পর্ব ২
আরজু তার ভাইয়ের কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে আমার দিকে তাক করলো । আমি চুপ করে আছি । গোডাউনের দরজা হঠাৎ খুলে গেল । একটা অর্ধ-উলঙ্গ মেয়ে আমার দিকে আসছে । তার পুরো শরীর জুরে এক ধরনের উজ্জল আলোর রশ্মি ঘিরে আছে । সেই আলোতে ময় হয়ে গেছে পুরো গোডাউন । আমার হাতের বাধনগুলো খুলে গেল আমি ফ্লোরে পরে গেলাম । আমি শরীরে কোন শক্তি পাচ্ছি না । ঘুমে আমার চোখ আচ্ছন্ন হয়ে আসছে প্রচন্ড আলোয় আমি তাকাতে পারছি না । দুটো গুলি ছুটার শব্দ পেলাম । কারা যেন চিৎকার করতে করতে বাহিরে চলে গেল । সম্ভবত আসফাক আর আরজু । আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে । আমি জোর করে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম কে এই অর্ধ-উলঙ্গ মেয়ে । কিন্তু আমি পারলাম না ।
....................
চোখ মেলে দেখি আমি ফ্লোরে পরে আছি । আমি উঠে দাঁড়ালাম । গোডাউনের দরজা খোলা । আশে-পাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই । কে আমাকে বাঁচালো । আমি জানি না কে সে । গোডাউন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসলাম । নিলু ভাবীর কাছে আগে যাওয়া প্রয়োজন । আমি ক্লিনিকে গেলাম কিন্তু নিলু ভাবী একদিন আগেই বাড়ি চলে গেছে । আশ্চর্য আমি একদিন একরাত ওমন অচেতন হয়ে ফ্লোরে পরে ছিলাম । আমি বাসায় আসলাম । বাসাতে ঢুকতেই দেখি পনেরো বছর বয়সের এক মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে । সে এসেই আমাকে বলল, "তুমি মিতু আপা না । তুমি কই ছিলা । তুমি নাকি মরে গেছ ।" আম্মু ঘর থেকে চিৎকার করে বলছে" কে এসেছে রে দিপা? দিপা নামের কেউ তো আমাদের বাসায় ছিলো না । হয়তো উনি ভাবির দেখাশুনা করতে এসেছে । দিপা চেচিয়ে বলল, "মিতু আপা আসছে আম্মা ।" আম্মু ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন । ভাইয়া ভাবী , জামাল, ইলা, আমার শশুড়-শাশুড়ি সবাই আছেন । কিন্তু আব্বুকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না । জামাল আমার হাত ধরে বলল, তুমি কই ছিলে বলেতো? আমি জামালের কথায় অবাক হয়ে বললাম কেন গোডাউনে । জামাল ভাইয়ার দিকে তাকালো । ভাইয়া বলল, "আমরা কতবার গোডাউনে গেলাম । গোডাউনের আশে-পাশে কত খুজলাম । তোকে কোথাও পাইনি । ইলা আমার কাছে এসে বলল, " এতো কথা বলো নাতো এখন চলো তুমি আগে ফ্রেস হয়ে নাও ।" আমি ভাবির দিকে তাকাতেই ভাবি মুচকি হাসলেন । আমি ফ্রেস হয়ে ভাইয়ার রুমে গেলাম । ভাইয়া লেপটবে কাজ করছে । ভাবি বিছানায় বসে আছে । আমি ভাবির পাশে বসে বললাম, "তোমার বাচ্ছা কোথায় ভাবি? ভাবি ভাইয়ার দিকে তাকালো । আমি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ভাইয়া বলল, " আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি মিতু।" আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো । আমি রুমে থেকে বের হয়ে ছুটে পুকুর পারে এলাম ।
পুকুরের ঘাটে বসে পানির দিকে তাকিয়ে আছি । এই পুকুর থেকেই আমার সব আশ্চর্য ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে । ভাইয়া আর জামাল যদি আমায় গোডাউনে না পায় তাহলে আমি ছিলাম কই । আবার গোডাউনে আসলাম কি করে । ভাবির বাচ্চাটা মারা যাবে কেন! গ্রেগনেন্সির সব রিপোর্ট তো ভালই ছিলো । আর আব্বু কোথায় আব্বুকে কোথাও দেখছি না কেন?
ভাবি আমার পাশে এসে বসল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "আব্বু মারা গেছেন মিতু! মূহুর্তে আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ কম্পিত হলো । আমি ভাবিকে জড়িয়ে ধরলাম । আমি কান্না জড়িত কন্ঠে বললাম, " আমার সাথে এসব কি হচ্ছে ভাবি । আব্বু মারা গেছেন আমি কিভাবে বিশ্বাস করব ।" ভাবি শান্ত গলায় বললেন, "হঠাৎ শ্বাস কষ্ট শুরু হয় । ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা যান । তোমার কোন খোজ না পাওয়ায় আমরা অপেক্ষা করিনি ।" আমি নিজেকে সংযত করে বললাম, "তুমি তো সব কিছু জানতে পারো । আমি কোথায় ছিলাম? সেই অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েটি কে?" ভাবি পুকুরের দিকে তাকালো । মাথা নিচু করে বলল, "আমার মেয়ে" । আমি ভাবির দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললাম, মানে? "আমার মেয়ে তোমাকে বাঁচিয়েছে মিতু ।" আমি ভাবির দিকে তাকালাম । ভাবির চোখদুটো রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে । আমি ভাবির কাধে হাত রাখলাম । ভাবি শান্ত হলো । আর কথা বাড়ালাম না আমি ।
আম্মুর রুমে এসে দেখি তিনি আব্বুর ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন । আমি আম্মুর পাশে বসে বললাম," দিপা মেয়েটি কে আম্মা? আম্মু আমার দিকে তাকালো না । বললেন দিপাকে আব্বু নিয়ে এসেছিলেন । মেয়েটির কেউ নেই । কোথায় যাওয়ার জায়গা নাই । তোর বাবার কাছে এসে অনেক আকুতি-মিনতি করে । তোর বাবার দয়া হয় । তিনি সরল মনের মানুষ কিনা ।
দিপা এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসলো । আম্মা দুধটা খেয়ে নেন । আম্মু দিপার কথা অদ্ভুদ ভাবে শুনে । যা বলে তাই করে । তবে ভালো কাজ করে বলে আমি কিছু বলি না ।
রাতে জামালের সাথে একটা লোক আসলো । জামালের অফিসের কলিগ । স্বাস্থ্যবান মানুষ । জামাল আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ডাকলেন । আমি সোফায় বসতে বসতে বললাম," কেমন আছেন মির্জা সাহেব? জামাল আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । মির্জা সাহেব আমার দিকে হকচকিয়ে তাকিয়ে বললেন, আপনি আমায় চিনেন? আমি জানিনা আমি কিভাবে তার নাম জানলাম । আগে কখনো তার সাথে আমার দেখা হয়নি । আমি চুপ করে আছি । দিপা চায়ের ট্রে নিয়ে আসল । আপা নিলু ভাবি আপনাকে ডাকছে । বলেই দিপা চলে গেল । আমি বললাম, আপনারা গল্প করুন আমি আসছি । নিলু ভাবি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । আমার দিকে না তাকিয়ে বলল," এসো মিতু । তুমি মির্জা সাহেবকে কি করে চিনো ?" আমি জানি না ভাবি । তিনি আমার দিকে ঘুরে বললেন, মনে করার চেষ্টা করো । আমি বিড়বিড় করতে লাগলাম । মনে পড়েছে ।
"আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে । আমার ক্লাস শিক্ষক ছিলেন তিনি । একদিন টিফিনের সময় আমি ওয়াশরুমে আমার টিফিন বাটি পরিষ্কার করছিলাম । তিনি এসে আমার সাথে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে । আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই । আমি ছুটে একটা রুমে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি । তিনি আমার পিছু পিছু আসেন । হঠাৎ একটা সাদা শাড়ি পরা মেয়ে আমার সামনে আসে । তার শরীর জুড়ে ছিল আলোর রশ্মি । আমি সেন্সলেস হয়ে যায় । চোখ মেলে দেখি আমি আম্মুর কোলে ।"
ভাবি আমার কাছে এসে বলল, "তারপর মির্জা সাহেবের শিশু যৌন হয়রানির জন্য চাকরি চলে যায় । তিনি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন । গত পাঁচবছর তিনি জামালের অফিসে কাজ করছেন ।" আমি অবাক হয়ে বললাম," তুমি এসব কিভাবে জানো ?" ভাবি মুচকি হাসলেন । জামাল ভাবির রুমে আসল । মির্জা সাহেব চলে যাচ্ছেন । তিনি আমার সাথে দেখা করতে চান । "আমি দেখা করব না", জামালের দিকে তাকিয়ে বললাম । আমার পুরো শরীর ঘিনঘিন করতে লাগল । আমি ভাবির রুম থেকে বেরিয়ে আমার রুমে এসে গোসল করলাম ।
আমি ঠিক করলাম আমি একজন সাইকোলোজিস্টের সাথে দেখা করব । আমার এমন হ্যালুসিনেশন কেন হচ্ছে । আমি সকাল সকাল বেরিয়ে পরলাম । আমার বান্ধবী তমা আমাকে এক সাইকোলোজিস্টের ঠিকানা দিয়েছে। তিনি রোগির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেন । আমি রিক্সা করে যাচ্ছি । ভাইয়া ফোন করেছে । ফোন রিসিভ করতেই বলল, ইলাকে দেখতে পাত্রপক্ষ এসেছে তুই আয় ।" আমি একটু পর যাচ্ছি বলে কল কেটে দিলাম । বাড়িতে সবাই আছে । সেখানে কোন অসুবিধা হবে না । কিন্তু আমার সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া প্রয়োজন । তমা আমায় একটা কার্ড দিয়েছে । কার্ডে শুধু ঠিকানা দেওয়া । নাম আশিষ ঘোষ । আমি ঠিকানায় পৌছালাম । একতলা বাড়ি । জীর্ণস্বীর্ণ রঙচটা বাড়ি । আমি দরজায় হাত দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করলাম । একজন বয়স্কলোক দরজা খুলে দিলেন । মানুষ বৃদ্ধ বয়সেও এতো সুন্দর হয় আমার জানা ছিলো নাহ । তিনি গম্ভির গলায় বললেন, "কাকে চান? আশিষ ঘোষ আছেন? তিনি আমায় ভেতরে নিয়ে গেলেন । বাড়িটা শুনশান । নিশ্চুপ । আমি একটা কাঠের চেয়ারে বসলাম । তিনি একটা জলচৌকিতে বসতে বসতে বললেন, " তোমার নাম মিতু? জ্বি- । " তোমার কথা তমা বলেছে । তো তোমার সমস্যা কি?" আমি বললাম, " ছোটবেলায় পুকুর পাড়ে বসে আমি পুতুল খেলছিলাম । হঠাৎ পুকুরের পানি থেকে একটা অপরুপ মেয়ে আমায় ডাকলো । আর আমি পুকুরে লাফ দিলাম তার কাছে যাবার জন্য । কিন্তু সাতার না জানায় আমি ডুবে গেলাম । চোখ মেলে দেখি আমি আম্মুর কোলে । সেদিন থেকে আমি কারও হাসির শব্দ, আর নুপুরের শব্দ শুনতে পাই ।"
আশিষ ঘোষ আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন"তোমার কোন বোন নেই । তুমি খুব করে চাইতে তোমার যদি একটা বোন থাকতো তাহলে বোনের সাথে তুমি পুতুল খেলতে পারতে । কারণ তোমার ভাই তোমার সাথে খেলতো নাহ । তুমি মনে মনে কল্পনা করতে একটা বোনের আকৃতি । তুমি সেদিন পুতুলের বিয়ে দিচ্ছ । কিন্তু পাশে কেউ নেই । হঠাৎ তুমি মন খারাপ করে পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকো ।"
তিনি আমার অনুমতি না নিয়েই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলেন । আমি একদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে আছি । তিনি সিগারেটে টান দিয়ে বলতে লাগলেন,"তোমার কল্পনার আকৃতি তোমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে । আর তুমি তার কাছে যাবার জন্য পানিতে লাফ দাও । এই ঘটনার পর তুমি আর কখনো পানিতে নামোনি । কারণ তোমার ভয় হয় যদি পানিতে তলিয়ে যাও । অথবা সেই কল্পনার মেয়েটি তোমায় নিয়ে যায় ।"
ভাইয়া ফোন করেছে । আমি ফোন ধরলাম । আমাকে যেতে হবে । ইলাকে তারা পছন্দ করেছে । আমি উঠে দাঁড়ালাম । তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছেই আছে ।" আমি চলে আসলাম ।
বাড়িতে সবাই নিশ্চুপ । দিপা আমায় দেখে বলল, আপা সবাই নিলু ভাবির ঘরে । ইলা আপাকে দেখতে আসছে । আমি গেলাম । রুমে ঢুকতেই চোখ আটকে গেল তৈমুরকে দেখে । তৈমুর আমাদের পাশের মহল্লার ছেলে । সে আমায় প্রোপোজ করেছিল । কিন্তু, আমি বাবার ভয়ে রাজি হইনি । ভাইয়া আমার কাধে হাত রেখে বলল, " তৈমুর খুব ভালো ছেলে । সে আমার অফিসেই কাজ করে ।" তৈমুর আমার দিকে একবার তাকিয়ে আর তাকাচ্ছে না । আমি নিলু ভাবির কাছে গিয়ে বললাম,"তুমি বলো, তৈমুর কি ইলার জন্য সঠিক ।" ভাবি মুচকি হেসে বলল, "হ্যাঁ, তোমার কথা তৈমুর ভুলে গেছে । সে সেদিনের কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছে । তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে ।"
আমি আমার রুমে যাচ্ছিলাম । নিলু ভাবি আমার হাত পেছন থেকে ধরে বলল, "আশিষ ঘোষ কি তোমার সংশয় কাটাতে পেরেছে ।" আমি মোটেও অবাক হইনি । কারণ ভাবির এ ধরনের কথায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি ।
আমি ভাবির চোখে চোখ রেখে বলি ," তিনি তার যুক্তি দেখিয়েছেন । কিন্তু একটা যুক্তি দিয়ে সব রহস্যের জট খুলা মুশকিল । আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তিত নই । চিন্তিত তোমাকে নিয়ে ।"
ভাবি মুচকি হাসলেন । বললেন, " তাহলে আমার কথা না বলে তুমি তাকে তোমার কথা বললে কেন?"আমি কোন উত্তর দিলাম না । এর উত্তর আমার কাছে নেই ।
পর্ব ৩
আমি আমার রুমে যাচ্ছিলাম । নিলু ভাবি আমার হাত পেছন থেকে ধরে বলল, "আশিষ ঘোষ কি তোমার সংশয় কাটাতে পেরেছে ।" আমি মোটেও অবাক হইনি । কারণ ভাবির এ ধরনের কথায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি ।
আমি ভাবির চোখে চোখ রেখে বলি ," তিনি তার যুক্তি দেখিয়েছেন । কিন্তু একটা যুক্তি দিয়ে সব রহস্যের জট খুলা মুশকিল । আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তিত নই । চিন্তিত তোমাকে নিয়ে ।"
ভাবি মুচকি হাসলেন । বললেন, " তাহলে আমার কথা না বলে তুমি তাকে তোমার কথা বললে কেন?"আমি কোন উত্তর দিলাম না । এর উত্তর আমার কাছে নেই ।
.................................
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পরেছে । নিস্তব্ধ পরিবেশ । কারও কান্নার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে গেল । ভয় করছে । জামালকে ডাকতে চাইলাম । সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । কয়েকবার ডাকার পরও সে উঠলো না । আমি উঠলাম । জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে আসছে । আমি জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম । কান্নার আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে । ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ । আমি দরজা খুলে বাহিরে এলাম । পুকুর পাড় থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে । আমার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে । আগে কখনো এমন কান্নার আওয়াজ শুনিনি । এক পা দু পা করে পুকুর পাড়ে আসলাম । আমার চোক আটকে গেল বকুল গাছের দিকে । ভাবি বসে আছে । তার কোলে একটা ফুটফুটে মেয়ে । মেয়েটির শরীর জুড়ে আলোর রশ্মি । বকুল তলা সেই রশ্মিতে ময় হয়ে গেছে । ভাইয়া বলল তারা তাদের সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি । তাহলে ভাবির কোলে এই ফুটফুটে মেয়েটি কে ? আমি ছুটে ভাবির কাছে আসতেই দেখি সেখানে কেউ নেই । একটা মৃদু ঠান্ডা বাতাস আমার শরীরকে বরফের মতো ঠান্ডা করে দিয়ে গেল । আমি পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছি । নিজেই নিজের নিশ্বাসের ভারি আওয়াজের শব্দ শুনতে পাচ্ছি । পিছন থেকে ভাইয়ার ডাক শুনতে পেলাম । আমার পিছনে তাকানোর সাহস হচ্ছে নাহ । ভাইয়া কয়েকবার বলল, "মিতু , এতো রাতে তুই কি করছিস এখানে? আমি কিছু না বলে আমার রুমে চলে আসলাম । জামাল এখনো ঘুমুচ্ছে । আমি এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পরলাম ।
তিন দিন পর ইলার বিয়ে । সবাই আয়োজনে ব্যস্ত । বেশ আয়োজন করেই বিয়ে হচ্ছে ইলার । আব্বু মারা যাবার পর থেকে আমার শশুড় বাড়ি আর যাওয়া হয়ে উঠে । সবাই আমাদের বাড়িতেই আছি । আম্মুর অনুরোধে ইলার বিয়ে আমাদের বাড়িতেই হচ্ছে । আমি আমার শশুড় বাড়ি যাবার জন্য বেরুতেই ভাবির সাথে দেখা । আমি ভাবির কাছে গিয়ে বললাম, " গতরাতে বকুল তলায় তুমিই ছিলে তাইনা! ভাবি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, "রাতে আমি বকুল তলায় কি করব ।" ভাবি আমার দিকে তাকাচ্ছে না । তার মানে সে মিথ্যা বলছে । আমি কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে পরলাম ।
রাস্তায় দেখা হলো আসফাকের সাথে । তার এক পা অচলের মতো । সে আমায় দেখে পালাচ্ছে । আমি আসফাকের পিছু নিলাম । কারণ আমার মনে হয় তারা সেই অর্ধ-উলঙ্গ মেয়ের সম্পর্কে জানবে হয়তো । আসফাক একটা ক্লিনিকে ঢুকল । আমি পিছু পিছু গেলাম । ক্লিনিকের একটা রুমে আসফাক প্রবেশ করল । আর বের হচ্ছে না । আমি আর দ্বিধা না করে রুমের ভেতর প্রবেশ করলাম । আসফাক ভয়ে চিৎকার দিয়ে বলল, "কেন এসেছেন এখানে?চলে যান আপনি!" বেডে উপর শুয়ে আছে আরজু । তার সৃতিশক্তি দূর্বল । সে মাঝে নিজেকে মনে করছে আমার মাঝে মাঝে নিজের নামটায় ভুলে যাচ্ছে । আমি আসফাককে শান্ত করে বললাম, "সেদিন তোমাদের সাথে কি হয়েছিল? আসফাক আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো । আমি কিছু জানি না এই ভেবে সে বিশ্মিত হচ্ছে । সে কাপা কাপা গলায় বলল, " সেদিন একটা মেয়ে তার আলোয় আমাদের আবিষ্ট করল । মেয়েটি আকাশের দিকে দুটো গুলি ছুড়ল । সেই আলোয় ঝলসে যাওয়ার মত অবস্থা হলো আমাদের । আমার একটা পা অচলের মতো হয়ে গেল । আমরা চিৎকার করছি । কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না । আরজু আমায় টেনে হিচরে নিয়ে পালালো । আরজু দুইদিন ভালোই ছিল । পরে আরজু অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল । সে কারও অট্ট হাসি শুনতে পেত । একটা মেয়েকে ছাদের রেলিং ধরে হাটতে দেখতো । ধীরে ধীরে এখন তার সৃতিশক্তি দূর্বল হয়ে পরেছে । সে বাস্তবের সাথে কল্পনার তফাত বুঝতে পারছে নাহ ।"
আমি জিঙ্গেস করলাম, "আপনি আর কিছু দেখেননি? তিনি উত্তর দিলেন, " না দেখিনি ।" আমি ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে পরলাম । তারা বেশি কিছু জানে না । আশিষ ঘোষ এসবের কি ব্যাখ্যা দিবেন । আমি জানি না । আমার একবার যাওয়া প্রয়োজন । আজ যাব না । আমি শশুড় বাড়ির সামনে রিক্সা থেকে নামলাম । গেটে ভেতর থেকে লক দেওয়া । আমি কলিং বেল বাজাতেই এক মধ্যবয়স্ক মহিলা গেট খুলে দিলেন । তার নাম রাজিয়া বেগম । স্বামী মারা গেছেন কয়েক বছর আগে । দুটো সন্তান আছে । আমার শশুড় তাকে এ বাড়ি দেখাশুনার জন্য রেখেছেন । আমি আমার রুমে গেলাম । দরজা খুলতেই মনে হলো কেউ যেন এখনি রুম থেকে চলে গেল । কোথাও ধূলো জমেনি । বেশ পরিপাটি । আলমারির পাল্লা খোলা । এখনো তার এক পাল্লা দুলছে । আমি পাল্লা লাগালাম । রাজিয়া পানি আর বিস্কুট নিয়ে আসলো । আমি পানি খেলাম । দক্ষিনের জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালাম । রাজিয়া বলতে লাগল, "আপা আমি এই ঘরে একদম আসি না । আসলেই কেমন ভয় ভয় করে । এ বাড়িতে মনে হয় ভুত আছে । রাতে আমি থাকি না । দুপুরে অদ্ভুদ শব্দ শুনতে পাই ।" আমি রাজিয়ার দিকে তাকালাম । সে আরো বিস্ময় কিছু দেখেছে । কিন্তু বলতে পারছে না ভয়ে । কিন্তু ভয়টা কিসের! আমি রাজিয়ার হাত ধরে বললাম, "আর কি দেখেছো তুমি?" রাজিয়া কাপা কাপা গলায় বলল, "একটা অর্ধ-উলঙ্গ মেয়ে রাতে ঘুরে বেড়ায় । আমি দুরাত ছিলাম । ভয়ে এখন আর থাকি না ।" আমি জিঙ্গেস করলাম মেয়েটি তাকে কিছু বলে কি না । সে না সূচক মাথা নাড়াল । আমি বললাম, "ভয় পেও না, সে তোমার কিছু করবে না । রাজিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । মনে হচ্ছে সে আমাকেই ভয় পাচ্ছে ।
আমি বাড়ি ফিরলাম । ইলাকে সবাই হলুদ মাখাচ্ছে ।আমি আমার রুমে এসে বসলাম । অনেক ক্লান্ত লাগছে । নিলু ভাবি আসল । আমার পাশে বসতে বসতে বলল, " রাজিয়া বিভিন্ন জিনিস চুরি করে নিয়ে যেতে চায় । তাই সে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন । তোমার ফোনটা রেখে গেছিলা । আশিষ ঘোষ ফোন করেছিলেন ।" আমি উৎসুখ হয়ে বললাম, "তোমার সাথে তার কথা হয়েছে? ভাবি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল । আমি জানতে চাইলাম কি কথা হলো ।
নিলু ভাবি মথা নিচু করে বলল, "তিনি এ বাড়িতে কিছুদিন থাকতে চান । আমি বলে দিয়েছি তিনি আসতে পারেন । আমাদের কোন আপত্তি নেই ।" বলে ভাবি চলে গেলেন । আমি ভাবলাম তিনি কেন আমাদের বাড়িতে থাকতে চাইবেন । আমার মাথা কাজ করছে না । আমি ঘুমিয়ে পরলাম । নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছে । নিজেকে মানসিক রোগি মনে হচ্ছে ।
"আমি ধীর পায়ে হেটে পুকুরের দিকে যাচ্ছি । বাড়িতে কেউ নেই । সবাই কোথায় গেছে জানি না । আমি বকুলতলায় কিছুক্ষন দাড়িয়ে পুকুরের পানিতে নেমে গেলাম । বকুল তলা থেকে পুকুরের মাঝ বরাবর একটা সরু রাস্তা । আমি রাস্তা ধরে পানির নিচে তলিয়ে গেলাম । পানির নিচে একটা পুরো শহর । একটা মেয়ে এসে আমায় একটা বাড়ির সামনে নিয়ে আসল । শহরের প্রতিটি বাড়ি যেন এক একটা রাজ প্রাসাদ । আমি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম । দেখলাম নিলু ভাবি ছোট্ট একটা শিশুকে নিয়ে খেলছে । ভাইয়া ভাবির পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে । আমাকে দেখে তারা অবাক হলো । নিলু ভাবি দৌড়ে এসে তার কোলের শিশুটিকে আমার কোলে দিয়ে বলল, " দ্যাখ মিতু, আমার মেয়েটা ঠিক তোর মত হয়েছে । ওর নাম রেখেছি সেতু ।" শিশুটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "মিতু সেতু, মিতু সেতু ।" আমি অবাক হলাম । এতোটুকু শিশু কিভাবে কথা বলবে । একটা ঘর থেকে প্রচন্ড আলো বেরিয়ে আসলো । আমি চোখ বন্ধ করে আবার তাকালাম । আমি দেখতে পেলাম আমার সামনে সেই অর্ধ-উলঙ্গ মেয়ে দাড়িয়ে । তার চোখ থেকে আমি চোখ সরাতে পারছি না । নিলু ভাবি আমায় বলছে ,"মিতু এইটা আমার বোন । তোর কথা খুব বলে ।" নিলু ভাবির কোলে থাকা শিশুটি অনবরত বলছে খালা মনি । খালামনি ।"
কারও ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । চোখ খুলে দেখি দিপা অনবরত ডেকেই যাচ্ছে । আপামনি উঠেন । ইলা আপারে নিয়ে সবাই পুকুর পাড়ে যাচ্ছে । আমি উঠে বললাম, "পুকুরে কেন? দিপা বলল, দুধভাত, কলা , পায়েস এগুলো দিতে বলছে আম্মা । সবাই অনেক আনন্দ করছে । আপনিও চলুন" । আমি গেলাম । কলা পাতায় সাজিয়ে পুকুরের পানিতে ভেসে দেওয়া হলো । কি আশ্চর্য নিয়ম । নিলু ভাবি সবার সাথে থাকায় আমি কথা বলতে পারছি না । স্বপ্নের ঘটনাগুলো নিলু ভাবিই বলতে পারবে । নাহ বাড়িতে এতো মানুষ আর বলতে পারলাম নাহ ।
আশিষ ঘোষ ফোন করে জানালেন তিনি আসছেন । আমি তার জন্য রুম পরিষ্কার করে রাখলাম । জামাল অনেকটায় বিরক্ত । আশিষ ঘোষের আসাটাকে সে নেগেটিভ ভাবেই নিচ্ছে । অপরিচিত একজন মানুষ কেন আমাদের বাড়িতে আসবে । তার উপর তিনি একজন সাইকোলজিস্ট । তার মতে কোন মানসিক রোগি নিশ্চয় নিজেকে ডাক্তার ডেকে আনবে না ।
নিলু ভাবি আমার সঙ্গে তেমন করে আর কিছু বলছে না । আমি আম্মুর রুমে গেলাম । আম্মুর আলমারি থেকে কিছু পুরোনো গহনা নিয়ে পরব বলে। আম্মু আলমারির চাবি দিলেন । আমি আলমারি খুলে গহনা দেখতে লাগলাম । আলমারির এক কোনে একটা স্টেম্প পেপার পেলাম । কাগজ খুলতেই দেখি এটা কোন জমি সংক্রান্ত নয় । ভাইয়া কে দত্তক নেওয়া হয়েছে তার সার্টিফিকেট । তারমানে ভাইয়া আমার নিজের ভাই নাহ । আমি দৌড়ে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে আম্মু কাছে গিয়ে বলি, "আম্মু ভাইয়া তোমাদের নিজের সন্তান না" । আম্মু আমার হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে আমার গালে একটা জোরে থাপ্পর মারল । কিছু ক্ষন দুজনেই চুপ করে থাকলাম । আম্মু আব্বুর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, "আমি এখন কি করব বলে দাও ।" আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম । আম্মু কাগজটি পুড়িয়ে ফেলল । আমার হাত তার মাথায় রেখে বলল, "তোকে আমার কসম তুই কাউকে বলতে পারবি না" আমি কসম করলাম । আম্মু আমার দিকে অদ্ভূদ ভাবে তাকিয়ে আছে । যেন তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না । তিনি উঠে গিয়ে কোরআন শরীফ নিয়ে আসলেন । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি । একটা মানুষ কতটা ভয় পেলে এমন করতে পারে । আমি কোরআনে হাত রেখে বললাম, "একথা আমি আর কাউকেই বলব নাহ ।" আম্মু শান্ত হয়ে বসলেন ।
তিনি আব্বুর ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, "বিয়ের পর আমার ১২ বছরেও কোন সন্তান হয় না । তোর বাবাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বলি । কিন্তু তিনি আমায় প্রচন্ড ভালোবাসেন । তাই তিনি বিয়ে করতে রাজি হননি । আমরা সিদ্ধান্ত নিই একটা ছেলেকে দত্তক নিব । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাশেদকে দত্তক নিই । রাশেদের তখন এক বছর বয়স । অনাথ আশ্রমের সামনে কে যেন ফেলে রেখে গেছিল । আমরা আইনী ভাবে রাশেদকে দত্তক নিই । তার তিন বছরের মাথায় আমি অনুভব করি আমি প্রেগনেট । তারপর তুই জন্ম নিস । রাসেদ কোনদিন জানে না সে এ বাড়িতে দত্তক হিসেবে এসেছে । আর রাশেদকে পেয়ে আমরা নতুন করে বাচার স্বপ্ন দেখেছিলাম । আমি চাইনা এ কথা রাশেদ কোন ভাবে জানতে পারুক ।" আমি রুম থেকে বেরিয়ে আমার রুমে চলে এলাম । বাথরুমের ঝর্না ছেড়ে তার নিচে বসে থাকলাম । ভালো লাগছে না প্রচ্ন্ড কষ্ট হচ্ছে । এতো কষ্ট তো হবার কথা না । কেন এমন হচ্ছে?
© bnbooks.blogspot.com