ছায়া সঙ্গী (পর্ব ১) - আবু ইউসুফ : ভৌতিক গল্প

ছায়া সঙ্গী
লেখক - আবু ইউসুফ
পর্ব ১



আজ পাত্র পক্ষ আমায় দেখতে আসবে । ।আব্বু তার রুমে বসে কিতাব পড়ছেন । আম্মু আর ভাবি রান্না করছেন । ভাইয়া মাঝে মধ্যে আমার কাছে এসে বলছেন, "দ্যাখ মিতু, জন্ম-মৃত্যুর মতো বিয়েটাও সত্যি । তুই চিন্তা করিস না । দেখবি বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে" । ভাইয়া আম্মু আর ভাবির কাছে গিয়ে অবাক হওয়ার মত ভাব নিয়ে বলছে, "মিতু কবে বড় হয়ে গেল টেরই পেলাম না । ও চলে গেলে বাড়িটা কেমন ফাকা ফাকা লাগবে " । আমি আব্বুর রুমে গিয়ে আলমারির এক পাশে দাঁড়ালাম । কিছুক্ষণ পর আব্বু কিতাব থেকে মুখ সরিয়ে বললেন, "কিরে কিছু বলবি? আমি চুপ করে আছি । আব্বু কিতাবের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আবার বললেন, " কি বলবি বল! এতো সংকোচের কি আছে । আমি একটা লম্বা শ্বাস নিলাম । ভয়ে আমার বুকের ধুকধুকানি বেশ জোরে কম্পিত হচ্ছে । প্রচন্ড সাহস নিয়ে বলে ফেললাম, " আব্বু আমি এখন বিয়ে করতে চাই না । আমি পড়তে চাই ।" আব্বু চেয়ার থেকে উঠে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন । আমায় খাটে বসিয়ে বললেন, "তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?" আমি না সূচক মাথা নাড়ালাম । ভয়ে আমার গলা পর্যন্ত শুকিয়ে যাচ্ছে । তিনি আমার হাত ধরে বললেন, " তুমি কাউকে ভালোবাসলে আমায় বলতে পারো ।" আমি আবার না সূচক মাথা নাড়ালাম । আব্বু ভারি গলায় বললেন, " পাত্রপক্ষ যখন আজকে আসছে তাদের আসতে দাও । দেখার পর যদি তোমার পছন্দ না হয় তবে বিয়ে করো না । তোমাকে আমরা জোড় করবো নাহ ।" আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম । আব্বু আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, "যাও, এতো চিন্তা করো না ।" আমি দরজা খুলে দেখি ভাইয়া আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে । সে নিরবতা ভেঙে বলল, "কিরে, আব্বু তোকে কি বলল?" আমি কিছু না বলে ছাঁদে চলে এলাম । নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর আপন ইচ্ছেই নেমে গেল ।
পাত্রপক্ষ এসেছেন । ভাবি দুপুর থেকে আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে । কি অদ্ভূদ! তারা তো আর বিয়ে করতে আসছে নাহ । এতো সাজানোর কি আছে । এসব ভারি ভারি গহনা পরতেও কেমন জানি বিরক্ত লাগে । আম্মু এসে বললেন, "কিরে তোদের হলো? তারা আর কতক্ষণ বসে থাকবে! নিলু মিতুকে নিয়ে এসো ।" ভাবি আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভির হয়ে বলল, "মিতু আজ তোমার বিয়ে হবে । তোমার স্বামীর নাম জামাল হোসেন । তিনি বোকাসোকা ভদ্র টাইপের লোক ।" আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি ভাবির দিকে । ভয়ে আমার গলা পর্যন্ত শুকিয়ে আসছে । আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের আগের রাতে ভাবি আমার রুমে এসে বলেছিল, "মিতু ,তুমি পাশ করতে পারনি । তবে কষ্ট পেও না আগামী বছর খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করবে" । সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি । পরে ভাবির কথায় সত্যি হয় । আমি নিজেকে সংযত করে ভাবি কে বললাম, "বিয়েটা কি আমার জন্য শুভ নাকি অশুভ? তিনি কোন উত্তর না দিয়ে বললেন, " চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে ।"
আমার বিয়ে খুব স্বল্প আয়োজনে সম্পূর্ণ হলো । আব্বুর উপর কথা বলার দুসাহস আমার নেই । জামাল সাহেবও আমার লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন । তাই আমিও আর না করিনি । আজ আমি আমার শশুড় বাড়ি যাব । জামাল সাহেব আর আমার ননদ ইলা আমায় নিতে এসেছেন । আমার শশুড়-শাশুড়ি আসেননি । আমি ভাইয়ার রুমে গিয়ে দরজায় দাঁড়ালাম । ভাইয়া লেপটবে অফিসের কি যেন কাজ করছে । আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । ভাইয়া আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, "কিরে আজ চলে যাচ্ছিস দেখে মন খারাপ । চিন্তা করিস না । আমি দুইদিন পরপর তোকে গিয়ে নিয়ে আসবো ক্যামন ।" আমি ভাইয়ার কাধে হাত রেখে বললাম, "ভাইয়া আমি তোকে একটা কথা বলতে চাই" । ভাইয়া আমার দিকে ঘুরে বসল । আমার হাত ধরে বলল, "বল, কি কথা । আমি নিচু গলায় বললাম," ভাবি আমাদের পুকুর পাড়ে সন্ধ্যায় বসে থাকে । পানি ভেদ করে একটা আলো উপরে উঠে এসে ভাবির পাশে স্থির থাকে । তারা গল্প করে মিনিট পাঁচেকের মতো । তারপর আলোটি আবার পানি ভেদ করে মিশে যায় । ভাবি আগে থেকেই সবকিছু জানতে পারে ।" ভাইয়া আমার দিকে অপলক চেয়ে আছে । আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে বললাম কিরে কিছু বলছিস না কেন? সে মুচকি হেসে বলল, "ছোটবেলার হ্যালুসিনেশন দেখি এখনো তোর যায়নি । তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এসব বলছিস" । আমি আর কথা বাড়ালাম নাহ । রুম থেকে বাহিরে এসে দেখি ভাবি দরজার পাশে দাড়ানো । আমায় দেখে মুচকি হেসে বলল, "চিন্তা করো না মিতু ও বাড়িতে তুমি ভালো থাকবে ।"
আমি আমার শশুড় বাড়িতে আসলাম । বাড়িটা একেবারে নির্জন । পুরোনো দোতলা বাড়ি । বাড়ির সামনে নানান ফুলের বাগান । বাড়ির বাহিরটা পুরাতন মনে হলেও ভেতরটা বেশ গুছানো । আমার শশুড়-শাশুড়ি নেই । তারা ক্লিনিকে গেছেন । সাপ্তাহিক চেকাপের জন্য। জামাল সাহেব সোফায় বসলেন । ইলা আমায় সিড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে এলো । এই রুমটা বেশ পরিপাটি । এইটা আমাদের ঘর । দক্ষিনের জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখি পাশে একটা বড় পুকুর । আমি জানালার গ্রীল ধরে হারিয়ে যাই ছোট বেলায় ।
সাত বছর বয়সে আমি আমাদের পুকুর পাড়ে বকুল গাছের নিচে বসে খেলছিলাম । হঠাৎ দেখতে পাই একটা সুন্দর মেয়ে আমায় ডাকছে । মেয়েটি এতো সুন্দর ছিলো যে আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না । আমি পুকুর ঘাটের সিড়ি বেয়ে নিচে যাই । কিন্তু পানিতে নামি না । মেয়েটি পুকুরের মাঝ বরাবর দাড়িয়ে আমায় ডাকছিলো । "মিতু, এসো আমরা দুজন মিলে খেলব ।" আমি একসময় পুকুরে লাফ দিই তার কাছে যাওয়ার জন্য । সাতার না জানায় আমি ডুবে যাই । পরে চোখ মেলে দেখি আমি আম্মুর কোলে শুয়ে আছি । বাড়ি ভর্তি লোক । ভাইয়া আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসলে দেখে আমি নেই । পুকুরে তাকিয়ে দেখে আমি ডুবে যাচ্ছি । সে আমায় উদ্ধার করে । তখন থেকে নুপুরের আওয়াজ , পায়ের শব্দ, কারও অট্টহাসি শুনতাম । বড় হওয়ার সাথে সাথে সেগুলোও স্বাভাবিক হয় । তবে এখনো মাঝে মাঝে শুনি কেউ আমায় ডাকছে ।
রাতে ভাইয়ার ফোন আসলো । আব্বুর শরীর ভালো না । ভাইয়া আব্বুকে নিয়ে ক্লিনিকে গেছেন । হঠাৎ নিশ্বাষ নিতে কষ্ট হচ্ছে । আমরা সবাই যেতে চাইলাম । ভাবি নিষেধ করলেন । আমাদের যেতে হবে না । সিরিয়াস কিছু হলে আমাদের জানাবেন । আমি চিন্তায় ঘুমুতে পারছিলাম না । এর মধ্যে জামাল সাহেব হুট করে কোথায় যেন গেলেন । আমি অস্থিরতা কাটাতে বই পড়তে লাগলাম । ভাবি আবার ফোন করেছেন । আমি ফোন রিসিভ করতেই ভাবি ওপাশ থেকে খুব চঞ্চল গলায় বলল, "মিতু তোমার বাড়িতে জামালের সাথে একটা লোক আসবে । নাম আসফাক । তিনি কোক নিয়ে আসবেন । তুমি খাবে না । সাবধানে থেকো । বলেই ভাবি ফোন কেটে দিল । একে তো আব্বুর চিন্তায় আমার ঘুম আসছে না । তারপর ভাবি এসব কি বলছে ।
ইলা আমার রুমে এসে বলল, "আপু, ভাইয়ার সাথে তার বন্ধু আসফাক ভাইয়া এসেছেন । তারা নিচে বসে আছেন । তোমাকে যেতে বলেছেন ।" আমি অবাক হয়ে ইলার দিকে তাকিয়ে আছি । ভাবির কথা আমার মনে পরছে । সে কেন সাবধানে থাকার কথা বলল । ইলা আমার কাছে এসে বলল, "এমন করে কি দেখছো আপু ।" আমি উত্তর না দিয়ে নিচে আসলাম । সালাম দিলাম । বেশ সুদর্শন আসফাক সাহেব । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, "ভাবি আমি আর জামাল বাহিরে খেয়েছি । এই কোকটা নিয়ে আসছি । সবাই খাব বলে ।" আমি তার হাত থেকে কোকের বোতলটা নিয়ে রান্না ঘরে আসলাম । আমাদের ফ্রিজে আগে থেকেই কোকের বোতল ছিল । আমি বোতলটা ফ্রিজে রেখে আমাদের কোক গ্লাসে ঢেলে ট্রে করে নিয়ে আসলাম । তাদের জোড়াজুড়িতে আমিও খেলাম । আসফাক সাহেব চলে গেলেন । আমরা শুয়ে পরলাম ।

সকালে নিলু ভাবিকে ফোন দিলাম । আব্বু ভালো আছে । তারা দশটার দিকে আব্বুকে ছেড়ে দিবেন । বাসায় আসলে আমাকে জানাবে । নিচে আমার শাশুড়ির চিৎকার শুনতে পেলাম । আমি দৌড়ে নিচে এসে দেখি ইলা ফ্লোরে শুয়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে । আমি ফ্রিজে গিয়ে দেখি কোকের বোতল নেই । টেবিলের উপর চোখ পরতেই দেখি সেখানে বোতলের মুখ খোলা । আর গ্লাসে কিছু আছে । আমার বুঝতে বাকি থাকল না । জামাল সাহেব ইলাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন আমিও সাথে এলাম ক্লিনিকে । ইলাকে I.C.U. তে নিয়ে যাওয়া হলো । তার চিকিৎসা চলছে । আমার শশুড়-শাশুড়ি পরে আসলেন । আমি জামালকে ডেকে কোক খাওয়ার ঘটনা বললাম । কিন্তু সে বিশ্বাস করছে না । আমি জামালকে নিয়ে বাড়িতে আসলাম । কিন্তু কোকের বোতল কোথাও নেই । জামাল আমায় ধমক দিয়ে বলল, থাম অনেক হয়েছে । আসফাক আমার ছোটবেলার বন্ধু সে কখনোই এমন কাজ করতে পারে না ।

তিনদিন পর ইলাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো । সে জোরে কথা বলতে পারছে না । নিলু ভাবি আর ভাইয়া এসেছে । ভাইয়া ইলার কাছে বসে আছে । আমি নিলু ভাবিকে হাত ধরে টেনে আমার রুমে নিয়ে গেলাম । ভাবির চোখে চোখ রেখে বললাম, " আমি তোমাকে বিশ্বাস করি কিন্তু আমাকে কেউ বিশ্বাস করবে না ।" নিলু ভাবি আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দক্ষিনের জানালার কাছে গিয়ে বলল, "আসফাক চেয়েছিল জামালের সাথে তার বোন আরজু'র বিয়ে হোক । কিন্তু জামালের মা-বাবা তাকে পছন্দ করতো না । আসফাক চায় তুমি চলে যাও আর তার বোনের সাথে আবার জামালের বিয়ে হোক ।" আমি ভাবির হাত ধরে বললাম,"তুমি এতো কিছু কি করে জানো? ভাবি দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, "আব্বুর শরীরটা ভালো নাহ । এখানে দেরী করা ঠিক হবে না ।" আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভাইয়া এসেছে । তারা আমায় শান্তনা দিয়ে চলে গেল ।

ইলা এখন প্রায় সুস্থ । এই কয়েক মাসে সে অনেক কষ্ট করেছে । আমি আর জামাল ক্লিনিকে যাচ্ছি । নিলু ভাবির প্রেগনেন্সির ব্যাথা হওয়ায় তাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । ক্লিনিকে আসার মাঝ পথে একটা পরিচিতি নাম্বার থেকে ফোন আসে । ইলাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে । তাদের দাবি আমাকে পেলে তারা ইলাকে ছেড়ে দিবে । আমি বুঝতে পারছি এইটা আসফাকের কাজ । জামাল ভয় পাচ্ছে । আমি বললাম কিছু হবে না । আমি ভাইয়া কে ফোন করলাম । নিলু ভাবির অবস্থা বেশি ভালো না । আমি রিক্সা ঘুরিয়ে ইলার কাছে গেলাম । তারা একটা গোডাউনের ঠিকানা দিয়েছে । সবাই মুখোশ পরে আছে । আমাকে একপাশে বেধে রাখা হলো । ইলা আর জামালকে গাড়িতে করে বাড়িতে পাঠানো হলো । চোখ বাধা অবস্থায় কতক্ষন থাকলাম জানিনা । দুটো লোক চোখ খুলে দিল । হালকা আলো চোখে পরাতে কিছু দেখতে পাচ্ছি না । কিছুক্ষন পর আসফাক কে দেখতে পেলাম । সঙ্গে তার বোন আরজু । আরজু শ্যাম বর্ণের । কিন্তু চেহারায় একটা মায়ার ছাপ আছে । আরজু আমায় কয়েকটা থাপ্পর মেরে চিৎকার করতে লাগল । আমার জন্য সে জামাল কে পায়নি । আমি বললাম, "জামালের সাথে আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিলো না ।

তোমার ভুল হচ্ছে আরজু । আরজু অট্ট হেসে বলল, সেই ভুল তোমাকে মেরে শুধরে নিব । আরজু তার ভাইয়ের কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে আমার দিকে তাক করলো । আমি চুপ করে আছি । গোডাউনের দরজা হঠাৎ খুলে গেল । একটা অর্ধ-উলঙ্গ মেয়ে আমার দিকে আসছে । তার পুরো শরীর জুরে এক ধরনের উজ্জল আলোর রশ্মি ঘিরে আছে । সেই আলোতে ময় হয়ে গেছে পুরো গোডাউন । আমার হাতের বাধনগুলো খুলে গেল আমি ফ্লোরে পরে গেলাম । আমি শরীরে কোন শক্তি পাচ্ছি না । ঘুমে আমার চোখ আচ্ছন্ন হয়ে আসছে প্রচন্ড আলোয় আমি তাকাতে পারছি না । দুটো গুলি ছুটার শব্দ পেলাম । কারা যেন চিৎকার করতে করতে বাহিরে চলে গেল । সম্ভবত আসফাক আর আরজু । আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে । আমি জোর করে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম কে এই অর্ধ-উলঙ্গ মেয়ে । কিন্তু আমি পারলাম না ।
© bnbooks.blogspot.com

Bnbooks is one of the largest archieve storage of pdf books, Bengali story, Bangla Kobita, Lyrics and all Kinds of Literature. Tags: Free Bangla pdf books download, Bangla Kobita, Technology News, Song Lyrics.