কুসুমতলী আর হিরামন গাঁয়ের মাঝে বিশাল এক জঙ্গল । গ্রামের মানুষেরা এর নাম দিয়েছে ‘বুড়ো দেবদারুর জঙ্গল’ । কারণ এই জঙ্গলে দেবদারু গাছই বেশী । আর সবগুলো গাছই অনেক বছরের পুরানো । কিন্তু কত বছরের পুরানো সেটা সঠিক কেউ জানে না । হিরামন গাঁয়ের সবচেয়ে বয়স্ক বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন আমি যখন ছোট ছিলাম তখনও এই দেবদারু গাছগুলো ছিল । এদের মধ্যে একটা দেবদারু গাছ ছিল সবচেয়ে বেশী পুরানো ।
সেদিন খুব গরম পড়ছিলো । দুপুরবেলা একটু বাতাসের আশায় কুসুমতলীর রমিজ জঙ্গলের পুরানো দেবদারুর তলায় এসে বসলো । কিছুক্ষণ পর হঠাৎ-ই বনে ঝড় শুরু হল । জোরে জোরে বাতাস বইতে লাগলো । রমিজ একটু ভয় পেল । ও বাড়ি ফিরে আসলো । সেদিন রাতে রমিজ স্বপ্নে দেখলো কোন এক বৃদ্ধ লোক ফিসফিস করে বলছে,’ পুরানো দেবদারুর তলে কলসি ভর্তি স্বর্ণ আছে । তুই যদি সেটা নিতে চাস তাহলে তোর ছোট ছেলেকে দিতে হবে । যদি রাজি থাকিস তাহলে দেবদারুর নিচে আয় আর সাথে তোর ছেলেকেও নিয়ে আসিস ।‘
লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেল ও । জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলো তখনও সকাল হয় নি । সাত পাঁচ ভেবে ও দেবদারু তলায় এসে দেখলো একটা কলসির মুখ দেখা যাচ্ছে । কলসির মুখে স্বর্ণ চকচক করছে । ও চারদিকে তাকিয়ে কলসিটা চাদরের আড়ালে লুকিয়ে বাড়ি ফিরে আসলো । সকালের আলো ফোটার আগেই ও কলসিটাকে বাড়ির পিছনে মাটিতে পুতে লুকিয়ে রাখলো। কিন্তু স্বপ্নে দেখা বৃদ্ধের অন্য কথাটা ও বেমালুম ভুলে গেল ।
দুইদিন পর সন্ধ্যায় রমিজ ওর গরুগুলো আনতে মাঠে গেল । কিন্তু মাঠে এসে ও গরুগুলো দেখতে পেল না । ও গরুগুলো খুঁজতে জঙ্গলে ঢুকলো । চারদিকে তখন অন্ধকার নেমেছে । কিছুক্ষণ হাঁটার পর সেই পুরানো দেবদারুর তলায় গরুগুলোকে দেখতে পেল । ও দেবদারুর তলায় যেতেই গাছের ডালপালাগুলো ভীষণভাবে নড়ে উঠলো ; ও উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো স্বপ্নে দেখা সে বুড়োটা দেবদারু গাছ থেকে নামছে ।
পরদিন সকালে রমিজের লাশ দেবদারুর ডালে ঝুলতে দেখলো গ্রামের লোকজন । ওর নাম মুখ দিয়ে বের হওয়া রক্ত তখনও জমাট বেঁধে ছিল ।
এক সপ্তাহ পরে রমিজের ভাই গফর গঞ্জ থেকে বাড়ি আসছিলো । হিরামন গাঁয়ে আসতে আসতেই রাত নেমে গিয়েছিল । গফর তখন জঙ্গলের পথ ধরে কুসুমতলীর দিকে রওয়ানা দিল । জঙ্গলের মাঝামাঝি আসতেই ও হঠাৎ শুনতে পেল ওকে কেউ ডাকছে । ও ভালো করে কান পাতলো । তখন ও স্পষ্ট শুনতে পেল ওর ভাই রমিজ ওকে ডাকছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ও ভুলে গেল ওর ভাই মারা গেছে । গফরও তখন রমিজ রমিজ বলে ডাকতে ডাকতে দেবদারুর কাছে চলে আসলো । কিন্তু আশেপাশে ও রমিজকে দেখতে পেল না । তখনই ওর মনে হল ওর ভাই তো একসপ্তাহ আগে মারা গেছে । ও দৌঁড়ে জঙ্গল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলো । কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে ।
পরদিন সকালে ওর লাশটাও রমিজের মত দেবাদারুর ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল ।
দুই দুইটা অদ্ভুত মৃত্যুতে থমথমে হয়ে গেল পুরো গ্রামের পরিবেশ ।
রমিজের ছেলে নিরুর বয়স সবে পনের বছর । তবে খুব সাহসী আর চটপটে ছেলে । কিছুদিনপর ও স্বপ্নে দেখলো জঙ্গলের দেবদারু গাছ থেকে কেউ একজন ডাকছে ওকে। টানা তিনদিন একই স্বপ্ন দেখলো । অতঃপর ঐ রাতে ও জঙ্গলে গেল । হাঁটার সময় ওর বুক ভয়ে দুরু দুরু করে কাঁপছিলো । কিন্তু দেবদারুর কাছে গিয়ে ও কিছুই দেখতে পেল না ।অগত্যা বাড়ি ফিরে আসলো ।
পরের রাতেও ও একই স্বপ্ন দেখলো । ও ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে জঙ্গলের পথে হাঁটতে লাগলো । মধ্যরাত । চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে । হাঁটতে হাঁটতে ও পুরানো দেবদারুর কাছে চলে আসলো । গাছের ডালে সাদা কাপড় পরা দুটো লাশ ঝুলছে । নিরু কাছে গিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ওর বাবা আর চাচার লাশ দুটো , নাকে মুখে জমাট বাঁধা রক্ত । ও ভয়ে দৌঁড়ে জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসলো । পথে একজন বৃদ্ধের সাথে ওর দেখা হল । বৃদ্ধলোকটা ওকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,' কি ব্যাপার ! এত রাতে দৌঁড়াচ্ছো কেন ?'
নিরু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,'ঐ দেবদারুর ডালে দুটো লাশ......'
বৃদ্ধলোকটি ওকে থামিয়ে বলল,'জানি । আর এখন গেলে তুমি ঐ লাশদুটোও দেখতে পাবে না ।'
নিরু অবাক হয়ে বলল,’তার মানে আপনি দেবদারুর রহস্য জানেন ?’
'হ্যা জানি আর এটাও জানি তোমাদের পরিবারের কেউই বাঁচবে না ।'
'কিন্তু কেন ?'
লোকটি নিরুর কথায় কান না দিয়ে উল্টো পথে হাঁটতে লাগলো ।
পিছন থেকে নিরু জোরে ডাক দিলো,'ও দাদু , বলে যাও না ।'
লোকটা ফিরে তাকালো ।
নিরুর মায়াময় করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,'তোমাদের বাড়ির পিছনে এক কলসি স্বর্ণ মাটির তলে লুকানো আছে । ওটা তুলে এনে দেবদারুর তলায় রাখো সকাল হওয়ার আগেই ।' বলেই লোকটা আবার চলে যেতে উদ্যত হল ।
- দাদু, আপনার পরিচয়টা তো জানা হল না ।
- আমি আজগর আলী ফকির । হিরামন গাঁয়ে থাকি । একগাল হেসে লোকটা উত্তর দিয়ে চলে গেল ।
নিরু দ্রুত শাবল দিয়ে ঘরের পিছন থেকে স্বর্ণভর্তি কলসিটা তুলে দৌঁড়ে জঙ্গলে আসলো। হাঁটার সময় ও শুনতে পেল পিছন থেকে কেউ ওকে ফিসফিস করে ডাকছে । পুরো জঙ্গলে তখন ঝড় শুরু হল। নিরু কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা দেবদারুর নিচে এসে কলসিটা রেখে দিল । ও পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো সাদা কাপড় পরা ওর বাবা, চাচা দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে ওরা বাতাসে মিলিয়ে গেল । নিরু চোখের পানি মুছে বাড়ি ফিরে আসলো ।
পরদিন সকালে ও হিরামন গাঁয়ে গেল আজগর আলী ফকিরের খোঁজে । লোকজন ওকে দেখিয়ে দিল আজগর আলীর বাড়ি । বাড়ির উঠানে একজন বৃদ্ধলোক বসেছিলেন । নিরু জিজ্ঞাসা করলো,
- আজগর আলী দাদু কোথায় ?
ওর কথা শুনে বৃদ্ধলোকটি অবাক হয়ে বলল,
- ও আমার ভাই । চল্লিশ বছর আগে মারা গেছে ও ।
এই কথা শুনে যেন মাথা ঘুরে গেল নিরুর । কোনমতে জিজ্ঞাসা করলো.
- কীভাবে মারা গেলেন তিনি ?
- ওর জ্বর হয়েছিল খুব । কুসুমতলী গাঁয়ের কবিরাজের কাছে গিয়েছিল ঔষুধ আনতে । ফেরার পথে ও হয়তো ঐ জঙ্গলে দেবদারুর তলে বসেছিল বিশ্রাম করতে । সেখানেই মত্যু হয় ওর । আমরা ওর লাশ ওখানেই পাই । ঐ কবরস্থানে ওকে কবর দিয়েছিলাম আমরা ।
নিরু কবরস্থানের কাছে গিয়ে দেখলো পুরানো একটা কবরের পাশে লেখা -
মৃত আজগর আলী ফকির ।
একমুহূর্তের জন্য ওর বুক কেঁপে উঠলো ।
সমাপ্ত...
© bnbooks.blogspot.com