বিপদ - পর্ব ২ - ভৌতিক গল্প

বিপদ
লেখিকা: ত্রয়ী আনআমতা
পর্ব ২


সকাল নয়টা। আকাশে ঝলমলে সূর্য। উঠোনে রোদের আলো ঝিকমিক করছে। তৃণা স্কুলে যাবার জন্য ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল, 'মা যাই।'
শাহিদা বেগম রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটে এলেন। ' ওই মাইয়া দাড়া। কই যাস তুই?'
তৃণা অবাক হয়ে বলল, 'স্কুলে।'
' তো না খাইয়া যাইতাসস ক্যা?'
'খিদা নাই মা।'
শাহিদা বেগম রেগে গেলেন। 'হেই সকাল বেলা উইঠ্যা তর লিগা রুটি বানাইছি। আলু ভাজি করছি। আর তুই কস খিদা নাই! আমার কষ্টের কি কোনো দাম নাই তগো বাপ-বেটির কাছে?'
তৃণা বিরক্তি নিয়ে বলল, ' এরমধ্যে আবার বাবারে টানতাছো ক্যান, মা!'
' টানুম নাতো কী করুম? হ্যায়ও তো তর মতনই। না খাইয়া না লইয়া শইলের হাড্ডি বাইর অইয়া যাইতাছে দুইজনের। হেরপরও হেগো কহনো খিদা লাগে না।'
কথা শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন শাহিদা। এরপর আবার বললেন, ' কি অইল এহনো দাড়াইয়া আছস ক্যান? ঘরে ঢুক। না খাইয়া এক পা ও বাইর অবি না।'
বাধ্য হয়ে তৃণা জুতো-মুজো খুলতে লাগল। তারপর লক্ষী মেয়ের মতোন ঘরে ঢুকে খেতে বসল। শাহিদা বেগম স্টিলের থালায় করে রুটি-ভাজি নিয়ে এসে তৃণার দিকে এগিয়ে দিলেন। তৃণা খেতে খেতে বলল, 'মা চা বানাও নাই?'
'ক্যান খাবি?'
'হ। মাথাটা অনেক ঘুরাইতাছে।'
শাহিদা বেগমের চোখে মুখে আঁধার নেমে এল। তিনি ব্যথিত নয়নে মেয়ের দিকে তাকালেন। গলার স্বর নরম করে বললেন, 'ঘুরাইবোই তো। এহন তর উঠন্ত বয়স। এই বয়সে শইলের অনেক পুষ্টির প্রয়োজন অয়। আমরা তরে ভালো মন্দ কিছু খাওয়াইতে পারি! দুধ-ডিম চোখে দেহসনা কতদিন অইল! খাওয়া তো দূরের কথা। আজকে যদি তর ভাই দুইডা এমুন নিমকহারাম না হইত তাইলে আর এই দিনডা দেখতে হইত না !'
বলতে বলতে তিনি কেঁদে দিলেন।
তৃণা মা'কে স্বান্তনা দেবার জন্য বলল, 'উফ মা সকাল সকাল এমনে কাইন্দো না তো। আমার পুষ্টির লিগা মাথা ঘুরাইতাছে না। স্কুলে অনেক পড়ার চাপ। স্যারেরা অনেকগুলি বাড়ির কাজ দিয়া দিছে। সবগুলি করতে পারিনাই এই চিন্তায় মাথা ঘুরাইতাছে। '
শাহিদা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন। মেয়েকে বললেন, 'মনোযোগ দিয়া পড়ালেখা করিস মা। তর অনেক বড় অইতে হইব। নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়া তর ভাইগো দেহাইয়া দিবি, হেগো লিগা তর দুনিয়া থাইমমা রয় নাই।'
আব্দুল খান সবে সকালের নাশতা করতে বসেছিলেন। গতকাল দুপুর থেকে কিছু খাননি। খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। এরইমধ্যে কোত্থেকে ছোট ছেলে আহাদ এসে খবর দিল, পুরো গ্রাম জেনে গেছে তাদের বাড়ির এ অবস্থার কথা। আব্দুল খান খাবার প্লেট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ছেলেকে বললেন, 'আইজকা তর স্কুলে যাইতে হইব না।'
' ক্যান আব্বা?'
' স্কুলে গেলে একেকজন একেক কথা জিগাইব। তহন তুই কি উত্তর দিবি! তার থিকা ভালো কয়ডা দিন বাসায় থাক। সব ঠান্ডা হোক। তারপর যাইছ।'
আহাদ চুপ করে শুনে গেল। সে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। এখন স্কুলে না গেলে অনেক পড়া পিছিয়ে যাবে। দেখা যাবে সে পরীক্ষায় দুয়েক নাম্বার হলেও কম পাবে। বর্তমানে ক্লাসে তার রোল এক। তখন হয়তো ওই মুদি দোকানদারের মেয়ে তার জায়গা নিয়ে নেবে। এটা সে কিছুতেই হতে দিতে পারে না। যেভাবে হোক স্কুলে যেতেই হবে। কে কী বলল না বলল তাতে তার কিছু যায় আসে না।
সন্ধ্যা সাতটা। শাহিদা বেগম কুঁপির আলোয় বসে বসে কাঁথা সেলাই করছেন। এটা তার রোজকার অভ্যেস। সন্ধ্যেবেলা হালকা জলখাবার খাইয়ে মেয়েকে পড়তে বসান, আর নিজে বসেন কাঁথা সেলাই করতে। তিনি খুব ভালো সেলাই করতে পারেন। তাই পাশের গ্রাম থেকেও মানুষ ছুটে আসে তার কাছে। শাহিদা বেগম তাতে খুশি হন। এতে ঘরে দুটো পয়সা আসে।
তৃণা বারান্দায় তার পাশে বসে পড়ছে। শাহিদা বেগম ওকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তৃনা কয়ডা বাজে রে?'
কিছুদিন আগে রফিক ভুঁইয়া স্কুলে পরে যাওয়ার জন্য মেয়েকে একটা হাতঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন। এটাই তাদের ঘরের একটি মাত্র ঘড়ি। তৃনা সেটা ব্যাগ থেকে বের করে সময় দেখল। বলল, ' সাড়ে সাতটা বাজে মা।'
হঠাৎ শাহিদা বেগমের মনে দুশ্চিন্তা জেঁকে বসল। ভাবতে লাগল, তৃণার বাবা এখনো ফিরছে না কেন? গতকাল চেয়ারম্যান সাহেব গ্রামের সকলকে ডেকে বলে দিয়েছে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে না থাকতে। অথচ সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল তৃণার বাবা ফিরছে না। কোনো বিপদ-আপদ হল না তো!
শাহিদা বেগম কাঁথা ভাজ করতে করতে বললেন, 'তুই পড়তে থাক। আমি একটু তর বাপের দোকানে যামু। যাইয়া দেহি হ্যায় এহনো আইতাছে না ক্যান।'
তৃণা গতকালের ঘটনার ব্যাপারে অজ্ঞ।। তাই বলল, 'কিন্তু বাবা তো রাত নয়ডার আগে দোকান বন্ধ করে না, মা। এই সময়ে তো আহার কথা না বাবার।'
'আজকে সন্ধ্যার আগেই ফেরার কথা আছিল তর বাবার। এহন থিকা সন্ধ্যার আগেই ফিরব।'
'ক্যান মা? '
শাহিদা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, 'এতকিছু জাননের দরকার নাই। আর শোন কাইলকা থিকা স্কুলে মেইন রাস্তা দিয়া ঘুইরা যাবি। খান বাড়ির উপরে দিয়া যাবি না।'
তৃণা জিজ্ঞেস করল, 'কী হইছে মা? স্কুলে সবাই কইতাছিল জাফর ভাইয়ে না-কি পাগল হইয়া গেছে? আহাদরে সবাই খেপাইতাছিল ওর ভাইয়ে না-কি পাগল।'
' পাগলই। পাগল ছাড়া ভালো মাইনষে কী এমুন কাম করব নি।'
'মা কও না কী হইছে?'
শাহিদা বেগম উত্তর দিলেন, ' ইন্ডিয়ার থিকা যেদিন ফিরছে সেদিন থিকা জাফর জানি কেমুন হইয়া গেছে। যারে পায় তারেই বলে কামড়াইয়া দেয়।'
খান বাড়িতে হুলস্থুল লেগে গেছে। জাফরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে তালা ঝুলছে কিন্তু সে নেই। এটা কীভাবে সম্ভব! একটা জলজ্যান্ত মানুষ তো হুট করে এভাবে ঘর থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে না। না এখন তো আর জাফর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ নেই। সে একটা উন্মাদ জন্তু হয়ে গেছে। যার খাবার জীবন্ত মানুষ।
রকিং চেয়ারে বসে বসে ভাবছিলেন আব্দুল খান। তার চুল এলোমেলো, চেহারা বিধ্বস্ত। মাগরিবের সময় থেকেই এমন করে বসে আছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না তার ওমন উন্মাদ ছেলেকে কী করে খুঁজে বের করবেন। আচ্ছা জাফরের মতো নাহিদা আর মুশফিক উধাও হয়ে যায় নি তো?
ভাবনা শেষ হতেই স্ত্রীকে ডাকলেন। 'রেহানা..এই রেহানা..।'
দু নম্বর ডাকটা পরার আগেই রেহানা খানম এসে স্বামীর সামনে হাজির হলেন। বললেন, 'আমারে ডাকতাছিলেন ?'
আব্দুল খান বললেন, 'হ। কামের কথা শুনো, নাহিদা আর মুশফিক খাওনের ঘরে বন্দী আছে তো?'
'জানিনা। কালকে রাইত্তে তো দেখছিলাম ঠিকই আছে। এহনো ঠিকই আছে মনে অয়।'
আব্দুল খান রাগান্বিত কন্ঠে বললেন, ' কাইলকা দেখছ ঠিক আছে এর মানে যে আইজকাও ঠিক থাকব তা কেম্নে বুজলা? তুমি কি জ্যোতিষী? '
রেহানা খানম স্বামীর তাকে নিয়ে করা রসিকতাটা ধরতে পারলেন না। স্বাভাবিক থেকেই বললেন, 'আপনে চিন্তা কইরেন না আমি গিয়া দেইখা আইতাছি।'
আব্দুল খান তাড়া দিলেন, 'তাড়াতাড়ি যাও!'
রেহানা খানম নিঃশব্দে হেটে খাবার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। পাছে নাহিদা, মুশফিক টের না পেয়ে যায়। তারপর খুব ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে উঁকি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কেউ একজন দু'হাত দিয়ে খামচিয়ে তার মাথাটা টেনে ধরল। আকস্মিক আক্রমণে রেহানা খানম চমকে গেলেন। হাত দু'টি তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
জানালার শিক গুলো একটা আরেকটার বেশ কাছাকাছি। এর মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র একজন মানুষের হাতই ঢুকানো সম্ভব, মাথা নয়। তাই অবিরত চেষ্টার ফলেও রেহানা খানমকে ভেতরে নেওয়া সম্ভব হল না। তিনি ধ্বস্তাধস্তি করতে লাগলেন নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। হাজার চেষ্টা স্বত্তেও পারলেন না।
রেহানা খানম নিজের আত্নরক্ষার জন্য কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। যেটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। হঠাৎ তার নজর পরল রান্নাঘরের বটির উপর। তিনি পা দিয়ে বটিটাকে নিজের দিকে ঠেলতে লাগলেন। এতে তার পা কেটে যেতে পারে এ কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে। ফলস্বরূপ বটির ধারালো অংশ লেগে পায়ের তালু খানিকটা কেটে গেল। তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। হাত দু'টো থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় এখন এটাই তার কাছে মুখ্য। হাত দুটি তখনও তার মাথাটাকে জানালা দিয়ে অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
একপর্যায়ে বটিটা রেহানা খানমের সামনে এসে পরল। কিন্তু এবার বিপত্তিটা বাঁধল বটিটা ধরা নিয়ে। তিনি কোনো ক্রমেই নিচু হতে পারছেন না।রেহানা খানম ওভাবেই চেষ্টা করতে লাগলেন বটিটা ধরার জন্য। অনবরত বাম পাশে কাত হয়ে নিচু হবার চেষ্টার জন্য ঘাড়ে টান খেলেন। ব্যথায় মৃদু কঁকিয়ে উঠলেন। তবুও হাল ছাড়লেন না। চেষ্টা এবং ভাগ্য দুইয়ের মিলনে অবশেষে তিনি বটিটাকে হাতের মুঠোয় নিতে সক্ষম হলেন। রেহানা খানম সাবধানে মাথাটাকে বাঁচিয়ে হাত দু'টোর ওপর শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে কোঁপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাত দু'টো তার মাথা ছেড়ে দিল। তৎক্ষনাৎ রেহানা খানম দৌড়ে জানালার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালেন। রান্না ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।
এই বয়সে এমন নারকীয় তাণ্ডব সহ্য করে তিনি এখনো বেঁচে আছেন এটা ভাবতেই তার অবাক লাগছে। তিনি হাঁপ ছেড়ে জানালার দিকে তাকালেন। দেখলেন সেখানে তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে আরিফা দাঁড়িয়ে। যাকে কাল মুশফিক আর নাহিদা কামড়ে মেরে ফেলেছে। আরিফার দৃষ্টি হিংস্র, চেহারা বর্ণনাতীত ফ্যাকাশে। মুশফিক, নাহিদার মতো মুখে কালশিটে দাগ। রেহানা খানমের ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেল। মরা মানুষ এমন জ্যান্ত হয়ে গেল কীভাবে? তিনি সব চিন্তা জলজ্যান্ত বলি দিয়ে দ্রুত ওখান থেকে ভেতরে চলে এলেন।
অনেকক্ষণ হল শাহিদা বেগম বেরিয়েছেন। তৃণা ঘড়িতে সময় দেখল, রাত নয়টা বাজে। প্রায় দেড় ঘন্টা হতে চলল। তৃণার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পরল। এত রাত হয়ে গেল এখনো ফিরছে না কেন তার মা?

চলবে...

© bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.