.
টেবিলের উপরেই লিমা একটি সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছে এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো সে আত্মহত্যার জন্য আর কাউকে দায়ী করেনি বরং স্বয়ং আমাকেই দায়ী করেছে। পুলিশের এসআই সাহেব যখন আমার বাবাকে আলাদা নিয়ে লিমার সুইসাইড নোটের ব্যপারে সবকিছু খুলে বললেন তখন আমার বাবা স্বভাবতই লজ্জায় এবং কষ্টের তীব্রতায় নিজের মুখখানী আড়াল করবার চেষ্টা করলেন বোধহয়। এক কান দুকান করে যখন এই কথা আগত সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পরলো তখন আমি সকলের ঘৃণীত চাহুনী দেখে পূর্বের ন্যায় পাথররূপে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর পর আমার মনে হচ্ছিলো কাছে যদি সামান্য একটি চাকুও পেতাম তবে এই মুহূর্তেই নিজের গলায় চালিয়ে দিয়ে লিমার মতোই আত্মহুতির পথ বেছে নিতাম। কিন্তু আত্মহত্যাতো এক মহাপাপ আমি চাইলেইতো নিজের জীবনকে এতোটা সহজে কতল করতে পারিনা। আর আমিতো লিমাকে বোনের চোখে ব্যতীত অন্য কোনো দৃষ্টিতে কখনো কল্পনাও করিনি তবে কেনইবা ও আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে এভাবে ফাঁসালো?
.
এসআই সাহেবে যখন সামন্য এই সুইসাইড নোট পেয়েই আমাকে হাজতে নেওয়ার জন্য বাবার কাছে অনুমতি চাইলেন তখন আমার বাবা আমার প্রতি সামান্যতম মায়া না দেখিয়ে তাকে বলে উঠলেন,
-নিয়ে যান ওকে। এমন কুলাঙ্গার ছেলেকে আমার প্রয়োজন নেই।
বাবার এমন কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পরলো বোধহয়। কারণ যেইবাবা ছোটবেলা থেকে আজও অব্দি আমাকে মারাতো দূরে থাক সামান্য একটি গালি পর্যন্ত দেননি সেই বাবাই কিনা আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন? সত্যিই এর থেকে বেদনাদায়ক আর কিছুই হতে পারেনা। পুলিশ যখন আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে আমাকে ভ্যানে উঠাচ্ছিলো তখন আমার মা কেবলই অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার দিকে তাকিয়েই ছিলেন কিন্তু আমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সামান্য বাঁধাটুকুও দেননি। এতোটুকু বলেই ফাহিম দুইহাত দিয়ে নিজের মুখোমন্ডলটুকু আড়াল করে লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।
ডিটেকটিভ মারুফ ফাহিমের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলেন। তিনি আদৌ বুঝতে পারছেন না লিমাকে কে খুন করেছে। কারণ লিমার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছেন এটা অবশ্যই সাধারণ কোনো আত্মহত্যা নয় কারণ লিমার মৃত্যুর আগে কেউ তাকে চেতনানাশক কিছু খাইয়েছিলো। অতঃপর লিমার সাথে খারাপ কিছু করে এমনভাবে ওর লাশটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলো যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে যে ওকে আগেই হত্যা করা হয়েছে। আর তাছাড়া লিমা যেই সুইসাইড নোটটা লিখে গিয়েছিলো সেখানের লেখাগুলোর সাথেও ওর লেখার একদমই মিল পাননি তিনি। এতসব বিবেচনা করে তাঁর একমুহূর্ত বুঝতে বাকি নেই এটা কোনো আত্মহত্যা নয় বরং নিশ্চিত খুন। এর থেকেও বড় বড় রহস্য তিনি খুব সহজেই উদঘাটন করে ফেলেছেন কিন্তু লিমার খুনের ব্যপারে খুনী অজস্র ক্লু রেখে গেলেও কেইসটি যে তাঁর নিকট মোটামুটি কঠিনই হবে সেটা বুঝতে তাঁর একটুও বেগ পেতে হলোনা।
.
এদিকে রাইসার কানে যখন লিমার আত্মহত্যার কথাটি চলে যায় তখন তাঁর মনে হচ্ছিলো কেউ বোধহয় তাকে তাঁর পদতলের মাটি উন্মুক্ত করে অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ যেই মানুষটাকে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসে এসেছে সেই মানুষটাই নাকি তাকে ধোঁকা দেওয়ার পাশাপাশি অন্য একটি নিষ্পাপ মেয়ের জীবনটিও কেড়ে নিলো? রাইসার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না যে ফাহিম এধরণের একটি কাজ করতে পারে। তাঁরও মন বলছে যে এটা নিশ্চই অন্যকারো একটি চাল যে শত্রুতার বশে নয়তো অন্য কোনো কারণে ফাহিমকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ফাহিমের সাথে কেইবা এমন কাজ করতে পারে কার সাথেই বা ওর এতো শত্রুতা?
.
ডিটেকটিভ মারুফের এই কেইসের সাথে কোনোপ্রকার সম্পৃক্ততা নেই। কারণ এসব সাধারণ কেইসে তাঁর মতো একজন পিবিআই এর গোয়েন্দার সম্পৃক্ত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এসআই আতিকের অনুরোধে তিনি নিংস্বার্থভাবে এবং আনঅফিসিয়ালভাবে এই কেইসের দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। এসআই আতিক সম্পর্কে মারুফের কাজিন তাই সেও এই কেইস নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে আর দ্বিতীয়বার ভাবেনি।
এসআই আতিক তাকে আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিলো যে ফাহিমের মতো শিক্ষিত এবং মার্জিত ছেলের এই কাজ করা আদৌ সম্ভব নয় আর আতিক লিমার ঘরে সার্চ করার সময়েই বুঝতে পেরেছিলো লিমাকে কেউ খুন করেই ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছে। মি. মারুফ আতিকের থেকে সবকিছু শুনে এবং ফাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদের অন্তর বেড়িয়ে পরলেন কেইসের রহস্য উদঘাটনে।
.
ফাহিমের বাবা ডিটেকটিভ মারুফকে বেশ সাদরে গ্রহণ করেই ডাইনিং রুমে বসতে দিলেন। তাঁদের এমন আপ্যায়ণ দেখে সে অবাক হলোনা কারণ তাঁরা আগে থেকেই জানতো যে সে তাঁদের ছেলেকে মুক্ত করার জন্য এবং আসল সত্যটা উদঘাটন করার জন্যই এখানে এসেছে। মারুফ কিছুটা কৌতুহলী হয়ে ফাহিমের বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
-আচ্ছা আপনার কি মনে হয় আপনার ছেলে এমন কাজ করতে পারে?
ফাহিমের বাবা কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললেন,
-বিশ্বাস করুন ছোটবেলা থেকে আজো অবধি আমার ছেলের গায়ে একটি হাতও তুলতে হয়নি যে ও এতোটাই ভদ্র ছিলো। গ্রামের সব মানুষরা আমার ছেলেকে দিয়ে উদাহরণ দেয় তাঁদের ছেলেমেয়েদের যে কিভাবে ভদ্র হতে হয়। তাহলে আপনিই বলুন আমার ছেলে এরকম একটি কাজ কি করে করতে পারে? আর তাছাড়া লিমাকে আর ফাহিমকে আমরা কোলেপিঠে করেই মানুষ করেছি এমনকি ওরা ভাইবোনের উর্ধ্বে কখনোই ছিলোনা।
-আচ্ছা! আমি লিমার মায়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ফাহিমের বাবা একথা শুনে তাঁর একমাত্র ছোটবোনকে অনেকটা অর্ধমুমূর্ষু অবস্থাতেই তাঁর সামনে নিয়ে আসলেন। একমাত্র মেয়েকে হারানোর শোক যে কতটা তীব্র হতে পারে সেটা ডিটেকটিভ মারুফ লিমার মাকে দেখেই অবলোকন করতে পারছে। মারুফ লিমার মাকে বসতে বলে বাকি সবাইকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বললো। কারণ তাঁদের কথোপকথন এর মাঝে যদি অন্যকেউ এই ঘরে উপস্থিত থাকে তবে স্বভাবতই লিমার মা আত্মীয়তার কারণে হোক কিংবা অন্যকোনো কারণে হোক সব কথা তাঁর সামনে প্রকাশ করতে সাহস করবেনা। সবাই রুম ছেড়ে চলে যাওয়ার অন্তর মারুফ লিমার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-শুনেছি আপনার মেয়ে নাকি ফাহিমকে পছন্দ করতো এটার যৌক্তিকতা কতটুকু?
এমন কথা শুনে লিমার মা অকস্মাৎ মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে রইলেন।
-দেখুন, আত্মীয়তার কারণে কোনো কিছু এড়িয়ে যাবেন না। একটি কথা মনে রাখবেন আপনার মেয়ের থেকে আপনার ভাই কিংবা ভাইয়ের ছেলে কখনোই আপন নয়। আপনি চান নাহ যে আপনার মেয়ের সাথে যে খারাপ কিছু করেছে কিংবা তাঁর জীবন কেড়ে নিতে একটুও ভাবেনি তাঁর বিচার হোক?
এমন কথা শুনে লিমার মায়ের হুঁশ ফিরলো বোধহয়। তিনি কিছুটা ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলেন,
-হ্যাঁ, আমার মেয়ে ফাহিমকে পছন্দ করতো, শুধু আমার মেয়ে না বরং ফাহিমও ওকে পছন্দ করতো। আর এই বিষয়টা কেবল আমি নিজেই জানতাম কিন্তু অন্য কাউকে এইবিষয়ে কিছুই জানাইনি। কারণ আমার ভাই একজন অহংকারী মানুষ তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে এতোটাই গর্ববোধ করেন যে পুরো এলাকায় নিজের ছেলের গুণকীর্তন করে বেড়ান সবসময়। আর তাঁর এরকম সোনার হরিণ ওয়ালা ছেলে যে আমার মেয়েকে পছন্দ করে এটা জানতে পারলে তিনি আমার সাথে সম্পর্ক ছেদ করতেও দ্বিধা করবেন না তাই আমি ওদের বিষয়টি কাউকে জানাইনি। সেদিন সন্ধ্যায় আমার শাশুরীর শরীরটা অসুস্থ হওয়াতে আমার দেবরকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। সাথে লিমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফাহিম এসেছে বলে ও আমার সাথে যেতে রাজি হয়নি। আর ওর সেদিন রাজি না হওয়াটাই যে ওর জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে সেটা আমি মেয়েকে হারিয়ে এখন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।
এই বলেই তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন। অপরদিকে ডিটেকটিভ মারুফ কিছুটা অবাক হলেন বটে কারণ ফাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে বললো সে লিমাকে সবসময় বোনের নজরেই দেখে এসেছে এমনকি সে কখনো জানতোই না যে লিমা ওকে পছন্দ করে কিন্তু লিমার মাতো বলছেন ভিন্ন কথা। মারুফ আরো কিছুটা কৌতুহল নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-আচ্ছা একটি বিষয় আমার মাথায় খেলছেনা। সেদিন আপনি যখন শ্বশুর বাড়িতে গেলেন তখন আপনার মেয়েকেও নাকি আপনি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাইতো?
লিমার মা মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই মারুফ আবার বললো,
-তাহলে আপনি বলছেন ফাহিম এতোদিন পর গ্রামে এসেছে তাই লিমা আপনার সাথে যেতে চায়নি। তারমানে আপনি নিজেই ফাহিমের সাথে নিজের মেয়েকে অন্তরঙ্গ হবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন?
লিমার মা কিছুটা থতমত খেয়ে বললো,
-দেখুন স্যার আপনি যেটা বুঝাতে চাইছেন সেরকম কিছুই হয়নি ওদের মাঝে। এর আগেও ফাহিম বহুবার আমার ঘরে এসে লিমার রুমে একান্তে কথা বলেছে আর ফাহিম ঐধরণের ছেলে নয় যে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে লিমার সাথে খারাপ কিছু করবে। ওকে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই চিনি। আর আপনি নিজেই একবার ভাবুন, যদি ফাহিম এধরণের কোনো কাজ করেও থাকে তবে কেনইবা লিমার সুইসাইড নোটে নিজের নামটা লিখে নিজের পায়েই কুড়াল মারবে? আমি নিশ্চিত আমার ভাইয়ের ছেলে আমার মেয়ের সাথে এমন কোনো কাজ করতেই পারেনা।
-হুম তবে এতোটাও অন্ধবিশ্বাস ঠিক নয়। আপনি হয়তো জানেন না সেদিন রাতে ফাহিম লিমার সাথে দেখা করার জন্য আপনাদের ঘরে গিয়েছিলো এটা স্বয়ং ফাহিমই আমাকে বলেছে। আর আপনি যেই ছেলেকে নিজের ভবিষ্যত মেয়ের জামাই ভেবে এসেছিলেন তাঁর অন্যত্র একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কও রয়েছে। আজ আসি পরে আপনাকে প্রয়োজন হতে পারে।
এই বলেই ডিটেকটিভ মারুফ সোফা ছেড়ে উঠে গেলেন। ঘর থেকে বের হওয়ার মুহূর্তেই ফাহিমের বাবা অন্যরুম থেকে দৌড়ে এসে বললেন,
-স্যার আমার ছেলেকে একটু দ্রুত বের করার চেষ্টা করবেন। এটা সবাই জানে যে লিমার খুনের সাথে আমার ছেলের বিন্দুমাত্র কোনো হাত নেই।
-সেটা সময়ই বলে দিবে। নিজের ছেলেকে নিয়ে একটু অহংকার করা কমিয়ে আনবেন কারণ যতটুকু বুঝতে পারছি এই খুনের দায়ভার আপনার ছেলের দিকেই বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে।
এই বলেই প্রস্থান করলো মারুফ। অপরদিকে লিমার মা ফাহিমের সম্বন্ধে এমন কথা শুনে মুহূর্তেই হেঁচকি তুলে কান্না শুরু করে দিলেন। যখন মারুফ তাকে বলেছিলো ফাহিমের অন্যত্র সম্পর্ক রয়েছে তখন থেকেই তাঁর মেয়েকে হারানোর কষ্টটা একটু তীক্ষ্মভাবেই তাঁর বুকে আঘাত করছিলো।
.
ডিটেকটিভ মারুফ সাইবার ইউনিটের সহযোগীতায় কিছুটা কাঠখড় পুড়িয়েই ফাহিমের ফেইসবুক আইডিটা সংগ্রহ করলেন। ফাহিমের আইডিতে প্রবেশ করার পর একটি অবাক করা বিষয় তিনি খেয়াল করলেন আর তা হলো ফাহিমের সাথে রাইসার ম্যাসেন্জারে কোন ম্যাসেজ হিস্টোরিই অবশিষ্ট নেই। এটা দেখে সে যখন এ্যাকটিভিটি চেক করতে যায় তখন সেখানে সে দেখতে পায় ফাহিম রাইসাকে সেদিন বিকালেই ব্লক করে দিয়েছে যেদিন রাতে লিমা খুন হয়। এসব ঘটনা দেখে মারুফের সন্দেহের তীরটা অন্যদিকে ঘুরতে থাকে তাই সে একমুহূর্ত দেরী না করে পুনরায় সাইবার ইউনিটের সহযোগীতা নিয়ে রাইসার আইডিতে অনুসন্ধান চালায়। কিন্তু রাইসার আইডিতে প্রবেশ করার পর ফাহিমের সাথে রাইসার ম্যাসেন্জারে কথোপকথন দেখে মুহূর্তেই মারুফের চোখ দুটো বেশ বড় হয়ে যায়। তারমানে সে এই দুদিনে যা ভেবে এসেছে ঘটনাটি কি তার সম্পূর্ণ উল্টো? প্রশ্নটা থেকেই যায়...
.
.
ডিটেকটিভ মারুফ রাইসার সাথে ফাহিমের ম্যাসেন্জারে কথোপকথন দেখে মুহূর্তেই তাঁর চোখদুটো বেশ বড় হয়ে যায়। তারমানে সে এই দুইদিনে যা ভেবে এসেছে তাহলে ঘটনা কি তার সম্পূর্ণ উল্টো?
.
ফাহিম অনেকটা নতমস্তিষ্কেই লোহার শিকে ঘেরা এই অন্ধকার রুমে মারুফের মুখোমুখি বসে আছে। ফাহিমের মাথার ঠিক উপরেই একটি হলুদ ভ্যাকুয়াম টিউব সংবলিত বাল্ব দোলকের মতোই হালকাভাবে দুলছে। একজন গোয়েন্দা হয়ে হাজতের মধ্যে যদিও কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা আইনগতভাবে বৈধ নয় তবে সে যেহেতু এই কেইসের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েই ফেলেছে তাই লিমা হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন না করে সে ক্ষান্ত হবেনা এটাই এখন তাঁর একমাত্র প্রতিজ্ঞা।
ফাহিমকে চেতনায় ফেরানোর জন্য ডিটেকটিভ মারুফ কিছুটা কঠিন স্বরেই জিজ্ঞেস করলো,
-তুমি আমাকে এতোগুলো মিথ্যা কথা কেনো বলেছো?
ফাহিম যেভাবে তাঁর কথা শুনে চুপ করে রইলো তাতে বোধহয় কথাগুলো ফাহিমের কান অবধি বিন্দুমাত্র পৌঁছায়নি। ফাহিমের এমন নীরবতা দেখে এবার সে কিছুটা ধমকের স্বরেই বলে উঠলো,
-কি হলো? জবাব দাও!
ধমকের প্রকোপে ফাহিম কিছুটা নড়েচড়ে বসেই ইতোস্তত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-বিশ্বাস করুন স্যার! আসলে লিমার এভাবে আকস্মিক মৃত্যুতে আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তার উপরে আবার লিমার সুইসাইড নোটে আমার নিজেরই নাম লেখা রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আমি এতোটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে আমার মনে হচ্ছিলো সত্য কথাটা বললে আমি ফেঁসে যেতে পারি। কিন্তু বিশ্বাস করুন লিমার খুনের সাথে আমার বিন্দু পরিমাণও সম্পৃক্ততা নেই। সেদিন রাতে আমি লিমার সাথে রাইসার বিষয়ে কথা বলেই চলে এসেছিলাম এর বেশিকিছু ঘটেনি আর।
-সত্য কথা বললে তুমি ফেঁসে যাবে এমনটা কেন মনে হয়েছিলো তোমার?
-জানিনা স্যার তবে খুব ভয় পেয়েছিলাম।
-আচ্ছা একটি প্রশ্নের উত্তর দাও আমাকে, তুমি রাইসার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেও কেনইবা লিমার দিকে ঝুঁকে পরেছিলে? আর ম্যাসেন্জারে সেদিনের রাইসার সাথে তোমার কথোপকথন দেখেতো আমার সন্দেহের তীরটা তোমার আর রাইসার দিকেই ঘুরে যাচ্ছে।
-জানি স্যার সেটা। আসলে বিগত কয়েকমাস যাবৎ রাইসার সাথে আমার সম্পর্কটা একদমই ভালো যাচ্ছিলোনা। ওর ধারণা আমি শহরে বসে অজস্র মেয়েদের সাথে প্রেম করি। এরকম টুকটাক কারণে আমাদের প্রায়শই ঝগড়া হতো তাই আমি চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবার গ্রামে আসলে রাইসার সাথে একটা কিছু করেই ফেলবো মানে ব্রেকআপ। কিন্তু গ্রামে আসার পরও ওর সন্দেহ একটুও কমেনি বরং আরো একটু বেড়েছিলো বটে। কারণ রাইসা বহুদিন আগে থেকেই জানতো যে লিমা আমাকে পছন্দ করে। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামে আসার পর থেকে প্রতিনিয়তই আমাকে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলতো, "এখনতো আমাকে আর ভালো লাগেনা সারাদিন বোধহয় লিমার সাথেই কাঁটিয়ে দাও তাইনাহ?" কিন্তু ওর এসব সন্দেহ আমার মনে প্রতি ক্ষণে ক্ষণেই এক তীব্র কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছিলো তাই বাড়িতে এসেই আর অপেক্ষা না করে আমি রাইসার সাথে সবকিছুতে সমাপ্তি টানার জন্য দেখা করতে যাই। তবে আমার জানা ছিলোনা যে আমরা যেখানে দেখা করতে যাই সেদিকেই লিমা ওর কলেজ শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তো। লিমা আমাদের দেখে ফেলায় বাবাকে এসব ঘটনা বলে দেওয়ার জন্য আমি যতটা ভয় পাচ্ছিলাম তার থেকেও বেশি ভয় পাচ্ছিলাম ওর নিজের জন্যই। কারণ লিমা প্রচন্ড আবেগী মেয়ে ছিলো তাই আমাকে অন্য মেয়ের সাথে দেখে ফেলায় ও যেকোনো কিছুই করে ফেলতে পারে। ফলস্বরূপ এসব ভয়কে মনের মধ্যে পুঁজি করে সেই সময়টিতেই আমি রাইসাকে ছেড়ে লিমার পিছুপিছু বাড়িতে চলে এসেছিলাম। কিন্তু রাইসা এই বিষয়টি একদমই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি তাই সে সেদিন আমাকে ম্যাসেন্জারে অজস্র গালিগালাজ এবং হুমকি ধামকি দিয়েছিলো যে আমি যদি ওকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে না করি তবে ও যেকোনো মুহূর্তেই কোনো না কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। কিন্তু রাইসার এমন খারাপ ব্যবহারের দরুন আমার মনেও বেশ জেদ চেপে বসেছিলো তাই আমি আর ওর কথায় তেমন তোয়াক্কা না করে সবদিক দিয়ে ওকে ব্লক দিয়ে দেই।
এই বলেই ফাহিম হাঁফ ছাড়লো। অপরদিকে ডিটেক্টিভ মারুফ একমনে ফাহিমের কথা বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনছিলো। সাধারণ এই কেইসটি যে আজ তাকে এরকম গাঁধার ন্যায় খাঁটাবে তা যেন তাঁর ভাবনাতেই ছিলোনা।
.
মারুফের এই কেইসে যেহেতু তেমন কোনো চাপ নেই তাই সে কিছুটা ধীরে সুস্থেই সামনে এগোনোর চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে সে বসে আছে রাইসাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদীর তীর ঘেঁসে। নদীর কলকলে প্রতিধ্বনি সে বেশ ভালোই উপভোগ করছে, বহুদিন পর গ্রামের এই মনোরম আবহাওয়ার মাঝে নিজেকে সপে দিতে পেরে তাঁর মনের মধ্যে যেন অন্যরকম এক প্রশান্তি উঁকি দিচ্ছে। আস্তে করে পকেট থেকে মোবাইলটি বের করেই সে রাইসার নাম্বারে কল দিলো। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর অপর পাশ থেকে এক কিশোরী কোমল কন্ঠে বলে উঠলো,
-হ্যালো কে বলছেন?
-আমি একজন অনুসন্ধানকারী। তুমি নিশ্চই লিমার খুনের ব্যপারে জেনে থাকবে আর আমি ওর খুনের ব্যপারেই তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
অপরপাশ থেকে মেয়েটি এসব কথা শুনে কিছুটা সময় থেমে পরক্ষণেই বলে উঠলো,
-আপনি হয়তো ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছেন। আমি লিমা নামের কাউকে চিনি না।
রাইসার এমন কথায় মারুফের বেশ রাগ হলো বটে তবুও নিজের রাগকে যথেষ্ট প্রশমিত করে কিছুটা কঠোর স্বরেই বললো,
-শোনো মেয়ে, আমি তোমার বাল্যকালের বন্ধু নই যে আমার সাথে তুমি মজা করবে কিংবা মিথ্যা বলবে। আমি একজন পিবিআই এর কর্মকর্তা। তোমার ভালোর জন্যই আমি কল দিয়েছি, আমি চাইলেই এখন তোমার বাড়িতে যেয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি কিন্তু এতে তোমারই ক্ষতি। তাই যা বলছি মন দিয়ে শোনো, আমি এখন তোমাদের গ্রামের সাথে থাকা নদীর পাশে অপেক্ষা করছি। পাঁচমিনিটের মধ্যে যদি না আসো তাহলে কি ধরণের অঘটন ঘটে যাবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা।
এই বলেই মারুফ কলটি কেঁটে দিলো। একটি মজার বিষয় হলো ডিটেকটিভ মারুফ সেই প্রথম দিনেই জেনে ফেলেছে লিমার খুনের সাথে কে জড়িত কিন্তু তাঁর এই সময় ক্ষেপণেরও অন্য একটি কারণ রয়েছে। সেটা নাহয় পরেই জানা যাবে।
.
রাইসা একটি দশবছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে এগিয়ে আসছে কিন্তু মারুফ দূর থেকেই অবলোকন করতে পারছে যে রাইসাকে লিমার খুনের ব্যপারে তলব করার কারণে সে মুখোমন্ডলে বেশ ভয়ের আভা নিয়েই এগোচ্ছে। মারুফ দূর থেকে রাইসার এমন ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতে দেখে সে ভাবছে,
-ওর ভয় পাওয়ার কি কি কারণ থাকতে পারে? প্রথমত ম্যাসেন্জারের বিষয়টি আর দ্বিতীয়ত ওর পরিবার যদি জানতে পারে লিমা হত্যাকান্ডে ওর ও কিছুটা যোগসূত্র রয়েছে তবে আর রক্ষে নেই।
এসব ভাবনার মাঝেই রাইসা মারুফের সামনে এসে কিছুটা ভয়ার্ত গলাতেই বলে উঠলো,
-বিশ্বাস করুন স্যার! লিমার মৃত্যুর সাথে আমার কোনো হাত নেই আমি কেবল ফাহিমকেই ভালোবাসতাম। লিমা যে এভাবে আত্মহত্যা করবে তা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।
-লিমাতো আত্মহত্যা করেনি বরং ওকে খুন করা হয়েছে আর ওর খুনের পিছনে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমারই হাত রয়েছে।
এমন কথা শুনে এবার রাইসা ওর সাথে আনা ছেলেটিকে অনেকটা ভয়ের রেশ ধরেই শক্ত করে আকড়ে ধরলো। ছেলেটি কিছুটা ব্যাথা পেয়েই বললো,
-আপু ব্যাথা পাচ্ছিতো। ছাড়ো আমাকে।
রাইসা ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়ার পরক্ষণেই ও হু হু করে কেঁদে দিলো। ওর এভাবে কান্না দেখে মারুফ বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কি হলো কাঁদছো কেন?
-বিশ্বাস করুন স্যার, আমি লিমার খুনের ব্যপারে কিছুই জানিনা। আমি শুধু ফাহিমকে ভালোইবাসতাম এর বেশি কিছু না। ইদানিং ফ্যামিলি থেকে আমাকে বিয়ের জন্য প্রচন্ড রকমের চাপ দিচ্ছে। বাবা মায়ের মুখ থেকে উঠতে বসতে সবসময় বিয়ের কথা শুনতে শুনতে আমার মাথা অলটাইম গরম থাকতো। তাছাড়া আমি ফাহিমকে ছাড়া অন্যকিছু কল্পনাও করতে পারতাম না এমনকি ওর সাথে কোনো মেয়েকে দেখলে আমার একদমই সহ্য হতোনা। আমি সবসময়েই ওকে বিয়ের কথা বলতাম কিন্তু ও বরাবরই সেটা এড়িয়ে গিয়ে বলতো পড়ালেখা শেষ না করে ও বিয়ে করতে পারবেনা। লিমার মৃত্যুর দিন বিকালে ওর সাথে আমার ঝগড়া হয় আর আমিও কিছুটা রাগের বশেই বলেছিলাম যে আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে না করলে আমি ওকে দেখে নিবো। কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার! লিমার সাথে আমার বিন্দুমাত্রও শত্রুতা ছিলোনা যদিও আমি জানতাম লিমা ফাহিমকে পছন্দ করতো। আসলে কি বলবো! সমবয়সী একটি ছেলেকে মন দিয়ে যে কত বড় ভুল করেছি সেটা এখন হারে হারেই টের পাচ্ছি। সারাটাজীবন ফাহিমকে না পাওয়ার অতৃপ্ততাতেই কেঁটে যাবে বোধহয় এই মন।
রাইসা কাঁদছে কিন্তু মারুফ ওর এতোগুলো কথার প্রতিউত্তরে কিছুই বলছে না। রাইসার কথাগুলো শুনে হঠাৎই তাঁর মনে পরলো সেই কলেজ জীবনের একমাত্র ভালোবাসা মিমির কথা। মেয়েটিও তাকে খুব ভালোবাসতো এমনকি মারুফের মনে যে তাঁর জন্য ভালোবাসার বীজ বপণ হয়নি তাও কিন্তু না। তবুও এই সমবয়সের অজুহাত দিয়ে সেই মেয়েটিও একটা সময় তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো।
মারুফ ভাবছে যা হওয়ার হয়েছে এখন আর একমুহূর্ত আলসেমী করা যাবেনা, কালকের মধ্যেই আসল খুনীকে জেলে ভরে ফাহিমকে বের করতে হবে। রাইসাকে বিদায় দেওয়ার সময় মারুফ বলে উঠলো,
-তুমি ফাহিমকে কতটা ভালোবাসো? ও যদি জেল থেকে মুক্তি পায় তবে কি তুমি ওকে সাদরে গ্রহণ করবে?
রাইসা কিছুটা শান্ত স্বরে বলে ওঠে,
-যাকে একবার মন দিয়েছি সে যদি অজস্র খারাপ কাজও করে তবুও আমি তাকেই ভালোবাসবো। তবে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে ফাহিম যদি আমাকে আগামী কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে না করে তবে নিজের হাজারো অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে অন্য পুরুষের ঘরে যেতে হবে।
মারুফ মুচকি হেসে বলে ওঠে,
-চিন্তা করোনা ফাহিম তোমাকে অচিরেই বিয়ে করবে তুমি এখন যেতে পারো।
রাইসা জানে না যে ফাহিম তাকে বিয়ে করবে কিনা তবে সে এই অচেনা গোয়েন্দার আশ্বাসেও একটুখানি মনের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করে।
.
ডিটেক্টিভ মারুফ সকল সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এসআই আতিক কে ফোন করে জানায়,
-আতিক ভাই, খুনীকে চিহ্নিত করা শেষ। আপনি আজ রাতেই ওকে ধরে ফেলতে পারবেন।
-কি বলিস ভাই! এতো তাড়াতাড়ি ধরে ফেললি? কিভাবে সম্ভব?
-ভাই পিবিআই গোয়েন্দারা আপনাদের মতো সাধারণ পুলিশদের ন্যায় খেয়ে খেয়ে পেট বড় করেনা কিংবা মাথায় গোবর নিয়ে চলাফেরা করেনা বুঝছেন?
-তা যা বলেছিস! আচ্ছা খুনীটা কে সেটা আগে বল!
-এতো কিছু আগে বললে সমস্যা আছে। সময়মতোই দেখতে পাবেন। আজ রাতেই আমি আপনাকে জায়গার নাম বলে দিবো আপনি ফোর্স নিয়ে রেডি থাকবেন।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
.
ডিটেক্টিভ মারুফ কলটি রেখে দিয়েই কাঙ্ক্ষিত স্থানের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলেন। প্রায় সন্ধ্যা অবধি জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে থাকার অন্তর ছেলেগুলোকে দেখে সে নিজেকে আড়াল করে নিলো। গ্রামের এসব ব্রিটিশ আমলের বাংলোগুলোই ওদের মতো ছেলেদের এক উত্তম নেশাঘর। ছেলেগুলো নেশা করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার মুহূর্তেই আসল খুনীটি ওর সহচারীদের উদ্দেশ্যে কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই বলে উঠলো,
-বুঝলি! লিমা মালটা জোস আছিলো। ওরে না মাইরা যদি কিডন্যাপ কইরা নিয়া আইতাম তাইলে কয়েকদিন ভালোই মজমাস্তি হইতো আর তোরাও একটু ভাগে পাইতি। কিন্তু ইদানিং পুলিশগুলা যা করতেছে তাতে আর কি কমু! শালারা ক্যামনে ক্যামনে জানি ধইরা ফালায়। তাই বুদ্ধি কইরা ফাহিম্মারেই ফাঁসাইয়া দিলাম। ওর বাপের এখন দেমাক ছুইট্টা গেছে।
এই বলেই ছেলেটির সাথে বাকি ছেলেগুলোও অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। তৎমুহূর্তেই ডিটেক্টিভ মারুফ এসআই আতিক কে ফোন দিয়েই বললো,
-ভাইয়া, তাড়াতাড়ি চলে আসেন। ওরা এখন এখানেই জমজমাট আড্ডা দিচ্ছে।
এসআই আতিক এমন কথা শুনে আর একমুহূর্ত দেরী না কাঙ্ক্ষিত স্থানের উদ্দেশ্যে একটি ফোর্সসহ রওয়ানা দিলেন। তিনি এখনো জানেন না যে আসল খুনী কে? তবে কি তাঁর ভাবনায় যার নাম ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেই কি আসল খুনী? প্রশ্নটা থেকেই যায়...
.
এসআই আতিক ডিটেক্টিভ মারুফের কথা শুনে অজস্র কৌতুহল নিয়ে আর একমুহূর্ত দেরী না করে কাঙ্ক্ষিত স্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। তিনি এখনো জানেন না লিমার আসল খুনী কে? তবে কি তাঁর ভাবনাতে যার নাম ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেই কি তাহলে আসল খুনী?
.
ডিটেক্টিভ মারুফ অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন এসআই আতিকের জন্য। ছেলেগুলো এখনো সেই পূর্বের ন্যায় টাস খেলায় ব্যস্ত। তাঁদের মধ্য থেকে একজন টাস খেলার পাশাপাশি দুই টাকার কয়েকটি নোট ভাঁজ করে তার মধ্যে কিছু একটা ভরার চেষ্টা করছে। দূর থেকে মারুফের নিকট মনে হচ্ছে ওটা গাঁজা কিংবা ইয়াবা জাতীয় কিছু হবে হয়তো। প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর হঠাৎই মারুফের ফোনটি ভাইব্রেট করে উঠলো। পকেট থেকে ফোনটি বের করার সাথে সাথেই সে দেখতে পায় এসআই আতিকের কল। কলটি রিসিভ করার পরক্ষণেই ওপাশ থেকে আতিক বলে উঠলো,
-হ্যাঁ আমি ফোর্সসহ বাংলোর ডানদিকের রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। তুই কোথায়?
-আপনি ওখানেই দাঁড়ান আমি এক্ষণি আসছি।
মারুফ অনেকটা ধীরে সুস্থে এবং সাবধানতার সহিত বাংলোর ডানদিকের রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলো। দূর থেকে সে স্পষ্টতই এস আই আতিক ও আরো দশ বারো জন সিভিল ড্রেস পরিহিত লোককে দেখতে পেলো। এদের সকলকে পুলিশের ড্রেস ছেড়ে সিভিল ড্রেস পরিধান করবার কোনো উত্তর সে খুঁজে পেলো না। কারণ রহস্যের সমাধান কিংবা আসল খুনীকে চিহ্নিত করা তো আগেই হয়ে গিয়েছে এখন এদের কাজ হলো কেবলই খুনীকে আটক করা। গোয়েন্দাগিরির ক্ষেত্রে ওসব ড্রেস পরলেও একটি কথা ছিলো তবুও সেসবে মারুফ আর তেমন পাত্তা না দিয়ে ঝোপঝাড় সংবলিত রাস্তা পেড়িয়েই এসআই আতিকের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। আতিকের চোখেমুখে এখন সারা দেশের এক অপূর্ব কৌতুহল এবং উত্তেজনা বিরাজ করছে সেটা মারুফ তাঁর মুখোমন্ডল দর্শনেই অবলোকন করতে পারছে।
-কোথায় ওরা? কিভাবে কি করবো তাড়াতাড়ি খুলে বল।
-আস্তে ভাই! বেশি তাড়াহুড়ো করলে জালের ফাঁক দিয়ে কিন্তু মাছ বের হয়ে যেতে পারে। এখন আমি যেভাবে যেভাবে বলবো সেভাবেই কাজ করবেন। ঠিক আছে?
মারুফের কথায় আতিক মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই সে এক এক করে এসআই আতিক সহ ফোর্সের সকলকে কিভাবে কি করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলো। সকলে অনেকটা বাধ্যগত ছাত্রের মতোই ডিটেক্টিভ মারুফের উপদেশ বেশ দৃঢ়তার সাথেই নিজেদের মাথায় গুঁজে নিচ্ছিলো।
রফিক তাঁদের এই নেশার আড্ডাঘরে আকস্মিক পুলিশের আগমন দেখে সে সহ তাঁর সহচারীরা পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেও সফল হলোনা। কারণ তাঁদের পালানোর আগেই চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা পুলিশ ফোর্সের সদস্যগণ তাঁদেরকে জাপটে ধরে সাথে সাথেই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়েছে। রফিক বেশ ভয়ার্ত গলায় বললো,
-স্যার ছাইড়া দেন! এই কান ধরছি আর কখনোই নেশা করমুনা।
এসআই আতিক মুখের কোণে কিছুটা রহস্যমাখা হাসির রেশ টেনে বলে উঠলেন,
-তোকেতো আর এর জন্য গ্রেফতার করছিনারে হারামজাদা। তোকে কালকে ফাঁসিতে ঝুলাবো তাই তোকে ধরতে এলাম।
পুলিশের মুখে এমন কথা শুনে রফিকের চোখেমুখে এক অপূর্ব বিস্ময় এবং অজস্র ভয় উঁকি দিচ্ছে। সে মনে মনে বলছে,
-তারমানে কি তাঁরা আমাকে ঐ কারণেই ধরতে এসেছে?
অতঃপর রফিক ও তাঁর সহচারীদের নিয়ে অনেকটা জোরপূর্বকভাবেই থানার দিকে রওয়ানা দিলেন ফোর্সের সদস্যগণ।
.
ফাহিমের বাড়িতে যখন খবর পৌঁছালো যে লিমার আসল খুনীকে পুলিশ আটক করেছে তখন সবাই অনেকটা নাওয়া খাওয়া ভুলেই থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। এমনকি ফাহিমের বাবা এই খবর শোনামাত্র তিনি লুঙ্গী ছেড়ে প্যান্ট পরতেও ভুলে গিয়েছেন তাই লুঙ্গী পরেই থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। সবার এখন একটাই কৌতুহল যে লিমার খুনী কে?
.
থানায় সকলে উপস্থিত হওয়া মাত্র এসআই আতিকের মুখোমুখি হয়েই তাঁরা আসল খুনীকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পরলো। আতিক সকলকে শান্ত করে বলে উঠলেন,
-এতো উদগ্রীব হওয়ার কিছু নেই। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত যে আপনারা আসল খুনীকে দেখে প্রচন্ড অবাক হবেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাঁর এমন কথা শুনে আগত সবার মধ্যে কৌতুহলের তীব্রতা বোধহয় আরো একটু বাড়লো। পরক্ষণেই তিনি পাশে থাকা এক হাবিলদারকে বলে উঠলেন,
-যান, ওকে নিয়ে আসুন।
হাবিলদার তাঁর সিনিয়র অফিসারের কথা শোনামাত্রই আর একমুহূর্ত দেরী করলো না রফিককে নিয়ে আসতে।
যখন রফিককে সবার সামনে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে আশা হলো তখন সবাই যেন অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলেন। তাঁরা কেউই নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। লিমন তাঁর একমাত্র সহোদর ভাইকে যে এই জায়গাতে দেখবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। ফাহিমের বাবা অনেকটা অবিশ্বাসের স্বরেই বললেন,
-স্যার! আপনি হয়তো ভুল করছেন। রফিক এধরণের ছেলেই নয় যে ও এমন একটি কাজ করতে পারে। আমি ওকে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি আর তাছাড়া আমার ছেলের পরে যদি আমি কোনো ভালো ছেলের নাম নেই তবে সেটা অবশ্যই রফিকই হবে।
এসআই আতিক তাঁদের এমন কথার প্রতিউত্তরে বলে উঠলেন,
-আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। তবে ভালো মুখোশের আড়ালে কিছু কিছু মানুষ যে খারাপের দৃষ্টান্ত বয়ে বেড়ায় সেটা আপনার ভাইয়ের ছেলেকে না দেখলে কোনোদিনই বিশ্বাস করতাম না।
এই কথার পরক্ষণেই আতিক এর চোখ গেলো দরজার দিকে। তাকে দেখাদেখি উপস্থিত থাকা সকলেই দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়ে জানার চেষ্টা করলো কে এসেছে? সকলে ডিটেক্টিভ মারুফকে দেখে তাকে সামনে আসার জন্য পথ করে দিতেই এস আই আতিক তাঁর হাবিলদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-মারুফকে একটি চেয়ার এগিয়ে দিন বসার জন্য।
পরক্ষণেই তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
-আজ যদি আমার এই ছোট ভাইটি এই কেইসের দায়িত্ব না নিতো তবে মনে হয়না আমরা আসল খুনীকে ধরতে পারতাম। আর রফিকের বিষয়টা যদি বলতে হয় তবে বলবো সে এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করেছিলো যেটা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের অন্তর বুঝতে পারলাম।
সকলে এখনো কৌতুহল দৃষ্টিতে আসল ঘটনা জানার জন্য এসআই আতিকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পরমুহূর্তেই তিনি ফাহিমের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-রফিকও কিন্তু আপনার ছেলের থেকে কম মেধাবী ছিলোনা কিন্তু আপনার ভাই ওদেরকে ছোট রেখেই পরকালে পাড়ি জমানোর কারণে সে তাঁর স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েছিলো। সে আমাকে যতটুকু জানালো যে ফাহিমের মতো তাঁরও শহরে গিয়ে পড়ালেখার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু আপনাদের সহযোগীতা না পাওয়াতে এবং অর্থবিত্তের অভাবে রফিক মাঝপথেই পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তার উপরে আবার আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে এলাকায় যেভাবে গুণকীর্তন করতেন সেটা তাঁর মনে এক প্রবল হিংসার জন্ম দিয়েছিলো। অপরদিকে লিমার বিষয়টি যদি বলতে হয় রফিক নাকি লিমাকে পছন্দ করতো এবং কয়েকদিন প্রেম প্রস্তাবও নাকি ওকে দিয়েছিলো। কিন্তু লিমা বরাবরই রফিককে প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি তাকে অপমান করতেও ভুলেনি। লিমা যেদিন খুন হয় তার আগের দিনই রফিক আরো একবার লিমাকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছিলো। কিন্তু সেদিন লিমা রফিককে বেশ অপমান করেই বলেছিলো যে তাঁর মতো এমন অশিক্ষিত ছেলেকে সে কখনোই বিয়ে করবে না আর প্রেম করারতো প্রশ্নই ওঠেনা। পাশাপাশি লিমা তাকে এটাও বলেছিলো যে ফাহিমকে নাকি সে পছন্দ করে পাশাপাশি ফাহিমও তাকে পছন্দ করে। ফাহিমের কাছাকাছি যদি সামান্যতম যোগ্যতাও তাঁর থাকতো তবে সে ভেবে দেখতো। সেদিন রফিক লিমার মুখে এমন অপমানজনক কথা শুনে এক নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সে চেয়েছিলো লিমার সাথে খারাপ কিছু করে এমনভাবে ওকে খুন করতে যাতে সবাই ভাবে ও আত্মহত্যা করেছে এবং লিমার সুইসাইড নোটে ফাহিমের নাম লিখে ফাহিমকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আপনার ছেলেকে নিয়ে আপনার দাম্ভিকতাকে চূর্ণ করে দিতে। সেদিন যখন রফিক লিমাকে একলা ঘরে পেয়ে ওর প্ল্যানমাফিক লিমাদের ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই সে খেয়াল করে ফাহিম লিমার ঘরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ফাহিম যদিও ঝোপের আড়ালে থাকা লোকটিকে তখন দেখতে পারেনি তবে সে যে স্বয়ং তাঁর চাচাতো ভাই ছিলো সেটা ফাহিম জানতো না। রফিকের হয়তো তখন মনে হচ্ছিলো মেঘ না চাইতেই সে বৃষ্টি পেয়ে গেছে। কারণ তখন ফাহিমের লিমার ঘরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ফাহিমকে ফাঁসানোর প্ল্যানটি আরো দৃঢ় হয়ে যায়। তারমধ্যে ফাহিম লিমার ঘরে প্রবেশ করার ঠিক আগমুহূর্তেই ওর লিমনের সাথে দেখা হয়। সবকিছু বিবেচনা করে সে এক উত্তম সুযোগই পেয়ে গিয়েছিলো। আর তাছাড়া লিমার সাথে সে খারাপ কিছু করার পর এমনভাবে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিলো যাতে পুলিশরা ওর ডিএনএ স্যাম্পলও সংগ্রহ করতে না পারে। তবে দুঃখের বিষয় এটাই যে সে অজস্র বুদ্ধি খাঁটালেও আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
এই বলেই ক্ষান্ত হলেন এসআই আতিক। তাঁর সকল রহস্য উন্মোচন সম্পর্কিত কথা শুনে এবং রফিকের এমন কর্মকান্ডের কথা শ্রবণ করে রফিকের মা নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। বরং হু হু করে কেঁদে উঠেই মেঝেতে বসে পরলেন কিন্তু তাঁর একমাত্র ছোট ছেলে ব্যতীত তাকে আর কেউ সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলোনা। ফাহিমের বাবাসহ উপস্থিত সবাই মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে রইলেন কারো মুখ থেকে বিন্দুমাত্র কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। নীরবতা ভেঙ্গে ডিটেক্টিভ মারুফ বলে উঠলো,
-আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে এতোদিন যেভাবে বড় বড় কথা বলে বেড়াচ্ছিলেন তা কিন্তু এই কদিনে তারই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। যাই হোক ছেলের উপরের দিকটাতো দেখেছেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে আপনার ছেলে কি করে বেড়ায় সেই দিকেও একটু খেয়াল রাখবেন আশা করি।
মারুফের কথা শুনে ফাহিমের বাবা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। পরক্ষণেই তিনি বলে উঠলেন,
-স্যার! আসলে আমি আজ নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ফাহিমকে কি এখন জেল থেকে ছাড়া হবেনা? ওতো এখন নির্দোষ আর সেটা প্রমাণও হয়ে গেছে।
তাঁর কথা শুনে এসআই আতিক বললেন,
-দুই তিনদিন পর ছাড়া হবে। কারণ কেইসটি অলরেডি আদালতে চলে গেছে তাই একটু সময় লাগবে। চিন্তা করবেন না আপনারা ওর সাথে প্রতিদিন দেখা করার সুযোগ পাবেন। আমি ওসির সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে দিবো। আপনারা এখন আসতে পারেন।
এসআই আতিকের কথা শুনে সকলেই থানা ত্যাগ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। সকলের মনে এক নীরব আনন্দ বিরাজ করলেও কষ্টের মাত্রাটাই বেশি। কারণ লিমার খুনী যে তাঁদের আত্মীয়দের মধ্যেই কেউ একজন এই বিষয়টি তাঁরা কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। সবচেয়ে বেশি অনুশোচনাবোধ কাজ করছে ফাহিমের বাবার মনে কারণ তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও পিতৃহীন ভাইপোদের দিকে কোনোকালে ফিরেও তাকাননি বরং সর্বদাই নিজের ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ওদেরওতো একটুখানি অধিকার আছে নিজের চাচার সাহায্য পাওয়ার। কিন্তু তিনি কি কখনো সেসব দায়িত্ব পালন করেছেন? না, কখনোই করেননি।
.
এসআই আতিকের স্ত্রী আফসানা হন্তদন্ত হয়ে ডাইনিং রুমে একের পর এক খাবার আইটেম মারুফের সামনে নিয়ে আসছেন। মারুফ এতে বেশ বিরক্ত হয়েই বললো,
-আহা ভাবী! এতো কিছু রান্না করার কি দরকার ছিলো?
পাশ থেকে আতিক বলে উঠলো,
-তোকে বিয়ের পর আফসানা এই প্রথমবারই দেখলো আর তাছাড়া আমার মুখে তোর গুণকীর্তন শুনতে শুনতে তোকে দেখার আগ্রহ এতোটাই ওর মনে উঁকি দিচ্ছিলো যে মাঝেমধ্যেই আমাকে পীড়া দিয়ে বলতো তোকে যেনো আমি আসতে বলি। কিন্তু তুইতো এমনি এমনি কোনোদিনই আমার বাসায় আসবি না তাই এবার এই কেইসটাকে কেন্দ্র করেই অবশেষে তোকে বাসায় নিয়ে এসে আমার বেগমের ইচ্ছা পূরণ করলাম। এখন ওকে একদমই বাঁধা দিস নাতো। এতোদিন পর নিজের স্বপ্নে আসা দেবরকে কাছে পেয়েছে এখন কেইবা আটকাতে পারবে ওকে? তুইই বল!
এই বলেই আতিক অট্টহাসিতে ফেঁটে পরলো।
খাওয়া দাওয়ার মাঝে হঠাৎই আতিক বলে উঠলো,
-আচ্ছা আসল ঘটনাইতো জানা হলোনা। তুই রফিককে কিভাবে সন্দেহ করলি লিমার খুনের ব্যপারে? আমাকে একটু বলতো! আমিতো সন্দেহ করেছিলাম ওর ছোট ভাই লিমনকে।
মারুফ কিছুটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,
-এই কেইসটা আমি প্রথম দিনেই সলভ করে ফেলেছিলাম কিন্তু আলসেমী করেই এই কদিন অপেক্ষা করেছি। কিন্তু এই অপেক্ষার মাঝেও আরো অনেক কিছু লিমার খুনের বিষয় ছাড়াও আমি জানতে পেরেছি যেটা আমার মনে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করেছে। প্রথমদিন ফাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়েই আমি বুঝতে পারি ও আমার কাছে বেশ কিছু বিষয় লুকিয়েছে কিন্তু তবুও ওর কথায় কিছুটা সত্যতা ছিলো যেমন ও লিমার ঘরে যাওয়ার সময় ঝোপের আড়ালে কাউকে লুকাতে দেখেছিলো। আর আমি এই সূত্রকে কেন্দ্র করেই অনুসন্ধানের সময় প্রথমেই ফাহিমের কথামতো সেই ঝোপের মধ্যে সার্চ করি। সেখানের মাটি বেশ নরম থাকাতে রফিকের জুতার ছাপ স্পষ্টতই মাটির সাথে বসে গিয়েছিলো। আর আমার প্রথম থেকেই ধারণাতে ছিলো লিমার খুন আপনজনের মধ্য থেকে ছাড়া অন্য কেউ করবেনা। তাই আমি আরো কিছুটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য লিমার ঘরে নিখুঁত ভাবে সার্চ করি। সার্চ করার সময় আমি সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটিই লিমার বিছানায় পেয়ে যাই আর তা হলো এক টুকরো রফিকের চুল। হয়তো প্রথম অবস্থাতে লিমার সাথে ওর ধস্তাধস্তি হয়েছিলো আর সেখান থেকেই লিমা রফিকের চুল আকড়ে ধরেছিলো বোধহয়। তবে সে বেশিক্ষণ রফিকের সাথে নিজের শক্তিমত্তা দিয়ে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি বরং তাঁর আগেই রফিক ক্লোরোফরম জাতীয় কিছু দিয়ে লিমাকে অচেতন করে ফেলেছিলো। অতঃপর সে লিমার সাথে এমনভাবে অন্তরঙ্গ হয়েছিলো যাতে কোনো যুক্তি প্রমাণ কিংবা ডিএনএ স্যাম্পল না থাকে। নিজের কাজ সেড়ে ফেলার পর রফিক লিমাকে অচেতন অবস্থাতেই বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করে। অতঃপর লিমার লাশের গলায় ওর নিজেরই ওড়না পেঁচিয়ে ওকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয় এমনকি লিমার পায়ের নিচে টুলটা এমনভাবে ফেলে রেখেছিলো যাতে করে সবাই বুঝতে পারে লিমা আত্মহত্যা করেছে। সবশেষ সে লিমার পার্সোনাল ডাইরীতে মনের মতো করে একটি সুইসাইড লেটার লিখে টেবিলের উপর রেখে দেয়। তবে সে এখানে একটি বোকার মতো কাজ করে ফেলেছে আর তা হলো সুইসাইড নোটে সে লিমার হাতের লেখা কপি না করে নিজের মতোই সেটা লিখে দিয়েছিলো। তবে লিমার বিছানায় পাওয়া সেই চুলটাই সকল রহস্যের সমাধান করে ফেলেছিলো। আমি আগে থেকেই বুদ্ধি করে সন্দেহভাজন সকলের ডিএনএ সংগ্রহ করে রেখেছিলাম আর যখন সেই চুলের ডিএনএর সাথে রফিকের ডিএনএ মিলে যায় তখনতো সব রহস্যের বেড়াজাল খুলেই গেলো। বুঝছেন এবার?
আতিক এখনো মারুফের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তাঁর মাথায় যে গোবরে ভরপুর এবং মারুফের তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার কাছে তাঁর বুদ্ধি যে নিতান্তই তুচ্ছ সেটা এখন সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।
-আতিক ভাই মুখে মশা ঢুকবে কিন্তু এভাবে হা করে থাকলে।
মারুফের কথা শুনে আতিকের চেতনা ফিরতেই সে উৎফুল্ল স্বরেই বললো,
-ভাইরে ভাই কি শুনাইলি। আমার মনে হচ্ছে ইতিহাসের বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের তুলনায় তুই কোনো অংশেই কম নয়। আমার কেন জানি তোর বুদ্ধিমত্তা দেখে তোর সামনে মাথা নত করার ইচ্ছা জাগছে।
-ধুর কি যে বলেন! আচ্ছা এসব বাদ দিন আমার কিন্তু বিকালেই কর্মক্ষেত্রে ফিরতে হবে। একটি নতুন কেইসের দায়িত্ব পরেছে আমার হাতে।
-একদিনওতো থাকলি না। আজই যেতে হবে?
আতিকের কথা শুনে মারুফ কিছুটা মুচকি হেসে বললো,
-আবার কোনো একদিন আপনার নতুন কোনো কেইসের জন্য আসবো চিন্তা কইরেননা। আর ভাবী যেভাবে আপ্যায়ণ করলো তাতে আবার না এসে পারি?
মারুফের কথায় সকলেই এক সম্মিলিত হাসি দিয়ে নিজেদের সুখকর মুহূর্তের বিনিময় করার চেষ্টা করলো কিছুটা।
.
লিমার খুনের পনেরো দিন পার হয়ে গেছে। ওদের বাড়িটা এখনো কেমন যেনো নিস্তব্ধতায় ছেঁয়ে রয়েছে। কারো মুখেই কোনো হাসির আভা বিদ্যমান নেই, এমন একটি ঘটনার পর কোনো পরিবারেই এতোটা তাড়াতাড়ি সুখের আবহ নিয়ে ফিরে আসবেনা এটাই স্বাভাবিক। ফাহিম উঠোনের মাঝে বসে বসে লিমার সাথে করা খুনসুটির মুহূর্তগুলো একমনে ভাবছে। সে যদিও লিমাকে ভালোবাসতো না তবুও মেয়েটির জন্য কেন যেন তাঁর মনটা বারংবারই কেঁদে উঠছে। হঠাৎই ফাহিমের বাবা ফাহিমকে ডাক দিয়ে বললো,
-ঘরে এসো তোমার সাথে কথা আছে।
ফাহিম ওর বাবার কথামতো ঘরে ফিরতেই দেখতে পায় পরিবারের সবাই ওর বাবার দিকে মুখিয়ে বসে আছে এবং কিছু শোনার অপেক্ষা করছে। নীরবতা ভেঙ্গে ফাহিমের বাবা বলে উঠলো,
-পাশের গ্রামের কুদ্দুসের মেয়ে রাইসার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। আগামী সপ্তাহেই বিয়ে।
ফাহিম বেশ অবাক হয় কারণ সে বুঝতে পারছে না তাঁর বাবা হঠাৎই কেন রাইসার সাথে তাঁর বিয়ে ঠিক করলো?
-বাবা, আমি মাত্র থার্ড ইয়ারে উঠেছি। পড়ালেখা শেষ করার আগে বিয়ের ব্যপারে কিছু ভাবছি না।
-চুপ থাকো বেয়াদব ছেলে! বিয়ে করতে পারবেনা তাহলে প্রেম করতে পারো কিভাবে? তোমার জন্য আমি এক মেয়েকে হারিয়েছি তাই অন্য কোনো মেয়েকে হারাতে চাইনা। তুমিতো আমার মান সম্মানটুকু যা ছিল তার সবটুকুই ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছো। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইনা।
ফাহিম কিছু বলেনা বরং মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে থাকে।
অপরদিকে রাইসা এখনো ভেবে পাচ্ছে না যে ফাহিমের বাবা কিভাবে তাঁর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলো? ফাহিমতো জীবনেও এসব কথা তাঁর বাবার কাছে প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র সাহসও করবে না, তবে? তবে কি সেই ডিটেক্টিভ স্যারই এসবের পিছনে রয়েছে? তিনিতো সেদিন রাইসাকে কথা দিয়েছিলো যে অচিরেই ফাহিম তাকে বিয়ে করবে। হুম তাহলে হয়তো সেই ফাহিম এবং রাইসার এই পবিত্র বন্ধন তৈরি করার পিছনের কারিগর। আর এটাইতো রাইসার একমাত্র জীবনের লক্ষ্য ছিলো বোধহয়। শেষটা হোক না সুন্দর দোষ কি তাতে?
.
(সমাপ্ত)