আড়ালে সে
লেখিকা: সুহাসিনী
পর্ব ০১
নতুন বউ নিয়ে সবাই যখন বাসরঘরে মাতামাতি করছিল, তখন এনা বাড়ির বাচ্চাদের উপর ভয়ংকর দৃষ্টিতে চেয়েছিল। রাহাতের বোন সায়না অবশ্য সেটা শুরু থেকেই খেয়াল করেছে। এক পর্যায়ে এনা সকলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
"আপনারা এবার আসুন। আমি এত চিল্লাচিল্লিতে বিরক্ত হচ্ছি।"
নতুন বউয়ের এমন কথায় সবাই খুব মর্মাহত হলেও তেমন গায়ে মাখেনি। সারাদিনের অনেক ক্লান্তি। হয়তো বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এদিকে রাহাতের বাবা আকিমুল হাসান ছেলের এমন হঠাৎ সিদ্ধান্তের বিয়েতে রাজি ছিলেন না। অনেক কষ্টে বাবাকে মানিয়েছে সে। এনার মন এমনিতেই ভেঙে গেছে। মেয়েটার এখন বিশ্রাম দরকার। নিঃশব্দে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর রাহাত বাসরঘরে ঢুকে দেখে, এনা ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা মেয়ে বাসরঘর নিয়ে সারাজীবন জল্পনা কল্পনা করে থাকে। সেখানে কি-না মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কখন যেন তন্দ্রাভাব এসে যায় রাহাতের। খুব গভীর রাতে একবার যখন ঘুম ভাঙে, তখন তার পাশে এনার অস্তিত্ব ছিলোই না। ঘরের আলো জ্বালিয়ে সমস্ত ঘর, ওয়াশরুম, বারান্দা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে পাওয়া যায়নি। চিন্তায় ওর শরীর ঘেমে একাকার। পছন্দ করে বিয়ে করেছে সে। এনাকে যতটুকু চিনে, ওর তরফ থেকে ঠকানোর প্রশ্নই ওঠে না।
কিছুক্ষণ পর ঘরের বাইরে এসে রাহাত আবিষ্কার করল, এনা ডাইনিংয়ের দিকে পায়চারি করছে। সামনেই রাহাতের বড়ভাই অনিকেতের ঘর। অনিকেত,তার স্ত্রী আরাধ্যা এবং তাদের একমাত্র ছেলে আনান ঘুমিয়ে আছে ওই ঘরে।
রাহাত ধীর পায়ে এনার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে,
- এত রাতে এখানে কী করছো?
রাহাতের আকস্মিক প্রশ্নে চমকে ওঠে এনা। কম্পিত স্বরে জবাব দেয়,
- ঘুম আসছে না৷ তাই পায়চারি করছি।
-আমাকে ডাকতে পারতে।
- তুমি ঘুমুচ্ছিলে, তাই বিরক্ত করিনি।
রাহাত ওর মুখের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে থাকে। কী স্নিগ্ধ একটা মায়াময় মুখ! বিয়ের আড়ম্বর শরীরে এখনো লেপ্টে আছে তার। এনাকে দুহাতে নিজের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে আলতো চুমু খেতে গেলেই সে মাথা নিচু করে ফেলে। রাহাত তৃষ্ণার্ত পাখির মতো চেয়ে থাকে এনার ঠোঁটের দিকে। তবু তার বিন্দুমাত্র ভাবান্তর নেই। একসময় ওকে ছেড়ে দিয়ে চোয়ালে আলতো হাত বুলিয়ে রাহাত বলল,
- চলো, দুজনে বারান্দায় চাঁদ দেখি তবে।
- উঁহু।
- তবে?
- এখন তো ঘুম পাচ্ছে। আপনি চাঁদ দেখুন। আমি বরং ঘুমাই।
- একসাথে ঘুমালেই বা দোষ কোথায়?
এনা মৃদু হাসে৷ কিন্তু জবাব দেয় না৷ রাহাত তখনো শক্ত করে ওর হাত ধরে আছে। সে রাতে চাঁদ দেখা হয় না,ভালোবাসা হয় না। সন্ধ্যামালতীরা টুপ করে কেবল ঝরে পড়ে ভোররাতে।
সেদিন থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ বাসার কেউই এনার ব্যাপারে ততটা মাথাব্যথা করেনি। সবার আচার আচরণ এক হয় না। তারা ধরেই নিয়েছে, এনা হয়তো একটু ভিন্ন স্বভাবের মেয়ে। শুধু রাহাত বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না।
আজ সারাদিন অফিসে কাজে মনোযোগ দিতে পারেনি সে। সারাক্ষণ জানালায় চেয়ার পেতে বসে একটানা সিগারেট টেনেছে শুধু। সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে এনাকে নিয়ে ছাদে উঠে যায়। এনা অবশ্য একটু অবাকই হয়েছে। ঠোঁটে, মুখে বিস্ময়ের ঘোর রেখেই জিজ্ঞাসা করে,
- হঠাৎ ছাদে নিয়ে এলে যে!
আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলছে। ওদিকেই চেয়ে রাহাত জিজ্ঞাসা করল,
- এনা, আমি তোমাকে সুখী রাখতে পারছি তো?
- হঠাৎ এমন প্রশ্ন?
- তোমার আচরণ বাড়ির আর সবার থেকে আলাদা। কেমন চুপচাপ থাকো নিজের ঘরের মধ্যেই। আজ এতদিন হয়ে গেছে, আমরা বিবাহিত। দুজন দুজনের ঘনিষ্ঠও হতে পারিনি।
- দেখো রাহাত, আমি এখানে নতুন। তাই সবার সাথে এডজাস্ট করতে আমার তো একটু সময় চাই। তা না বলো? এখন তুমিও যদি এভাবে আমাকে নিয়ে দোটানায় পড়ে থাকো,তাহলে আমি কাকে ভরসা করবো?
এনার কথাগুলো ভারি খারাপ লাগল রাহাতের। সত্যিই তো, এনা এখানে কাউকে চিনে না। সবার সাথে মানিয়ে চলারও একটা ব্যাপার থাকে। একটা চাপা অনুতপ্তবোধে এনার হাতদুটো চেপে ধরে বলে উঠল,
- সরি এনা। আমারই ভুল হয়েছে তোমাকে এভাবে ভুল বোঝা। আমি আর জীবনেও তোমাকে এমনভাবে ভুল বুঝবো না।
এনার কপালে আলতো চুমু খেয়ে নিচে নেমে আসে রাহাত। এতদিন অযথা মেয়েটাকে নিয়ে এভাবে ভুল ভাবনার দারুণ পীড়া অনুভব হচ্ছে তার। প্রতিটা মানুষের জীবনেই আলাদা স্পেস প্রয়োজন। এনা তো সেই প্রয়োজনের উর্ধ্বে নয়।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ রাহাতের বাবা আকিমুল হাসান খাবার শেষে ছাদে উঠলেন রিলাক্স হবার জন্য। ডায়বেটিসের সমস্যার জন্য প্রায়ই ছাদে আসতেন আগে। কিন্তু মাঝখানে একটা ভয়ংকর দূর্ঘটনার জন্য কোথাও বের হতেই ভয় পান। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা এখন অব্দি বাসার কারো সাথে শেয়ার করে উঠতে পারেননি। একা একা পায়চারী করতে করতে গুনগুন করেই রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া আরম্ভ করলেন। ইতোমধ্যেই রেলিং ছেড়ে ছাদের ফাঁকা জায়গায় চলে এসেছেন তিনি।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে এভাবেই। হঠাৎ পিছে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ফিরে তাকালেন। একটা নারীমূর্তি যেন দাঁড়িয়ে আছে কাছেই। চশমাটা ঠিক করে নিয়ে চেয়ে দেখেন, ওটা এনা। তার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে তাকিয়ে আছে।
"এনা, এত রাতে ছাদে?"
আকিমুল হাসানের প্রশ্নের উত্তর এনা দিলো না। দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সজোরে তাকে ধাক্কা দিতেই আকিমুল সাহেব টাল সামলাতে না পেরে সোজা ওপাশে পড়ে গেলেন। একবার শুধু তার বিকট চিৎকার শোনা গেল।চিৎকার শুনেই আরাধ্যা ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতে পেল আকিমুল হাসানের নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। মাথা ফেটে রক্তও বের হচ্ছে বেশ।
ওর পিছু পিছু বাসার সবাই এসে হাজির হয়েছে। উনাকে ধরাধরি করে তুলে বসানোর চেষ্টা করলেও খুব একটা লাভ হলো না। আরাধ্যা পালস চেক করে দেখল, মানুষটা বেঁচে আছে।
"এম্বুলেন্স ডাকতে হবে। বাবা বেচে আছেন।"
-বলল আরাধ্যা।
কিন্তু তড়িঘড়ি করে বাইরে আসার সময় কারো হাতেই ফোন ছিলো না। সায়না ছুটে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে ফোন আনতে গিয়ে দেখে এনা ফোন হাতে সিঁড়িঘরের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসছে। ক্ষণিক অবাক হলেও বাবার দুশ্চিন্তায় জোর দিয়ে এনাকে উদ্দেশ্য করে সে বলল,
"ভাবি, তাড়াতাড়ি আসো। এম্বুলেন্স ডাকতে হবে। বাবা ছাদ থেকে পড়ে গেছেন।"
এনা মাথা দুলিয়ে সায়নার সাথে বাইরে এগিয়ে আসে। কল করে ডাকা হয় এম্বুলেন্স। এনার চোখেমুখেও ভারি বিষন্নতা।
পরদিন সকালে আকিমুল হাসানের জ্ঞান ফিরল ঠিকই। কোমরের দিকে একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এদিকে মাথায়ও কিছুটা আঘাত লাগার কারণে শরীরটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। না কথা বলতে পারছেন, আর না হাত পা নাড়াতে পারছেন। রাহাত, সায়না, অনিকেত ভিতরে ঢুকে বাবার পাশে বসে কান্না করছে। এছাড়া বাড়ির কাউকে সকাল অব্দি থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সকাল হতে না হতেই সবাই হাসপাতালে এসে হাজির। আরাধ্যার পিছু পিছু যখন আনানের হাত ধরে এনা ভিতরে ঢুকল, ওকে দেখামাত্রই আকিমুল হাসান কেমন জানি প্রতিক্রিয়া শুরু করলেন। চোখেমুখে আতঙ্ক। দেখলেই বুঝা যাচ্ছে, হঠাৎ অস্থির ছটফটানি শুরু হয়েছে কোনো কারণে। এনার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছেন তিনি।
সায়না বাবার চোখের দিকে চেয়ে তার দৃষ্টি বরাবর এনার দিকে ফিরে এসে তাকালো। এনাকে দেখে বাবার এমন প্রতিক্রিয়া করার কারণ কী!
© bnbooks.blogspot.com