সায়না বাবার চোখের দিকে চেয়ে তার দৃষ্টি বরাবর এনার দিকে ফিরে এসে তাকাল। এনাকে দেখে বাবার এমন প্রতিক্রিয়া করার কারণ কী! বেশ কয়েকবার সে বাবার অপ্রকাশ্য ভাষা বুঝে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু হুট করে একজন থেমে যাওয়া মানুষের ভাষা বুঝে উঠা যায় না। এদিকে এনার মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। একেবারে চুপচাপ সে আনানকে দুইহাতের মাঝে আড়কোলে করে ধরে আছে।
বাসায় আনান ছাড়াও আরো দুটো ছোট ছোট বাচ্চা আছে। তাওফি আর শ্রাবণ। রাহাতের চাচাতো ভাই আদিবের সন্তান ওরা। পুরো পরিবার একসাথেই বাস করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে তাওফি আর শ্রাবণকে অযথা আর হাসপাতাল অব্দি টেনে আনা হয়নি। বাসায় মায়ের কাছেই রয়ে গেছে তারা। আকিমুল হাসানের বড় ভাই আমিনুল সাহেব এসে ভাইয়ের হাত ধরে কান্না করতে করতে বললেন,
- কতদিন ছাদে উঠিস না তুই! কাল ছাদে গেলি। আর গতকালই এমন ভয়ংকর দূর্ঘটনা ঘটল। বয়স হয়েছে। ছাদের এত ধারে যাবার কী খুব প্রয়োজন ছিল?
আকিমুল হাসান প্রতুত্তরে কেবল দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলেন। ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব তার জানা থাকলেও দেওয়ার সামর্থ্য এই মুহুর্তে আর নেই। রাহাত উঠে এসে আনানকে নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে এনাকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলল,
- বাবার পাশে গিয়ে একটু বসো। উনি কিছুটা হলেও ভরসা পাবেন।
রাহাতের কথায় বাধ্য মেয়ের মতোই আকিমুল হাসানের পাশে গিয়ে বসল এনা। একেবারে বেডের কাছের চেয়ারটাই টেনে বসেছে সে। মুহুর্তেই আবারও আকিমুল সাহেবের সেই ভয়ংকর চোখের দৃষ্টি। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার প্রবল চেষ্টা।
সমস্তটা খেয়াল করে সায়না হঠাৎই এনার হাত ধরে টেনে বাইরে বের হতে হতে বলল,
- ভাবি, আমার সাথে একটু বাইরে চলো তো। বাবার জন্য একটা জিনিস আনতে ভুলে গেছি।
সবাই একপলক বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকালেও খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। এই মুহুর্তে বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে নিয়েই গুরুত্বের ভার গ্রহণের আয়োজন চলছে।
এনাকে সাথে নিয়ে সায়না হাসপাতাল থেকে একদম বাইরে বের হয়ে আসে। একটা ট্যাক্সি ধরে বাসার ঠিকানা বলে সেটাতে চড়ে বসে দুজনেই। এতসব ঘটনার মাঝেও এনার ভিতর যেন কোনো ভাবান্তর নেই। তবে সায়নার দিকে সে যথেষ্ট সতর্কতা সাথে নজর রেখেছে। এত সহজে উদ্দেশ্য হাসিলের আগে তো ধরা দেওয়া যাবে না। গাড়ির জানালার দিকে চেয়ে সায়না বলল,
- এনা ভাবি, তোমার শরীরে হাত দিলে কেমন যেন একটা তৈলাক্ত অনুভূতি আসে। কেন বলো তো?
এনা উদাস ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
- মানে? কই আমি তো পাই না।
- হয়তো খুব বেশি নরম। এজন্যই। তুমি এই যে এত সুন্দরী, এর রহস্য কী?
- সায়না, এমন বোকার মতো প্রশ্ন কেউ করে? আমি তো নিজ হাতে নিজেকে তৈরি করিনি।
সায়না আর প্রশ্ন করে না। তেমনি চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝেই আড়চোখে তাকায় এনার দিকে। কেমন যেন অদ্ভুত এই এনা নামক মেয়েটা। আগামাথা কিছুই টের পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সায়না আবার জিজ্ঞাসা করে,
- তোমার আর ভাইয়ার তো লাভ ম্যারেজ। আচ্ছা, তোমাদের আলাপটা কীভাবে হয়েছিল বলো তো?
- তেমন কোনো ভাবেই না সায়না। তুমি হঠাৎ আমার বিষয় নিয়ে এত ভাবছ যে বড্ড! শশুর বাবা হাসপাতালে ভর্তি, প্যারালাইজড। না জানি, আর কী কী বিপদ হতে পারে আমাদের পরিবারে।
- আশা রাখি, আর কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। তবে এনা ভাবি, আমার কিন্তু বরাবরই তোমাদের সম্পর্কের ইতিহাস জানার ভীষণ আগ্রহ। প্লিজ, বলো না সে গল্প।
এনা একবার গম্ভীর দৃষ্টিতে সায়নার দিকে তাকালো। এই মেয়েটা কি কোনোভাবে তাকে সন্দেহ করছে? সম্পর্কের গল্পটা কিছুটা হলেও জানানো উচিত এখন। এনা সিটে হেলান দিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলতে লাগল,
- তেমন কিছুই না। তোমার ভাইয়ার অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছিলাম। আমার কথা, বুদ্ধিমত্তা আর চিন্তাভাবনা ওর এত ভালো লাগে যে- সেরা চারজন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে আমাকেও নির্বাচন করে। পাশাপাশি ডেস্ক দুজনের। আলাপ, পরিচয়,বন্ধুত্ব। আর তারপরের ঘটনা তো জানোই। এতটুকুই ছিল আমাদের প্রেমের সম্পর্কে।
- তোমার বাবা মা সেই কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের রিসিপশনের দিন ছাড়া তোমাকে আর দেখতে আসেন না কেন?
- মেয়ের শশুরবাড়িতে বাবা মায়ের এভাবে আসা উচিত? বিয়ে করো, তখন নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে।
- তোমার ওদেরকে দেখতে ইচ্ছে করে না?
- কী যে বলো না তুমি। কোন মেয়ের তার বাবা মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না শুনি? এসব বাদ দাও তো। তোমার কথা বলো। তোমাদের সাথে তো আমি সেভাবে কথাই বলে উঠতে পারি না।
- আমি? এই মুহুর্তে বাবা ছাড়া আমার আর কোনো কথা নেই। কীভাবে যে ছাদ থেকে উনি পড়ে গেলেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। বাবা এতটা আনমনে হয়ে জীবনেও চলাফেরা করেন না। কিছুদিন যাবত ঘরের প্রচন্ড মনমরা হয়ে বসে থাকতেন। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। তোমাকে হয়তো বাবা এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। হাসপাতালে তোমাকে দেখামাত্রই কেমন প্রতিক্রিয়া করছিল, দেখলেই তো। তবে ডাক্তার বলেছেন, উনি সুস্থ হতেও পারেন আবার নাও পারেন।
- আমারও তাই মনে হয়। তবে চিন্তা করো না। আমি আমার সেবাযত্নে শশুর বাবার মন ঠিকই জিতে নেবো।
কথা বলতে বলতে গাড়ি এসে দাঁড়ায় বাসার গেইটের সামনে। নিজের ঘরে ঢুকে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নেয় এনা। সায়না অবশ্য বাড়ির টুকটাক কাজে আদিবের স্ত্রী তমিসাকে সাহায্য করছে। সারারাত বাবার জন্য হাসপাতালে জেগে থেকে তার ক্লান্তির শেষ ছিল না। কিন্তু এখন হাজার চেষ্টা করলেও ঘুম তার আসবে না। বাবার দুশ্চিন্তা এখনো মাথায় চেপে আছে।
রান্নাঘরে কাজের শেষ পর্যায়ে তমিসা সায়নাকে বলল,
- এবার তুমি একটু বিশ্রাম নাও সায়না। অনেক করেছ।
অনিচ্ছ্বাসত্ত্বেও তমিসার অনুরোধে সায়না বিশ্রাম নিতে চলে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ না করলে তার শুতে ভালো লাগে না। তাই একেবারে ছিটকিনি না লাগিয়ে দরজাটা কিছুটা ধাক্কা দিয়ে ঠেস দিয়ে রাখল। তমিসা তখনো বাসন পরিষ্কার করছে। বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে একটা একটা করে প্লেট ধুয়ে রাখার সময় ওর মনে হলো, পিছেই যেন কারো শ্বাস পড়ল। কিছুটা সন্দেহপ্রবন হয়েই সে ঘুরে তাকায়। এনা দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরুত্বেই। সে মুচকি হাসির চেষ্টা করে বলল,
- এনা! তোমার সাথে তো একসাথেই বসা হয় না। হঠাৎ রান্নাঘরে যে? আকিমুল চাচার জন্য মন খারাপ লাগছে? লাগারই কথা গো। এভাবে হঠাৎ করে ছাদ থেকে এমন ভয়ংকরভাবে পড়ে গেলেন যে, একেবারে প্যারালাইজড। আমি তো দেখতে যেতে পারলাম না। যাবোই বা কি করে বলো তো? সবার কথাই তো আমাকে ভাবতে হবে। এতগুলো মানুষ দুশ্চিন্তায় একটা দানা মুখে তোলেনি।
এনা জবাব দেয় না। যেমনি নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনি চুপচাপ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তমিসা আবার বলল,
- আমি খুবই ভয় পেয়ে গেছিলাম, জানো? আচ্ছা, তোমার কী কিছু লাগবে?
এনা তবু কোনো প্রতুত্তর করে না। ধীর পায়ে সে তমিসার দিকে এগিয়ে যায় ওর চোখের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে। তমিসা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেয়েটার উদ্দেশ্য কি? ভয় পেয়ে যায় সে। গলাটা কেমন যেন আটকে আসে। ঠিক তক্ষুণি রাহাত বাসার ভিতরে ঢুকে বেশ জোর গলায় এনার নাম ধরে ডাকতে থাকে,
- এনা, এনা!
রাহাতের গলার আওয়াজ পেয়ে এনা নিজেকে সামলে নিয়ে একটু জোর পায়ে তমিসার কাছে এগিয়ে যায়। তারপর ওকে হালকা চাপ দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলতে থাকে,
- আপনি খুব কাজ করেছেন। এবার বাকি কাজগুলো করার দায়িত্বটুকু আমার উপর ছেড়ে দিন তো।
এনা তাহলে সেই বেসিনের কাছে আসছিল! এতক্ষণ নিজের বোকামো চিন্তার জন্য মনে মনেই নিজেকে উপহাস করে তমিসা। ওকে বাধা দিয়ে বলল,
- আরে, কী করে বোকা মেয়ে! আমিই সব গুছিয়ে নেবো। রাহাতের গলার আওয়াজ পেলাম।ছেলেটাকে একটু সঙ্গ দাও।
- কিন্তু ভাবি...
- উঁহু, আর কোনো কথা না। যাও তো তুমি। আমি সব সামলে নিচ্ছি এখানে।
এনা অনেকটা বিরক্তি নিয়েই রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। রাহাত ঘর্মাক্ত শরীরে ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এনাকে দেখামাত্রই এগিয়ে এসে শার্টটা খুলতে খুলতে বলল,
- বাবাকে কাল বাসায় নিয়ে আসতে চাচ্ছি। এখান থেকেই চিকিৎসা হবে উনার। হাসপাতালে রাখতে চাই না।
এনা কেবল মাথা দুলায়। রাহাত মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। ওকেই সঙ্গ দিতে হচ্ছে এনাকে।
পরদিন দুপুরবেলা আকিমুল হাসানকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। আলাদা রুমে চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। একে একে সবাই দেখা করে গেলেও এনা তার সামনে আসেনি। প্রায় সন্ধ্যার দিকে সাত বছরের শ্রাবণকে দাদুর পাশে বসিয়ে একটু বাইরে এলো তমিসা। ঠিক তখনি ঘরের ভিতর আসে এনা। আকিমুল হাসান নীরবে শুয়ে আছেন বারান্দার দিকে মুখ ফিরিয়ে। শ্রাবণ ততক্ষণে খেলতে খেলতে বারান্দায় চলে গেছে। ছেলেটা দেখতে ভারি সুন্দর হয়েছে। ওর দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। একমনে শ্রাবণের দিকেই চেয়ে আছেন আকিমুল হাসান। এনা এক পা দু পা করে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ ওর উপস্থিতিতে বেশ ঘাবড়ে যান আকিমুল সাহেব। পাশেই বিল্ডিংয়ের অবশিষ্ট কাজের শেষ না হওয়া লোহার রড গেথে আছে। মেয়েটা শ্রাবণের দিকে কেন যাচ্ছে! এই বাচ্চা ছেলেকে
ডাকার শক্তিও আকিমুল হাসানের নেই। এনা শ্রাবণকে জিজ্ঞাসা করল,
- এখানে কী করছ শ্রাবণ?
- খেলছি।
উত্তর দেয় শ্রাবণ।
- ওই রডের উপর বসবে? ওখান থেকে দোল খেলতে দারুণ মজা।
- সত্যি?
- হ্যাঁ, আমি তো রোজ খেলি। তুমি বসবে?
এই বলে আকিমুল হাসানের দিকে ফিরে তাকায় এনা। মানুষটার চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন। ওই চোখ যেন চিৎকার করে বলছে, " বাচ্চা ছেলেটাক প্লিজ ছেড়ে দাও। ওর কোনো ক্ষতি তুমি করো না এনা।"
পর্ব ৩
আকিমুল হাসানের না বলা শব্দগুলো অপ্রকাশিত হলেও তার চোখ ঠিকই সমস্তটা প্রকাশ করে দিচ্ছে। এনা তার দিকে চেয়ে সামান্য হাসির চেষ্টা করলো। শ্রাবণ ওর দিকে দুই হাত বাড়িয়ে আছে সাথে যাবার জন্য।
এনা ওকে কোলে নিয়ে দ্রুত পায়েই রডের দিকে এগিয়ে গেল। বারান্দা থেকে বেশ দূরেই রড। মুহুর্তেই সে প্রবল শক্তিতে রডের দিকে শ্রাবণকে নিয়ে ছুটে এগোলো। একটা একটা করে এলোমেলো হয়ে আছে সরু লোহার টুকরোগুলো। এনা হাতের শক্তিতে শ্রাবণকে ছুঁড়ে মারলো সেই রডের উপর। এতটুকু আওয়াজ হলো না কোথাও। শ্রাবণ না চিৎকার করতে পারলো আর না চোখের জল বের হবার সময় পেল। শুধু চোখের কোনে একফোঁটা জল নীরবে নুইয়ে এলো তার। একটা ছোট বাচ্চার নিথর দেহের ভিতর রড ঢুকে আছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে।
এই ফাঁকে এনা একলাফে সেখান থেকে ছিটকে সরে গেছে। আকিমুল হাসান তখনো নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন। এতবড় ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী কেবল এই একজন। সম্মুখে তার নাতির মৃতদেহ।
তমিসা শশুরের ওষুধপত্র নিয়ে ফিরে এসেছে। বোতল থেকে ওষুধ ঢালতে ঢালতে চাচাতো শশুরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
- চাচা, আমি আশা করেছিলাম এনা অন্তত এই সময়ে আপনার খেয়াল রাখবে। অথচ সে তো আপনার ধারেকাছেই আসছে না। ও বোধহয় আপনাকে আজও ভয় পায়। তখন যদি রাহাত আর এনার বিয়েটা খুশিমনে মেনে নিতেন, তবে মেয়েটা এতদিনে আপনার লক্ষী বউমা হয়ে উঠত।
চামচে করে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে তমিসা খেয়াল করল, আকিমুল হাসান বাইরের বারান্দার দিকে একমনে চেয়ে আছেন। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাকে সোজা করে ধরে ওষুধ খাওয়াতে গেলেও মুখ খুলছে না। কী আশ্চর্য! একটু আগেও তরল খাবার খাওয়ানোর সময় তো উনি স্বাচ্ছন্দ্যেই খেয়ে নিলেন। চাচা শশুরের এমন অদ্ভুত আচরণে বেশ অবাকই হলো সে। তমিসাও তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে বারান্দার দিকে ফিরে তাকায়। সেখানে লোহার রডের উপর শ্রাবণের রক্তাক্ত লাশ ঝুলছে। ওষুধের বোতলসহ চামচ ছিটকে পড়ে যায় ওর হাত থেকে। ছেলের লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে চিৎকার দিয়ে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে তমিসা। ওর চিৎকারে বাসার সবাই ছুটে এলো আকিমুল হাসানের ঘরে। সবার আগে এসেছে এনা নিজেই।
বারান্দার দিকে চেয়ে চমকিয়ে উঠে ভয়ার্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
- শ্রাবণ!
এনার আওয়াজে বাকিরাও বারন্দার দিকে ফিরে তাকায়। শ্রাবণের পেট ফুড়ে তখনো টপটপ করে রক্ত গড়াচ্ছে অবিরত। আদিব আর রাহাত ছুটে যায় শ্রাবণের কাছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। কান্নাকাটি, শোরগোলে পুরো বাড়ির চিত্রপট যেন একনিমিষেই পালটে গেল। সায়না পানি ছিটিয়ে তমিসার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল নিজের একমাত্র ছেলে শ্রাবণের লাশের সামনে। সম্মুখেই ছেলেটার লাশ নামিয়ে রাখছে আদিব ও রাহাত। সবার পিছে একটা জলজ্যান্ত সাক্ষী নীরবেই শুয়ে আছে একা একা। সেদিকে এই মুহুর্তে কারোরই মনোযোগ নেই। এই বাড়িতে একটার পর একটা বিপদ ঘটতেই আছে।
শ্রাবণের মৃত্যুর দুইদিন কেটে গেছে। বিপদকে মোকাবিলা করা এই বাড়ির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তা যে কারোরই উপলব্ধি হবে। শুধু তমিসা এখনো ঘোর কাটাতে পারেনি। ছেলের বিয়োগের শোক কোনো মায়ের বুক থেকেই বিদায় নিতে পারে না।
রাতে রাহাত একা একা নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে নীরবে ফুঁ দিয়ে চলেছে। এতসব বিপদের মুখোমুখি তার পরিবার। কাকে রেখে কে কাকে সান্ত্বণা দিবে! এনা ঘরে নেই। খুব সম্ভবত বাইরে সবার সাথে সঙ্গ দিচ্ছে।
মনেই মনেই ভাবে সে।
আরো প্রায় অনেকক্ষণ পর বিছানায় শোবার আগে এনা ঘরে ফিরে ভিতর থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
- ঘুমাবে না?
রাহাত জবাব দেয় না। তেমনি নীরবেই বাইরের দিকে চেয়ে আছে সে। এনা বিছানা ছেড়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। তারপর বারান্দায় গিয়ে রাহাতের কাধের উপর হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো,
- কী ভাবছো এত?
উদাস হয়ে রাহাত জবাব দেয়,
- এ বাড়ির তিনটা বাচ্চাই আমাদের কলিজার টুকরো। খুব অল্প সময়ের জন্য তমিসা ভাবি বাবা আর শ্রাবণকে রেখে বাইরে বের হয়েছিলেন। আর এর মাঝেই শ্রাবণও ওই বারান্দার দিকে কিভাবে গেল? শ্রাবণ তো এত বড় বোকা ছেলে নয়। আমাদের আনানের থেকেও ভীষণ বুদ্ধিমান ছিল সে।
-বিপদ কি আর বলে-কয়ে আসে, রাহাত?
-তমিসা ভাবির ভাগ্যটা এতখানি খারাপ হবে কে জানতো! বাবা সারাজীবন ওভাবেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাববেন, শ্রাবণের মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। তার জন্যই ভাবি শ্রাবণকে ঘরে রেখে গেছিল।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাহাত। এনা হঠাৎই আনমনে দুহাতে রাহাতকে জড়িয়ে ধরে সমবেদনা জানায়। বিয়ের এতদিন পর এই প্রথম এনা ওকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে। স্বামী-স্ত্রীর আর পাঁচটা স্বাভাবিক মুহুর্ত আজ অব্দি গড়ে ওঠেনি তাদের মাঝে। এনাকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড হালকা অনুভব হয় রাহাতের। কিন্তু ওর শরীরটা কেমন অদ্ভুত লাগছে রাহাতের কাছে। একেবারে অদ্ভুত একটা অনুভূতিময় শরীর।
সে জিজ্ঞাসা করল,
-তোমার শরীর ঠিক আছে এনা?
- হ্যাঁ, কেন বলো তো?
- তোমার শরীরে কেমন যেন অদ্ভুত...
রাহাতের কথা শেষ হবার আগেই ওর মোবাইল ফোনে কল এলো। রাত তখন প্রায় এগারোটা। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সায়না বলল,
- ভাইয়া, একটু বাইরে আয়। একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে।
রাহাতের গলা শুকিয়ে যায়। আবারো এ বাড়িতে কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে না তো! এনাকে ছেড়ে দিয়ে সে কাঁপা কাঁপা সুরে বলল,
- বাইরে চলো।
- কিন্তু কেন?
- সায়না ডাকছে।
এনা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছুই বললো না। সেও রাহাতের পিছু পিছু ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়ালো। আদিব কান্নায় ভেঙে পড়েছে। তমিসা তখনো যেন শকে আছে। সদর গেইটের সামনে এক বয়স্ক দারোয়ান দাঁড়িয়ে। তারই দিকে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত দিয়ে সায়না কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
- ইনি গোরস্তানের বাইরে ডিউটি করেন। আরো কয়েকজন আছে, তবে তারা এই মুহুর্তে সেখানেই আছে। ইনি বলছেন, আমাদের শ্রাবণের লাশ নাকি কবর খুঁড়ে তোলা হয়েছে। উনারা স্বচক্ষে দেখেছে। একজনকে নাকি উনারা সেখান থেকে বেরও হতে দেখেছেন। তাকেই অনুসরণ করে এই পর্যন্ত। সে নাকি আমাদের বাসার গেইট অব্দি এসেছে।
এই পর্যন্ত বলেই সায়না একটু দম নেয়। তারপর এনার দিকে এগিয়ে এসে করুণ ভঙ্গিতে বলল,
- এনা ভাবি, তুমি না একটু আগে বাগানের দিকে ছিলে? বাগান থেকে ঘরে আসার সময় তোমার সাথে দেখা হলো। তুমি দেখেছো এমন সন্দেহভাজন কাউকে?
সায়নার এমন আকস্মিক প্রশ্নে এনা ঘাবড়ে যায়। একবার রাহাতের দিকে, আরেকবার দারোয়ানের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে সে জবাব দেয়,
- আমি তো আনমনেই সেখানে সোফায় বসে ছিলাম । শ্রাবণের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল। এতকিছু তো খেয়াল করিনি সায়না।
এনার জবাবে দারোয়ান ওর দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকালো। রাহাত সেটা খেয়াল করে জিজ্ঞাসা করলো,
- আপনি কি কিছু বলবেন?
দারোয়ান মুখ কাচুমাচু করে জবাব দিলো,
- স্যার, আমি তাকে এই বাসার দিকেই আসতে দেখেছিলাম। হাতের মধ্যে কিছু তো একটা ধরে ছিল, এটা নিশ্চিত। কিন্তু সে যে কে হতে পারে, অন্ধকারে চিনতে পারিনি।
এনা সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলো,
- আপনি তাকে চিনতেই পারলেন না?
- কি করে চিনবো ম্যাডাম? অন্ধকার ছিল। তাছাড়া আমি তো একেবারে তার পিছু পিছু ছুটিনি। বেশ দূরেই ছিলাম তার থেকে। তারপর বেল বাজিয়ে বাসায় ঢুকে এই সায়না ম্যাডামকে খুলে বলতেই উনি আপনাদের ডেকে পাঠালেন। এখানে এসেই জানতে পারলাম, ওই কবরের লাশটা এ বাড়িরই কারো।
সেদিন সারারাত আর কারো ঘুম হলো না। এমনিতেও এ বাড়ির সমস্ত আরাম আয়েশ পালিয়ে গেছে। ভোরে সায়না, আদিব এবং রাহাত গোরস্তানে যায়। দারোয়ানগুলোও ভয়ে ভিতরে ঢোকেনি। আসার পথে আকিমুল হাসানের বন্ধু ডাক্তার শেখর অধিকারীকে সাথে ডেকে নেয় ওরা। গোরস্তানে পৌঁছে শ্রাবণের কবরের কাছে গিয়ে দেখতে পেল, মুখটা তখনো ঢাকা রয়েছে। শুধু বুকের যেই জায়গায় হৃদপিন্ড থাকে, সেটুকু আলগা। জমাট বাধা কালো রক্ত। হৃদপিন্ড উধাও। বুকের ভিতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আদিবের প্রায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম। লোক ডাকিয়ে কবর ঢেকে দেবার আদেশ দিয়ে ওরা বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। সায়না একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহাতের দিকে চেয়ে বলল,
- তোর কী মনে হচ্ছে ভাইয়া?
- সবকিছু এমনি এমনি ঘটছে না। কিছু তো একটা কারণ অবশ্যই আছে।
- একদম তাই। তুই জানিস, বাবা কেন দীর্ঘদিন বাসার বাইরে বের হতেন না? খোঁজ নিয়েছিস?
রাহাত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
- কেন বের হতেন না?
- এমিলস নামক মানুষেরই এক অদ্ভুত প্রজাতির প্রাণীর কারণে। এই প্রশ্নের বাকি জবাব ডাক্তার শেখর আংকেল দিবেন।
চলবে...
© bnbooks.blogspot.com