কিছু সময় পর বাড়িতে গিয়ে দেখি রিতু তখনো কান্না করছে।আমাকে দেখার সাথে সাথে উঠে চলে আসলো।আমার সারা শরীরের অবস্থা দেখে বললো,
-তুমি রাতে কোথায় ছিলে?এই অবস্থা কেন?
-আমি রাতে কোথায় ছিলাম এটা এখন না শোনাই ভালো তোমার জন্য!
তুমি পানি তোলো,আমি গোসল করবো।
রিতুকে এভয়েড করে আমি গোসলে গেলাম।গোসলে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম 'বিক্রম' আর ' V ' সাইনের মানে কি?
গোসল শেষ করে আমি গার্ডের সাথে দেখা করার জন্য বাড়ি থেকে বের হলাম।প্রথমে পার্কে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি তিনি পার্কে আসে নাই।পার্ক থেকে তার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে তার বাড়িতে গেলাম।কিন্তু এ কি?এতো ভীড় কেন?
ভীড়কে পাশ কাটিয়ে ভেতরে গিয়েই দেখলাম মাটিতে গার্ড চাচাকে শোয়ানো।কাহিনী কি জিজ্ঞাসা করতেই একজন বললো,,
-রাতে কোথায় যেন গিয়েছিল!সারারাত বাড়ি না ফেরাতে খোঁজ নিতে বের হলে দেখা যায় একটা রাস্তার পাশে তার মৃতদেহ পড়ে আছে।
তারমানে কি রাতে চাচাকে মেরে ফেলা হয়েছে!ও আল্লাহ,কেন এমনটা হলো তার সাথে।তার মেয়ের কান্না আমি সহ্য করতে পারলাম না।চলে আসলাম।
মাথাটা কাজ করছিলো না।'বিক্রম' আর 'V' সাইনকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম।এক বয়স্ক লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি বিক্রম নামে কোনো কিছুর নাম শুনেছে কিনা?
অনেক ভেবেচিন্তে তিনি বললেন,
-ওদিকটাই একটা বাড়ি ছিলো। নাম বিক্রম ভিলা!
-চাচা, কোনদিকে বলতে পারেন?
-কাটাবনের পাশ দিয়ে গিয়ে পাশের গ্রামটাই।আমি কখনো যাইনি বাবা।
লোকটা ভাঙা ভাঙা গলায় উত্তর দিলো।
আমি আর দেরী না করে কাটাবনের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।আমি আশ্চর্য হলাম এটা ভেবে যে, রাতে আমি যেই বাড়িতে ছিলাম।এখন ঠিক সেই বাড়ির সামনে আমি!
তারমানে এটাই কি সেই বিক্রম ভিলা?
কিন্তু এ বাড়িটা তো অনেকদিনের পুরোনো বাড়ি।পরিত্যক্ত বাড়ি,মনে হয় ৪০ বছর ধরে কেউ এখানে থাকে না।দেখতেই ভুতুড়ে লাগে।
কিন্তু এর সাথে৷ 'V' সাইনের কি যোগসূত্র আছে?
আমাকে আগে এর রহস্য ভেদ করতে হবে।তা না হলে আমি কিছুই বের করতে পারবো না।
আর রহস্য ভেদ করতে হলে আমাকে ম্যানেজার শুভ এর বাসায় যেতে হবে।তার বাড়িতে কোনো না কোনো প্রমাণ অবশ্যই পাওয়া যাবে।
ম্যানেজার শুভ এর বাড়িতে গিয়ে দেখি সকাল সকাল বাড়িটাকে পুলিশ সিলগালা করে দিছে।জন সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
দুজন পুলিশ পাহারায় আছে সামনের দিকটাই।আমি লুকিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
ঘরের ভেতর সেই আগের রাতের মতোই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।
একটা আলমারি দেখে সেটার দিকে এগিয়ে গেলাম।আলমারির ড্রয়ার খুলতেই সেখান থেকে একটা খাতা পেলাম।ভাগ্য ভালো, সেটা পার্কের কিছুর হিসাব।কোন জিনিস কোথা থেকে নিয়ে আনা হয়েছে সেটার নাম ঠিকানা সব লেখা।
পর্যায়ক্রমে খুঁজতে গিয়ে পার্কের দোলনার নাম দেখে চোখ আটকে গেল।
ঠিকানা ঃবিক্রম ভিলা,খোকসা।
এবার আমি পুরোপুরি শিউর হলাম এই দোলনা বিক্রম ভিলা থেকে নিয়ে আসা।কিন্তু কোন দিক দিয়ে যাবো আমি?
দিনের বেলাতেই আমি ম্যানেজারের একটা রুম থেকে দোলনার ক্যাচক্যাচ শব্দ শুনলাম।রুমটার দিকে আগানোর সাহস আমার হলো না।আমি পিছনের দরজা দিয়ে আবারো বের হয়ে আসলাম।
আমি আবারো সেই পুরোনো বাড়ির কাছে চলে গেলাম।ম্যানেজারের দেয়া V সাইনের মানে খুঁজতে লাগলাম।আমি যেদিকটা থেকে এসেছি,তার পাশ দিয়েই আরেকটা রাস্তা চলে গেছে।অনেক ভাবার পরে আমি আবিষ্কার করলাম এটাই সেই V সাইনের রুপ।ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে এটাই V।
আমি সেদিকটাই পা বাড়ালাম।রাস্তাটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে।একদম গা শীতল করা পরিবেশ।আমি আস্তে আস্তে পা ফেলাতে থাকলাম।মনে হচ্ছে এদিকটাই ১০ /১২ বছরেও৷ এদিকে কেউ আসে নাই।হঠাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।আমি থমকে দাঁড়ালাম।এই অন্ধকার হওয়া কোনো অশনী সংকেত নয় তো?
হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তাই।রাস্তার মাঝখানে এ তো সেই দোলনার মেয়েটা।আমাকে তো সামনে এগোতেই হবে।কিন্তু কিভাবে যাবো?মেয়েটা আমার সামনে একটা দোলনা নিয়ে বসে আছে।আমি তাকে দেখে দুই পা পিছিয়ে গেলাম।একটা বাতাস এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।বাতাসে একটা বিশাল গাছ ভেঙে পড়লো আমার মাথার সোজাসুজি। কোনোমতে সেটা থেকে বাঁচলাম।আমার জীবন মনে হয় আজকেই শেষ হয়ে যাবে!
নিজের কাছে নিজেকে প্রশ্ন করলাম।
-ভয় পেয়ো না রাশেদ।তুমি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌঁড় দাও।আমি আছে তোমার সাথে।
সেই কণ্ঠটার সাহস পেয়ে আমি দৌঁড় দিলাম।পিছনে এক প্রকার ঝড় উঠে গেলো।তবুও আমি পিছন ফিরে তাকালাম না।একটা সময় আমি একটা বাড়ি দেখতে পেলাম।হ্যাঁ, এটাই সেই বাড়ি।বড়বড় হরফে লেখা বিক্রম ভিলা।
বাড়ির বিশাল বড় ফটক।চারিদিকে প্রাচীর,দুই পাল্লার একটা বিশাল গেট।যাতে ঝুলছে বড় একটা তালা।
দেয়ালটা কোনোমতে টপকিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।নিস্তব্ধ পরিবেশ,শান্ত বাড়ি।এক পা, দু পা করে যখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন মনে হলো ভেতরে কেউ কথা বলছে।কে কথা বলছে এটা দেখার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম।কিন্তু কেউ নেই।
অজানা ভয়,আর অশেষ আতঙ্ক আমাকে ভাবিয়ে তুললো আমি এ বাড়িতে একা।
ক্রমেই কয়েকজন মানুষের মাঝে কথা বলার পরিমাণ বেড়ে গেল।কিন্তু কে কোথায় কথা বলছে তা আমি ধরতে পারছিলাম না।বাড়ির ভেতরের উপরের বিশাল লাইট টা হঠাৎ করে ভেঙে পড়লো।সারা রুমে কাচ ভর্তি হয়ে গেল।
এবার একটা পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠলো,
-তোর মৃত্যু এখনো হয়নি?
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের এই কথা শুনে এবার আমি ভয় পেয়ে গেলাম।কারণ পরিচিত কণ্ঠটা বললেও একটা কথা ছিল।কিন্তু এই অপরিচিত কণ্ঠটার মালিক কে?
-কে,কে আপনি?
-আমি এই বাড়ির মালিক।
৪০ বছর ধরে এ বাড়িতে আছি।
মাথার মধ্যে একটা বুদ্ধি খেলে গেলো।ইনি আমি কিছু জিজ্ঞাসা না করতেই বলে দিচ্ছে।ইনাকে দোলনার কথা জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়?
-আচ্ছা,এ বাড়ির সাথে কি কোনো দোলনার সম্পর্ক আছে?
-দোলনার জন্যই তো তোমার মৃত্যু হচ্ছে।আর কিছু সময় পরেই সেটা হবে!
কথাটা বলেই হেঁসে উঠলো।
-কিন্তু কেন এই দোলনাটা অভিশপ্ত?
-আজ থেকে কয়েকবছর আগেও আমাদের এই বাড়িটা ভালো ছিল।সুখে ছিলাম আমি,আমার মেয়ে ও আমার স্ত্রী।কিন্তু একটা ঝড় আমাদের সবাইকে শেষ করে দিয়েছে।
-কি সেই ঝড়?
-একদিন এই এলাকায় ঘুরতে আসে একটা লোক।রাতে বাড়ি ফিরতে না পারায় সে আমার বাড়িতে উঠে।আমার মেয়ে তখন বাইরের দোলনাতে বসে ছিল।লোকটার চোখে সেটা আটকে যায়।সে আমার মেয়ের দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে কিছু সময় দেখে।এরপর সেদিকটাই এগিয়ে গিয়ে বলে, এটা খুব সুন্দর।প্রথমে ভেবেছিলাম আমার মেয়েকে বলছে,কিন্তু পরে দেখি না।সে আমাদের তৈরি রুপার দোলনাটিকে এই কথাটা বলছে।সে কিভাবে দোলনাটা দূর থেকে দেখে বুঝল এটা রুপার তৈরি,এটা আজও আমাদের কাছে ধাঁধা।
তারপর আমার কাছে এসে বলে এই দোলনাটা আমরা নিয়ে যেতে চাই।টাকাও দিতে চায়।কিন্তু এ তে বাঁধ সাধে আমার সদ্য ১৮ তে পা দেয়া মেয়ে।ও দোলনাটাতে কাউকে বসতে পর্যন্ত দিত না।সেই জায়গায় ম্যানেজার দোলনা নিয়ে যেতে চায়।আমরা সবাই এটা দিতে অস্বীকৃতি জানাই।এতে ম্যানেজার রেগে গিয়ে একদল সন্ত্রাসী ভাড়া করে আনে।আমার মেয়েটাকে দোলনার উপরেই পিটিয়ে হত্যা করে।
আমাদের দুজনকেও পিটিয়ে হত্যা করে।সেইদিন আমরা তিনজন অনেক আহাজারি করেছিলাম।কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসেনি।
মেয়েটা মৃত্যুর সময় অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলো,
-এই দোলনা যতদিন থাকবে,এতে যেই বসবে তাকেই হত্যা করা হবে।
কিন্তু ম্যানেজার এই দোলনা নিয়ে গিয়ে বসতে নিষেধ করে রেখেছিল কেন?রুপার দোলনা দেখার জন্য কি তার পার্কে বেশি লোক আসতো?
-তুমিও সেই ভুলটাই করেছো।তোমাকেও মরতে হবে!হা হা হা
আকাশ বাতাস উতাল করে লোকটি হাসতে লাগলো।
হঠাৎ করে ডানদিকের জানালা ভেঙে কিছু একটা রুমে প্রবেশ করলো।এবার আমি আমার সামনে স্পষ্ট তিনটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম।
তারা সবাই একসাথে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
সেই সময়ে সেই আমার পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,
-আমি আছি রাশেদ।
পরিচিত কণ্ঠস্বর পেয়ে পিছনে তাকাতেই আমি যা দেখলাম, তাতে আমি খুব অবাক হলাম।আমার ছোট মা আমার পিছনে।
আমার ছোট কাকার বউ।যিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন।আমি যখন ছোট ছিলাম তখন সে মারা যায়।মারা যাওয়ার আগে আমার হাত ধরে বলে গিয়েছিল,
-তোর ছোট মা তোর পাশে থাকবে সবসময়!
-ছোট মা,তুমি?
পর্ব ৫ ও শেষ পার্ট
-হ্যাঁ, আমি।আমিই তোকে ওদের হাত থেকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছি।তোকে আজকেও আমি বাঁচাবো।তুই পালিয়ে যা!
-কিন্তু ছোট মা?
-কোনো কিন্তু নেই,তুই পালা!
মেয়েটার আত্মা বলে উঠলো, যতদিন এই বাড়ি ও দোলনা থাকবে ততদিন কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না!
বলেই হেঁসে উঠলো।
-আর যদি কিছুই না থাকে।(ছোট মা)
ছোট মা আমাকে বললো,
তুই এই বাড়িটাকে ধবংস করার কোনো ব্যবস্থা কর।
-কিভাবে?
-তুই কোনোভাবে আগুন ধরিয়ে দে!তারপর দোলনা টাকে শেষ করে দিবি!
আমি বাড়ি থেকে যখনই বের হতে যাবো, তখনই রুমের দরজা জানালা সব বন্ধ হয়ে গেল।আর পুরো রুম অন্ধকার হয়ে গেল।আমি নিজের শরীরটাকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না।মনে হচ্ছিলো আমি এক অন্ধকার জগতে তলিয়ে গেছি।
রুমের ভেতরে কারো দাপাদাপির আওয়াজ স্পষ্ট আমার কানে আসছিলো। হঠাৎ একটা কাঠের টুকরা এসে আমার মাথায় লাগলো। আমি মাথা ধরে রুমের মধ্যে বসে পড়লাম।কখন আমি জ্ঞান হারিয়েছি আমি নিজেও জানিনা।
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো রিতু তখন আমার মাথায় পানি ঢালছে।চোখ মেলে আমি আমার রুম দেখতে পেলাম।
-রিতু, আমি এখানে কিভাবে?
-তা তো জানিনা,বাইরে কারো গোঙানির আওয়াজ শুনে বাইরে যাই!গিয়ে দেখি তুমি পড়ে আছো।মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে।
আমার তখন মনে হলো ছোট মা আমাকে নিয়ে আসছিলো হয়তোবা।নাহলে আমার কি হতো কে জানে?
*
একটা বিষয় আমার কাছে কোনোভাবেই পরিষ্কার হচ্ছিলো না।সেটা হলো, যেই দোলনা নিয়ে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে।সেই ঘটনা কি পার্কের মালিক জানে না?না তিনি জেনেও চুপ করে আছে।আমাকে এ বিষয়ে জানতে হবে!কিন্তু তার কাছে পৌঁছানোর উপায়?
সেদিন মাথার ব্যথার যন্ত্রণায় আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলাম না পর্যন্ত।ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো আমার আয়ু বোধহয় এবারই শেষ।
রাতে দোলনার দোলার শব্দে ঘুম ভাঙলো।
ঘুম ভেঙে শুনতে পেলাম কেউ একজন করূণ সুরে কান্না করছে।
ততক্ষণে রিতুও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।আমি বিছানা থেকে উঠতে গেলে মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করি।তাই আর বিছানা থেকে উঠিনা।
কান্নার পরিমাণ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।এবার শুধু একজন কান্না করছে না।তিনটা ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম।
বাইরের দিক থেকে আওয়াজ আসছে।
-আমাকে বাঁচাও আম্মু।আমাকে বাঁচাও আব্বু।আমাকে ওরা মেরে ফেললো।তোমরা কোথায়?আমি মরে গেলাম।
এতটা করুণ সুরে আর্তনাদ করছিলো যে মনে হচ্ছিলো সত্যি সত্যি ওপাশের রুমে ও বাইরে কাউকে হত্যা করা হচ্ছে।
এসব বলার পরের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।বুঝতে বাকি রইলো না এটা সেই শয়তানদের কাজ!
রিতু ভয়ে অস্থির হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।কিছু সময় পরে মনে হলো কে যেন কাঁথার মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করতেছে।দুজনের কাছেই এমন মনে হওয়ার সাথে সাথে লাইট জ্বালালাম, কিন্তু কিছুই দেখলাম না।আমার নিজের সাথে এমন হবে, আমি দোলনায় বসার আগে কোনোদিন ভাবতে পারিনি।
লাইট অফ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম হয়না।আধা ঘণ্টা পরে রিতুর চিৎকারে মাথার ব্যথা নিয়েই বিছানায় বসে পড়লাম।
-রাশেদ, কে যেন আমার পা ধরে টান দিয়েছে!
-কই,আমার তো মনে হলো না।
-টান আমাকে দিয়েছে।আমার পা জ্বলছে।
লাইট অন করে দেখি রিতুর পায়ে কারো আঁচরের দাগ।সত্যি সত্যিই বিছানার তলা থেকে কে যেন তার পা ধরে টান দিয়েছে।এবার মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে খাটের তলায় দেখার জন্য রিতুকে বললাম।সে দেখতে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।খাটের তলায় সে বীভৎস কিছু একটা দেখেছে।পরক্ষণেই আমি দেখতে গিয়ে কিছুই পেলাম না।
সে রাতে আর ঘুম হলো না।একটা ট্যাবলেট খেলাম যাতে ব্যথা কমে।
ব্যথা কমতে কমতে দুপুরের পরে গিয়ে কমলো।সেদিন সকালের দিকে টিভিতে একটা নিউজ দেখলাম যেখানে পার্কের মালিকের ম্যানেজারে এমন মৃত্যুর জন্য তার কাছে রিপোর্ট করার জন্য সাংবাদিকরা গিয়েছে।তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, সেই জায়গাটাতে একটা সাইনবোর্ড দেখলাম।শোমসপুর,খোকসা।
তারমানে তিনি খোকসাতেই থাকেন।হয়তোবা ওখানে গেলে তাকে পাওয়া যাবে।
বিকেলের শেষ দিকে শোমসপুর বাজারে চলে গেলাম।টিভিতে তার নাম দেখেছিলাম।সেই নাম বলতেই একজন তার বাড়ি দেখিয়ে দিল।
দারোয়ানের সাথে কথা বলে সেই বাড়িতে ঢুকলাম।সুনসান বাড়ি,তিনি সোফায় বসে নিউজপেপারে চোখ বুলাচ্ছে।আমাকে দেখে বললেন,
-কে আপনি?কিছু দরকার?
-হ্যাঁ, দরকার।সোজা ভাবেই আপনাকে বলছি।
দোলনায় বসার কারণে মানুষের মৃত্যু হয়,তবু সেই দোলনা আপনি কেন পার্ক থেকে সরান নি?
-আপনাকে আমি জবাব দিতে বাধ্য নই।
-আপনি বাধ্য।এর সাথে মানুষের জীবন -মৃত্যু জড়িত!
-সেটা আমার দেখার বিষয় না।
-প্লিজ বলেন,আমি আপনার কাছে হাতজোড় করছি।ভুল করে দোলনাতে বসে আজ আমি যতরকমের সমস্যা আছে, সবকিছুর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
-সেটা আপনার বিষয়!
প্রচন্ড রকমের রাগ উঠে গেলো।পাশে থাকা টব টা তার মাথার সোজা ধরে বললাম,
-আপনি বলবেন কি না?
-বলছি,বলছি।
আসলে আমি জানতাম এই দোলনায় বসলে মানুষের মৃত্যু হয়।তবুও রেখেছিলাম কারণ এটা রুপার তৈরি হওয়ার অনেক দূর থেকেও মানুষ দেখতে আসতো।
কিন্তু আমি তো সাইনবোর্ড দিয়ে রেখেছিলাম না বসার অনুরোধ করে।
-কিন্তু সেটা একটা অফ সাইডে।যেখানে কারো নজর যায় না।
আমি আজ দোলনাটা ধবংস করে দিবো।পারলে ঠেকায়েন।
তাকে আর বেশিকিছু বললাম, লোকটা যে মারাত্মক লোভী। সেটা তার কথাতেই বুঝতে পারলাম।এদের শাস্তি এরা নিজেরাই পাবে।
শাকিলকে ফোন করে পার্কে ডেকে আনলাম। সাথে এক বোতল কেরোসিন তেল।ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।চারিদিকে অন্ধকার অন্ধকার ভাব।পার্কে ঢুকে দোলনাটার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিলাম।
ম্যাচে ঠুকা দিয়ে আগুন ধরালেই সেই আগুন সাথে সাথে নিভে যেতে থাকলো।বারবার এমন হওয়ায় আমি আল্লাহর নাম নিয়ে আগুন ধরিয়ে সেটাকে দোলনায় নিক্ষেপ করলাম।ভালোমতো যাতে আগুন ধরে সেজন্য দোলনার উপরে কিছু কাগজ দিলাম।
একদিকে আগুন জ্বলছে,অন্যদিকে মনে হচ্ছে কেউ যেন পার্কটাকে উল্টাপাল্টা করে দিচ্ছে।আমরা দুজন সেদিকে খেয়াল না করে পার্ক থেকে বের হয়ে আসলাম।
মাথার যন্ত্রণা তখনো একটু একটু আছে।আমি শাকিলকে বাড়িতে চলে যেতে বললাম।রিতু বাড়িতে একা ভয় পাবে।
একা একা সেই বিক্রম ভিলার পথে রওনা দিলাম।একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে ছোট মা কে উদ্দেশ্য করে দু বার ডাক দিলাম।
-ছোট মা!ছোট মা!
*
-হ্যাঁ, রাশেদ!
আমি আছি।
-ছোট মা,আমার যেতে ভয় লাগছে।
-তুই ভয় পাস না!আমি আছি,তোর কিছু হবেনা।পথে অনেক কিছু তোর সামনে আসবে, ভয় পাবি না।নির্ভয়ে এগিয়ে যাবি।শুধু মনে রাখবি ওগুলো তোর চোখের ভুল।
মনে সাহস নিয়ে আমি হাঁটা দিলাম।সত্যি সত্যিই আমার সামনে বড় বড় সাপ এবং অদ্ভুত কিছু প্রাণী আসতে লাগলো।মনে হচ্ছিলো আমাকে খেয়ে ফেলবে।কিন্তু সেগুলো আমার কিছুই করতে পারছিলো না।
একটা সময় আমি বিক্রম ভিলাতে পৌঁছে গেলাম।আমি গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে মনে হলো তিনজন আমাকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে।কেমন যেন ভার ভার মনে হচ্ছিলো।
সেসময় কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেউ বলে উঠলো,
-দোলনা শেষ করেছিস তো কি হয়েছে!এখানে তুই কিছুই করতে পারবি না।
আমার মা বাবাও আমার সাথে আছে এখন।
ওর এই কথা শুনেই আমি আয়তুল কুরসী পড়ে নিজের বুকে ও চারপাশে ফুঁ দিয়ে নিলাম।এবার হালকা হালকা মনে হচ্ছে।
আমি সাথে থাকা লাইটার বের করে বিক্রম ভিলাতে আগুন লাগিয়ে দিলাম।সাথে সাথে দাউদাউ করে আগুন ধরে গেলো।চারিদিক পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো।তিনজনের আর্তনাদ স্পষ্ট আমার কানে ভেসে আসছিলো।এভাবে কিছুসময় চলার পরে আর্তনাদ থেমে গেল।
হয়তো তাদের জীবনচক্র ওখানেই আগুনের সাথে থেমে গেলো।
সেদিন বাড়িতে চলে আসলাম।সে রাতে কোনো সমস্যা হয় নি আর।ছোট মা শুধু একবার বলে গেলো,
নতুন জীবনে শুভকামনা।আমিও আসি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভিতে সংবাদ দেখতে গিয়ে দেখলাম,
ইভানা পার্কের মালিকের অদ্ভুতুড়ে মৃত্যু।কিভাবে মৃত্যু হয়েছে,কেউ জানেনা!
~সমাপ্ত~
© bnbooks.blogspot.com