রাহাত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
- উনি কেন বের হতেন না?
- এমিলস নামক মানুষেরই এক অদ্ভুত প্রজাতির প্রাণীর কারণে। এই প্রশ্নের বাকি জবাব ডাক্তার শেখর আংকেল দিবেন।
রাহাত বোনের কথা শুনে ডাক্তার শেখরের দিকে তাকালো। তিনি মৌন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখের উপর স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। এমিলস প্রজাতি সম্পর্কে তার ধারণা যে যথেষ্ট, তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সবাই মিলে একটা চায়ের টং দোকানের ভিতর গিয়ে চেয়ার পেতে বসলো। আদিবের মুখে কোনো কথা নেই। ছেলের শোকে সে প্রায় পাগল হবার উপক্রম। একটামাত্র ছেলে ছিল শ্রাবণ। আর সবার পিছু পিছু সে ও চুপচাপ গিয়ে বসলো। ডাক্তার শেখর একটা সিগারেট ধরালেন। লম্বা করে একটা টান দিয়ে সকলের মুখোমুখি হয়ে যা বললেন, তার সারমর্ম এই-
একটা ভয়ংকর ঘটনার পর বেশ কিছুমাস খোঁজ নিয়ে ডাক্তার শেখর এই প্রজাতি সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করেছেন। এমিলস হচ্ছে মানুষেরই এক শ্রেণি। প্রায় দুশো বছর ধরে পৃথিবীতে এদের আবির্ভাব ঘটেছে। সুইজারল্যান্ডের একজন ভয়ংকর বিজ্ঞানী লিমাস ভ্যারি মানুষেরই জীনের সাথে কিছু ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সংকরায়ন করে। ধাপে ধাপে কয়েকটা পরীক্ষার পর এই এমিলসের বেশ কিছু ভ্রুণ তৈরি হয়। ওরা বড় হয়ে ওঠে। খাদ্যাভ্যাস একদম মানুষের মতোই। তবে মানুষের শরীরের ভিতরকার চর্বি এবং হৃদপিন্ডের রক্ত পেলে ওদের শরীর আরো বেশি শক্তি অর্জন করতে পারে। বাংলায় একটা কথা আছে- সাপুড়ে সাপের কামড়েই মরে। লিমাস ভ্যারি এই নোংরা খেলায় এতই মত্ত ছিলো যে, তাদেরকে আরো ভয়ংকরভাবে গড়ে তুলতে মরিয়ে হয়ে উঠলো। একদিন নিজের ল্যাবরুমেই এমিলসদের হাতে খুন হয় সে। তখন হাতে গোনা মাত্র দশ পনেরোটা এমিলস ছিল। ওরা মানুষের সভ্যতায় বাস করলেও নিজেদের রুপ বাইরে প্রকাশ করে না। এদেরকে সাধারণ মানুষের ভিড়ে আলাদা করে ধরতেও পারা যায় না। সুইজারল্যান্ড সরকার নিজেদের এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা রীতিমতো চেপে যায়। এর পরপরই এমিলসরা বংশ বিস্তার করে সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে গেছে।
ডাক্তার শেখর এবং আকিমুল হাসান একবার সুন্দরবনে গেছিলেন প্রকৃতি ভ্রমণে। ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন বিকালে কিছু স্থানীয় মানুষের সাথে তাদের ঝামেলা হয় নৌকা ভাড়া করা নিয়ে। অবস্থা বেশি খারাপ দেখে সেদিনের মতো যাত্রা বিরতি দিয়ে ফিরছিলেন হোটেল। একেবারে ভরা সন্ধ্যায় মাঝ রাস্তায় হঠাৎ দেখতে পায়, একজন মাঝবয়সী মহিলা একটা ছোট বাচ্চার বুকের উপর বসে জোরে চাপ দিচ্ছে। ছেলেটা প্রায় মরে যাবার উপক্রম। ডাক্তার শেখর ছুটে গিয়ে তাকে এক ধাক্কায় ফেলে দেয়। চল্লিশোর্ধ্ব মহিলাটি তার এমন হঠাৎ আচরণে ক্ষিপ্ত হয়। মাটি থেকে একপাফে উঠেই সোজা শেখরের গলা টিপে ধরে সে। সাথে তার চোখেমুখের ভয়ংকর ভঙ্গি। সাধারণ মানুষ এমন ভয়ংকর ভঙ্গিতে তাকাতে পারে? তার উপর একলাফে এভাবে ছুটে এসে শেখরকে আক্রমণ! আকিমুল হাসান মুহুর্তেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন। একটা মহিলাকে পাল্টা আঘাত করাও সমীচীন নয়। আবার আরেক দিকে বন্ধুর জীবন। কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। পাশ থেকে একজন মাঝি গোছের কেউ আকিমুল হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
-আরে আরে, বনমানুষ আবারো এসেছে! স্যার, ওই কিন্তু স্যারকে খুন করে ফেলবে। জলদি কিছু করেন।
আকিমুল হাসান আর কিছু ভাবতে পারলেন না। কাছে থাকা চুরিটা সোজা চালিয়ে দিলেন মহিলাটির পেটের ভিতর। এক মুহুর্ত, মাত্র এক মুহুর্তে মহিলার পেট ফুঁড়ে নাড়িভুড়ি ঠিকরে বের হয়ে আসার উপক্রম প্রায়। শেখরকে ছেড়ে দিয়ে সে ছুটে পালিয়ে গেল নিমিষেই। ছোট বাচ্চাটা তখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। ক্ষণিক মুহুর্তেই এই সবকিছু ঘটে গেল। ছুরিটা হাতে তিনি তখনো দাঁড়িয়ে আছেন বাচ্চাটির দিকে চেয়ে। মাঝিটা তাকে জাগ্রত করানোর জন্য মাটিতে বসে কোলের উপর তুলে ধরল। তারপর আকিমুল হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
- স্যার, গত কয়েকমাস যাবৎ আমাদের সুন্দরবনে হঠাৎ বনমানুষের আগমণ ঘটেছে। অনেকের মুখেই শুনেছি। তবে আজই প্রথম দেখলাম। ওরা মানুষের হৃদপিন্ড নিয়ে নেয়।
ডাক্তার শেখর এবং আকিমুল হাসান এরপর সুন্দরবন থেকে ফিরে এ নিয়ে টুকটাক খোঁজ খবর নিলেও আকিমুল হাসান থেমে যান। কারণ এরপরই একদিন তার উপর রাস্তায় অদ্ভুতভাবে আক্রমণ হয়েছিল। সেটা যে কোনো এমিলস ছিল, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আকিমুল হাসান আর খুব একটা বাইরে বের হতেন না। কিন্তু ডাক্তার শেখর অনবরত এই এমিলস সম্পর্কে খোঁজ রেখেছেন। ওদের চলাফেরা, আচার আচরণ, এই সবকিছু সম্পর্কে তিনি নিয়মিত আকিমুল হাসানকে আপডেট জানাতেন।
পুরো ঘটনা শুনে রাহাত একেবারে হতবাক হয়ে যায়। আদিব এখন নিশ্চিত, তার ছেলের মৃত্যুতে কোনোভাবে এই এমিলসের যোগ আছে। কিন্তু অগোচরে ঘরের ভিতর ঢুকলো কীভাবে! জটিল প্রশ্নটার উত্তর যখন সে খুঁজে পাচ্ছিল না, ঠিক তখনই সায়না গম্ভীর স্বরে বলল,
- আচ্ছা রাহাত ভাই, এনার সাথে তোর পরিচয়টা কীভাবে হয়েছিল?
-কেন?
- আগে বলবি তো।
- শপিংমলে। কেনাকাটা করতে গিয়ে। আমি তোর জন্য একটা ঘড়ি পছন্দ করছিলাম। এনাও ওই একই ঘড়ি পছন্দ করে।
- ওর ব্যাপারে আর কতটুকু খোঁজ নিয়েছিস?
- কী খোঁজ নেবো! আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করছি। ওর বাবা মা মধ্যবিত্ত হলেও যথেষ্ট আত্মসম্মানবোধ আছে তাদের। আমি উনাদের সাথে মিশেছি।
-বিয়ের পর আর গেছিস?
সায়নার এমন অদ্ভুত প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হয় রাহাত। বিরক্তির সুরেই তাকে জবাব দেয়,
- এই অসময়ে তোর এনার বংশের খোঁজই লাগবে! শ্রাবণ আর আমাদের মাঝে নেই। বুঝতে পারছিস?
- পারছি বলেই তো জিজ্ঞাসা করছি। শেখর আঙ্কেল যে ধারণা দিলেন, তাতে আমার এনার উপর শতভাগ সন্দেহ রয়েছে- সে এমিলস সম্পর্কে জানে কিংবা নিজেই ওই প্রজাতির কেউ।
- মানে!
- বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্যি। বাবা যেদিন ছাদ থেকে পড়ে যান, আমি ওকে ছাদ থেকে নামতে দেখেছি। এরপর থেকেই এনা যতবার বাবার সামনে গেছে, বাবার চেহারায় একটা আতঙ্কের ছাপ।
রাহাত স্তব্ধ হয়ে যায়। বিয়ের এতদিনেও এনা তার কাছাকাছি আসেনি। পরিবারের সবার থেকেই দুরুত্ব বজায় রেখেছে। তবে কী সায়নার কথাই ঠিক? তড়িৎগতিতে সে উঠে দাঁড়িয়ে আরাধ্যার নাম্বারে কল দেয়। বাসায় আনান এবং তাওফী রয়েছে। এই বিপদের সময় বাচ্চা দুটো সবার নজরে নাও থাকতে পারে। আরাধ্যা হয়তো তমিসাকে সান্ত্বনা দিতেই ব্যস্ত। রিং হচ্ছে, কিন্তু কল রিসিভ করছে না কেউ। এবার কী হবে! তিন ভাইবোন একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে শঙ্কিত হয়ে গেল।
দ্রুত গাড়িতে উঠে রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। এরমধ্যে সায়না অনিকেতের নাম্বারে অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর অনিকেত কল রিসিভ করলো। সায়না তাকে জিজ্ঞাসা করল,
-ভাইয়া, আনান কোথায়?
ওপাশ থেকে অনিকেতের উত্তর,
- কী জানি! ঘরেই তো খেলছিল।
- শিগগিরই ওকে খুঁজে নিয়ে আসো ভাইয়া। একদম তোমার নাগালের বাইরে যেতে দেবে না। আর এনা কোথায় জানো?
- আমি তো ওয়াশরুমে ছিলাম। এনা বোধহয় রান্নাঘরে।
- এনাকে চোখে চোখে রাখো।
- কিন্তু কেন?
- ফিরে এসে বলছি। তুমি প্লিজ ওকে নজরে রাখো।
ফোন রাখার পর ডাক্তার শেখরও কাদেরকে জানি কল দিয়ে সায়নাদের বাসায় আসতে বললেন। প্রায় চার মিনিট পর বাসায় পৌঁছেই রাহাত ছুটে গেল রান্নাঘরে। সেখানে কেউ নেই। তমিসার ঘরে আরাধ্যা তমিসাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। পাশেই আনান বসে। ওদের পিছু পিছু অনিকেতও ঘরে ঢুকে বলল,
- আনান সেই থেকেই ওর মায়ের কাছে আছে।
- আর তাওফী?
-তাওফী!
আরাধ্যা জবাব দেয়,
- চাচা একটু বাইরে গেছেন। তাই তাওফীকে বাবার কাছে বসিয়ে দিয়ে এসেছি। উনার কিছু লাগলে যাতে আমাকে ডাকে।
আরাধ্যার কথার প্রতুত্তর করার প্রয়োজন মনে করে না কেউ। আকিমুল হাসানের ঘরে গিয়ে রাহাত দেখতে পায়, এনা বারান্দার কাছের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তাওফীকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
- তোমার ভাইয়ের জন্য মায়া লাগছে? ভাইয়ের কাছে যাবে?
ওর দিকে আকিমুল হাসান নিস্পলক চেয়ে আছেন। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে অবিরত। তাওফী এনাকে পালটা প্রশ্ন করে,
- ভাইয়ার কাছে যাওয়া যায়?
- হ্যাঁ, যাবে না কেন? তুমি চাইলেই আমি তোমাকে এগিয়ে দেবো।।
রাহাতকে এনা তখনো খেয়াল করেনি। ওর পাশে গিয়ে রাহাত অত্যন্ত শান্ত সুরে বলল,
- তুমি কীভাবে নিয়ে যাবে এনা? আমাকেও নিয়ে চলো।
রাহাতের আকস্মিক প্রশ্নে এনা চমকে ওঠে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে রাহাত, সায়নাসহ সকলে এসে দাঁড়িয়ে আছে। রাহাত প্রায় ছো মেরে তাওফীকে ওর থেকে সরিয়ে নিয়ে সায়নার কাছে এগিয়ে দিলো। এনা নির্বাক। চোখেমুখে উৎকন্ঠা।
বুঝতে আর বাকি নেই, এই বাসার অনেকেই তার বিষয়ে হয়তো জেনে গেছে। বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে পালানোর আগেই রাহাত ওকে জাপ্টে ধরে ফেলে। এনা কয়েক মুহুর্ত জোর করে নিজেকে ছাড়াতে গেলেও একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে নিথর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। রাহাত জিজ্ঞাসা করলো,
- কেন এনা?
- তোমার বাবা সুন্দরবনে একজনকে আঘাত করেছিল, সে মারা গেছে। আর তিনি আমার ফুপি।
- আমি সে ঘটনা জানি। বাবা তো ইচ্ছে করে উনাকে আঘাত করেনি। উনি তো একটা ছোট বাচ্চাকে... এটা কারো দ্বারা কিভাবে সম্ভব?
- তোমার মুরগির রোস্ট খেতে ইচ্ছে করলে যখন মুরগি জবাই দাও, তখন কী এত সম্ভব অসম্ভব ভাবো? ওদেরও তো কষ্ট দাও। আমাদের কাছেও তেমন স্বাভাবিক।
-কিন্তু তোমরা তো মানুষেরই প্রজাতি।
- মানুষ তো নই।
- তাই বলে শ্রাবণকে!
এনা আর জবাব দেয় না। নিজের ভুলের জন্য সামান্য অনুশোচনা হলেও এতগুলো মানুষের চোখের পানি দেখে কেমন যেন মুষড়ে গেল সে। ততক্ষণে গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন অফিসার চলে এসেছে।
রাহাত তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
- ওকে নিয়ে যান।
একজন মহিলা অফিসার এসে এনাকে নিয়ে যেতে লাগল। এনা যেন হঠাৎই অন্য দুনিয়ায় নিজেকে আবিষ্কার করছে। দুচোখ ছলছল করছে তার। যতক্ষণ ঘরের ভিতর থাকার সুযোগ পেল, রাহাতের দিকেই চেয়ে ছিল। রাহাত অফিসারদের এনা যে এমিলস প্রজাতি, তা জানালো না। শুধু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সে। যারা প্রবল ভালোবাসতে জানে, বেঈমানদের জন্য ঘৃণাও পুষতে জানে।
(সমাপ্ত)