বলল,
-আমি নীরাকে ভালোবাসি।
অবাক হলাম।প্রেমিকেরা লক্ষবার উচ্চারণ করে,
-আমি তাকে ভালোবাসি কিন্তু এদেশের বিবাহিত পুরুষেরা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে। পরিবার তো বটেই সমাজের কারো চোখেই যেন না পরে সে স্ত্রীতে আসক্ত। পাছে লোকে বউয়ের আঁচল ধরা ভেড়ুয়া না বলে! রাজীব ব্যতিক্রম।সাবলীল গলায় ভালোবাসার কথা স্বীকার করল। জিজ্ঞেস করলাম,
-প্রেমের বিয়ে?
-অনেকটা সেরকমই।
-তোমাদের গল্পটা বলো।
রাজীব কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে দুই ঢোকে পানির গ্লাস শেষ করে বলতে শুরু করল,
-আমি ছোট থেকে বেশ কষ্ট করে বড় হয়েছি, বলতে পারেন শৈশব থেকে নিজের অভিভাবক নিজেই। তবে কোনোমতে একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই। পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য বিধায় সমস্ত দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। যে বয়সে ছেলেরা প্রেম করে,গার্লফ্রেন্ডের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খায় আর আমি টাকার পিছনে ছুটছি। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঠকে অনেক বাজে অভিজ্ঞতা হবার পর বুঝেছি দুনিয়ায় টাকা ছাড়া মানুষের কোনো মূল্য নাই।আমার স্ত্রী ব্রোকেনও ফ্যামিলির মেয়ে। বিয়ের আগে ওর সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানতাম না। ও দেখতে আহামরি তেমন কিছু নয় তবে আমার ভালো লাগত। ভালোবাসলে যা হয়৷ যখন ওর সাথে দেখা হয় আমার বয়স তখন ত্রিশ চলছে।পরিবার দেখে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখছে। আমার ওকে দেখার পর মনে হচ্ছি গত ত্রিশ বছর পরিবার, আপনজনদের জন্যে গাধার মত খেটেছি নিজের কথা কোনোদিন ভাবি নাই। কিন্তু আমার এবার ওকে চাই। একটা মেয়ে নিতান্ত সাধারণ চেহারা কিন্তু ওকে দেখলে বুকের বামপাশটায় শান্তি লাগত আমি ওকে হারাতে চাই নাই। তাড়াহুড়োয় বিয়ে করলাম।
-তারপর,
-স্যার,আপনার স্ত্রীর সাথে যদি আপনার ভীষণ সদ্ভাব থাকে ঘরকেই বেহেশত মনে হবে। আমার কাছেও তাই মনে হত। বেলা দশটায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ১১ টায় ছুটে চলে আসতাম।বাড়ির সবাই মিটিমিটি হাসত, লজ্জা লাগত আবার নীরাকে না দেখে থাকতেও পারতাম না।
-বিয়ের পর প্রত্যেকেই নববধূর প্রেম খুব উপভোগ করে।আপনার স্ত্রীর অনুভূতি কেমন?
-স্যার,বিশ্বাস করেন নীরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বোকা স্ত্রী ছিল। আমি যখনি বাড়িতে আসতাম ওর রান্নাঘরে কাজ থাকত বা গোসল করতে বাথরুমে ঢুকত।মানে ওর বর যে ওর জন্যে ছুটে বাড়ি চলে আসল তা বোঝার মত জ্ঞান ও ওর ছিল না। আমি প্রায়ই ওকে বলতাম,তুমি আরেকটু কম সুন্দর হলেও সমস্যা ছিল না যদি জ্ঞানবুদ্ধি একটু বেশি থাকত।
-এইযে একটু বললেন,আপনার স্ত্রী দেখতে সুন্দর ছিল না।তাহলে! ওর ছবি আছে?
-জ্বী না।
-আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার ফোনভর্তি নীরার ছবি।
রাজীব হাসল।
-ঠিক বলেছেন। তবে নীরাকে কেউ দেখুক আমার তা পছন্দ না।
এবার ভদ্রলোকের ভেতরটা কিছুট্ স্পষ্ট হতে শুরু করল। সে একরোখা, ভালোবাসার মানুষকে একান্ত গোপন করে রাখতে ভালোবাসে।
-আপনাদের সমস্যা শুরু কোথায়?
-আমাদর সমস্যা কখনই ছিল না। টুকটাক ঝগড়া হত। নীরা তা সিরিয়াস হিসেবে নিয়ে উদ্ভট কাণ্ডজ্ঞান করত। শেষবার ওকে বাঁচাতে পারলাম না আর তারপর থেকে...
-তারপর থেকে কি?
-আমি আমার মৃত স্ত্রীকে রোজ বিছানায় ঘুমন্ত দেখতে পাই।
-চলবে


© bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.